দেশের নগরবাসী শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যে তীব্র প্রভাব ফেলেছে মহামারি

রাজধানী ঢাকার মতো মহানগরে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ নেই অধিকাংশ মহল্লায়। নগরের খোপবন্দি জীবনে, বিদ্যালয় ছিল তাদের মুক্তির জায়গা। সেখানে সহপাঠিদের সঙ্গে খেলাধুলা করে আনন্দে কাটতো তাদের সময়।
শিশুর বিকাশের জন্যে সমবয়সীদের সংস্পর্শ এবং খেলাধুলাও অতি- মূল্যবান, বিজ্ঞান অনেক আগেই তা প্রমাণ করেছে। কিন্তু, শৈশবের রোজকার সেই রুটিনেও ব্যাঘাত ঘটিয়েছে মহামারি। গেল বছরের মার্চ থেকেই বন্ধ আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা বড় শহরে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক জগতে পড়েছে মারাত্মক প্রভাব। মানসিকভাবেও তাদের অনেকেই অস্বস্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের শিশু কল্যাণ তহবিল- ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ড ভিশন ইন্টারন্যাশনালের মতো বহুজাতিক এনজিও-সহ দেশীয় ১৫টি সংস্থার করা মাঠ পর্যায়ের এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে সম্প্রতি।
গবেষণাটি বলছে, ভার্চুয়াল মাধ্যমে দূরশিক্ষার উদ্যোগ শিশুর মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে পারেনি। বরং, এক বছরের বেশি সময় বাড়িতে থাকতে বাধ্য হওয়ার কারণে; তাদের উপর শারীরিক ও মানসিক চাপ পড়ছে। আর অভিভাবকেরাও সরাসরি ক্লাসের পক্ষেই মত দিয়েছেন।
শিশুদের মতামতকে গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। অংশগ্রহণকারী ৫৫ শতাংশ শিশুই সারাদিন বাড়িতে থাকা নিয়ে তাদের হতাশার কথা জানায়। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে নিয়মিত জীবন কষ্টকর হয়ে উঠেছে বলে জানায় ৪২ শতাংশ। আর ৫২ শতাংশ শিক্ষা জীবনে মহামারির প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
অভিভাবকদের মধ্যে এই উদ্বেগ আরও বেশি। দুই সন্তানের জননী মুনমুন নাহার পেশায় ঢাকার একটি স্কুলের শিক্ষক। তিনি বার্তা সংস্থা আনাদলু এজেন্সিকে মহামারির ক্ষতিকর দিক নিয়ে নিজ অভিজ্ঞতার কথা জানান। "আমার বাচ্চাদের আচরণে বড় রকম পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। অন্য বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকায় ওরাও ভালো নেই। ঠিকমতো ঘুমায় না, সবসময় যেন চিন্তিত। মাঝে মাঝে রাতে হঠাৎ করেই জেগে ওঠে। আমি চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে এখন ওদের বিশেষ যত্ন নিচ্ছি।"
স্কুল বন্ধের পর থেকে বাচ্চারা হয় টেলিভিশন দেখে, নয়তো স্মার্টফোনে গেম খেলে সময় কাটাচ্ছে। সবকিছুই হয়ে পড়েছে বাড়ি কেন্দ্রিক, বলছিলেন ঐ গৃহিণী।
"কয়েক মাস আগে ডাক্তার আমার তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া বড় ছেলেকে চশমা ব্যবহার করতে বলেছেন। মহামারির মধ্যে বেশি বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেই ওর চোখে এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, সারাদিন বাড়িতে থেকে আমার ছয় বছরের ছোট ছেলেটিও রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না," যোগ করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত:
সামাজিক মাধ্যমে শিশুদের বিচরণ মহামারিতে আরও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেখানে তাদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার মতো নানা রকম উপাদান আছে, এবং শিশুরা নিয়মিত এগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে।
অনলাইন বিচরণের এই অবাধ স্বাধীনতায় গ্রামের শিশুদের চাইতে পরিবেশগত বৈষম্য এবং একক পরিবার কাঠামোর কারণে; শহরে বসবাস করা শিশুরাই বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে । বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সমবয়সীদের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগও বঞ্চিত তারা।
মানসিক স্বাস্থ্যের সঠিক বিকাশে শিশুদের দরকার বন্ধু, খেলার মাঠ ও পার্ক। অথচ দেশের সবচেয়ে বড় নগর ঢাকায় এসবের তীব্র অভাব।
ওয়ার্ল্ড ভিশন ইন্টারন্যাশনালের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জারিন জেবা খান বলেন, মহামারি নিয়ে করা সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ শতাংশের বেশি শিশু অহেতুক উৎকন্ঠা বোধ করছে। উদ্বেগ নিয়ে প্রচণ্ড চাপ মোকাবিলা করছে তারা।
"শিশুরা যেসব বিষয়ের সম্মুখীন হয়, যা অনুভব করে এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণকে আমরা অধিকাংশ সময়েই উপেক্ষা করে যাই। কিন্তু, বাস্তবতা হলো শিশু-কিশোরদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা ও যত্নের জন্যেই আমাদের ওদের মনোভাব বুঝতে হবে।"
"আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে কিছু শিশুর মধ্যে উদ্বেগ এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যার কথাও ভেবেছে। তাছাড়া, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি এখন সংস্কার করা প্রয়োজন, যাতে শিশুরা স্কুল খোলার পর বাড়তি চাপমুক্ত থাকতে পারে," যোগ করেন এ বিশেষজ্ঞ।
সরকারি উদ্যোগ:
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. গোলাম ফারুক আনাদলু'কে জানান, ইতোমধ্যেই তারা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারি স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন "কী পরিমাণ শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভুগছে- তা নির্ণয়ে সরকারি পর্যায়ে এখনও কোনো গবেষণা করা হয়নি। তবে অনেকেই এ সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, বলে আমরা আশঙ্কা করছি।"
সারা দেশের এক লাখ শিক্ষককে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে তারা সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করা ও তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারবেন বলে জানান তিনি।
গোলাম ফারুক আরও জানান, গুরুতর সমস্যায় ভোগা ছাত্রদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার সুপারিশও করতে পারবেন এসব প্রশিক্ষিত শিক্ষক। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাহায্য প্রত্যাশী অভিভাবকদের জন্য একটি বিশেষ হেল্পলাইন নাম্বার চালু করার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকার মতো বড় শহরে উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠের অভাব স্বীকার করে নিয়ে তিনি একমত পোষণ করে বলেন, 'সার্বিক পরিবেশের কারণেই গ্রামের তুলনায়- শহরের শিশুরা মানসিক চাপে বেশি ভুগে থাকে।'
সরকার এসব বিষয় আমলে নিয়ে শিশুদের চাপমুক্ত রাখার লক্ষ্যে শিক্ষাক্রম বহির্ভূত কর্মকান্ড যেমন; ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন বৃদ্ধি করবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
এদিকে, শীঘ্রই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের একাধিক সূত্র। তবে যথাযথ স্বাস্থ্য নির্দেশনা পাওয়ার পরই এব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ইউনেস্কোর হিসাবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ১৪৪টি দেশে ১২০ কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশে মোট ৩ কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ প্রাথমিক পর্যায়ের। এদের প্রায় সকলেই মহামারির কারণে সরাসরি শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণের সুযোগ বঞ্চিত হয়েছে।
- সূত্র: আনাদলু এজেন্সি