চেইন ফার্মেসি ও বিনিয়োগে বদলাচ্ছে দেশের খুচরা ওষুধের বাজার
একসময় দেশের খুচরা ওষুধের বাজারে আধিপত্য ছিল পাড়া–মহল্লার ছোটখাটো ফার্মেসিগুলোর। ভোক্তারা মূলত আশপাশের ওষুধের দোকানের ওপরই নির্ভর করতেন, যেখানে বেশিরভাগ সময় পেশাদার ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি থাকত না। এসব দোকানে ওষুধের মাননিয়ন্ত্রণ ছিল অনিয়মিত এবং প্রযুক্তির ব্যবহারও ছিল খুব সীমিত।
দীর্ঘদিনের সেই কাঠামো এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বড় বড় স্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক ফার্মেসি চেইনগুলোর প্রবেশে ওষুধের খুচরা বাজার ধীরে ধীরে সংগঠিত, পেশাদার ও প্রযুক্তিনির্ভর ধারায় রূপ নিচ্ছে।
আকিজ রিসোর্স, একেএস খান হেলথকেয়ার ও ব্র্যাকের মতো দেশীয় গোষ্ঠীর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চেইন অ্যাস্টার ফার্মেসির প্রবেশে দেশে ওষুধ বিক্রি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে।
একই সঙ্গে স্থানীয় চেইনগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে, যা এ খাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, ভারী শিল্পখাতের তুলনায় খুচরা ফার্মেসি ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগের চাপ ও পরিচালন ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। পাশাপাশি এ খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের সম্ভাবনাও বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদদের মতে, বড় চেইন ফার্মেসিগুলো এখন আর শুধু শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ আয়ের মানুষের সেবাদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং এসব চেইন পুরো খাতকে মানসম্মত পরিচালনা, প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট, উন্নত কোল্ড-চেইন ব্যবস্থাপনা এবং শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক অনুশাসনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাফিউন নাহিন শিমুল বলেন, সংগঠিত ফার্মেসি চেইনের বিস্তার বাজারে একটি কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তিনি বলেন, "আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরে বাংলাদেশের ফার্মেসি খাত আরও সংগঠিত, পেশাদার ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠবে।"
তার মতে, বড় চেইন ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বড় শহরের বাইরে নিরাপদ ওষুধ সরবরাহ এবং পেশাদার সেবা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে। তবে একই সঙ্গে ছোট ফার্মেসিগুলোর সঙ্গে সমন্বয়, ওষুধের মূল্য সহনীয় রাখা এবং মাননিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, "বড় প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকিও তুলনামূলকভাবে সহজ হয়।"
আইকিউভিয়া হেলথের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বাজারের আকার প্রায় ৩২,০০০ কোটি টাকা। আইকিউভিয়া একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা তথ্য, বিশ্লেষণ, প্রযুক্তি ও ক্লিনিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
আকিজের বড় পরিসরের বিনিয়োগ
খুচরা ওষুধ খাতে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে আকিজ রিসোর্স। প্রতিষ্ঠানটি এ খাতে অন্তত ২,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে সারা দেশে ২,০০০টি আউটলেট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
চলতি বছরের জুলাইয়ে ঢাকার বনানীতে একটি ফ্ল্যাগশিপ আউটলেট দিয়ে আকিজ ফার্মেসির কার্যক্রম শুরু হয়। ডিসেম্বরের শুরু পর্যন্ত কেবল রাজধানীর মধ্যেই তাদের আউটলেটের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩টিতে।
আকিজ রিসোর্সের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ জসিম উদ্দিন বলেন, এই উদ্যোগের পেছনে অর্থনৈতিক লক্ষ্য থাকার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে।
তিনি বলেন, "আমাদের প্রথম লক্ষ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি। প্রতিটি আউটলেটে যদি পাঁচজন করে কর্মী নিয়োগ দেওয়া যায়, তাহলে মোট কর্মসংস্থান ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার রূপান্তরে অবদান রাখা।"
শেখ জসিম উদ্দিন জানান, আকিজ ফার্মেসিতে ওষুধের মান নিশ্চিতকরণ, কোল্ড-চেইন ব্যবস্থাপনা ও ন্যায্য মূল্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা–সংক্রান্ত পরামর্শও দেওয়া হবে। বর্তমানে ঢাকা, সিলেট, খুলনা, পাবনা ও যশোরে আউটলেট চালু রয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলায় কার্যক্রম বিস্তারের পরিকল্পনা আছে।
বিদেশি বিনিয়োগে দ্রুত সম্প্রসারণে একেএস
একেএস খান হেলথকেয়ার পরিচালিত একেএস ফার্মেসি দেশের দ্রুত বর্ধনশীল স্থানীয় চেইনগুলোর একটি। ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে সারা দেশে ৬০টির বেশি আউটলেট পরিচালনা করছে। এসব আউটলেটে প্রেসক্রিপশনভিত্তিক ওষুধ, ওভার দ্য কাউন্টার পণ্য, স্বাস্থ্যসেবা পরামর্শ ও হোম ডেলিভারি সেবা দেওয়া হচ্ছে।
গত বছর ডেনমার্কের আইএফইউ থেকে একেএস ফার্মেসি ১৫২ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ পায়। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, এই অর্থ নতুন আউটলেট সম্প্রসারণ, ডিজিটাল সেবা এবং ডায়াগনস্টিক সহায়তা জোরদারে ব্যবহার করা হবে।
একেএস খান হেলথকেয়ারের চিফ বিজনেস অফিসার মোস্তফা কামাল জানান, সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য।
তিনি আরও বলেন, "আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষাপটে সংগঠিত ফার্মেসি খাতে শীর্ষস্থানীয় অবস্থান গড়ে তুলতে চায় একেএস।"
বাজারে অ্যাস্টারের প্রবেশ
বাংলাদেশে প্রবেশ করা প্রথম আন্তর্জাতিক ফার্মেসি চেইন হলো অ্যাস্টার ফার্মেসি। সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক অ্যাস্টার ডিএম হেলথকেয়ারের পরিচালনায় ও জিডি অ্যাসিস্ট লিমিটেডের অংশীদারত্বে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ঢাকার বনানীতে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম আউটলেট চালু হয়।
বর্তমানে ঢাকায় বনানী, মিরপুর, বনশ্রী, উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকাসহ অন্তত পাঁচটি আউটলেট পরিচালনা করছে অ্যাস্টার। প্রতিটি আউটলেটে এক কোটির বেশি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এসব আউটলেটে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, পুষ্টিপণ্য ও স্বাস্থ্য সেবাসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, আগামী কয়েক বছরে সারা দেশে অন্তত ২৫টি আউটলেট চালু করা তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের খুচরা ফার্মেসি বাজারে দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান গড়ে তুলতে চায় অ্যাস্টার।
ব্র্যাকের ক্লিনিক–লিংকড মডেল
ফার্মেসিকে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করে ভিন্নধর্মী এক পদ্ধতি গ্রহণ করেছে ব্র্যাক হেলথকেয়ার। গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পরিচিত ব্র্যাক সম্প্রতি শহরাঞ্চলে তাদের ক্লিনিকগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত মডেল ফার্মেসি চালু করেছে।
চলতি বছর ঢাকায় ব্র্যাক হেলথকেয়ারে ৪টি আউটলেট চালু হয়েছে। প্রতিটি আউটলেটে বিনিয়োগের পরিমাণ এক কোটি থেকে দেড় কোটি টাকার মধ্যে।
ব্র্যাক হেলথকেয়ারের পরিচালক ও প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. তৌফিকুল হাসান সিদ্দিকী জানান, আগামী কয়েক বছরে অন্তত ২০টি আউটলেট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
তিনি বলেন, "এক ছাদের নিচে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। ছোটখাটো অসুস্থতার ক্ষেত্রে হাসপাতালে যেতে মূল্যবান সময় ও অর্থ ব্যয় হয়। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে প্রয়োজনে রোগীকে বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাই।"
ব্র্যাকের সিদ্ধেশ্বরী আউটলেটে রোগীরা প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। এরপর রক্তচাপ ও রক্তে শর্করা পরীক্ষাসহ প্রাথমিক পরীক্ষা করিয়ে একই কেন্দ্র থেকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ সংগ্রহ করেন।
ব্র্যাকের কর্মকর্তারা জানান, এই মডেলে সঠিক ওষুধ সরবরাহ, সঠিক পরামর্শ ও রোগীবান্ধব সেবার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ, অনলাইন অর্ডার ও হোম ডেলিভারি সেবার সুবিধাও রয়েছে।
লাজ ফার্মার সম্প্রসারণ
১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত লাজ ফার্মা বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ফার্মেসি চেইন। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ লুৎফর রহমান নিঃস্ব হাতে ঢাকায় এসে একটি স্থানীয় ফার্মেসিতে কাজ নিয়েছিলেন। পরে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন দেশের সবচেয়ে পুরনো এই ফার্মেসি চেইন। ১৯৯২ সালে তিনি কানাডায় চলে গেলেও ব্র্যান্ডটির মালিকানা নিজের কাছেই রেখেছেন।
বর্তমানে ঢাকায় প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ৪টি আউটলেট রয়েছে, যা তিনি পরিচালনা করেন। পাশাপাশি সারা দেশে লাজ ফার্মা ব্র্যান্ডের আওতায় ৯৪টি ফ্র্যাঞ্চাইজি আউটলেট পরিচালিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা, বগুড়া ও রংপুরেও চেইনটির কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, আকার ও অবস্থানভেদে ফ্র্যাঞ্চাইজি আউটলেট স্থাপনে বিনিয়োগের পরিমাণ ১০ লাখ টাকা থেকে এক কোটিরও বেশি হতে পারে। যদিও আউটলেটগুলো ফ্র্যাঞ্চাইজির আওতায় পরিচালিত, তবে ওষুধ সংগ্রহ কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। অনুমোদিত কোম্পানি থেকে সরাসরি ওষুধ সংগ্রহের মাধ্যমে মান ও সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ নিশ্চিত করা হয়।
প্রতিযোগিতা বাড়লেও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিনের উপস্থিতি ও সারা দেশের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কারণে বাংলাদেশের ফার্মেসি খাতে লাজ ফার্মা এখনো একটি আস্থার নাম।
