ইউরোপে প্রথম অন-বোর্ড ফ্রোজেন চালানের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি খাত
বছরের পর বছর কমতে থাকার পর নতুন করে আশার আলো দেখছে বাংলাদেশের হিমায়িত চিংড়ি শিল্প। প্রথমবারের মতো দেশ থেকে ইউরোপে পাঠানো হয়েছে অন-বোর্ড ব্লক ফ্রোজেন 'ওশান টাইগার' চিংড়ি। রপ্তানিকারক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের চিংড়ি খাত আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
গত ১৮ অক্টোবর ১ লাখ ৬৭ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের ৮ দশমিক ৫ টন ব্লক ফ্রোজেন 'ওশান টাইগার' চিংড়ি ইউরোপের বেলজিয়ামে রপ্তানি করা হয়। চালানটি পাঠায় বাংলাদেশের শিল্পভিত্তিক মৎস্য আহরণকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান র্যানকন সি ফিশিং লিমিটেড। চিংড়িগুলো কোম্পানির গভীর সমুদ্রগামী জাহাজ এফভি যৌথ উদ্যমে আহরিত ও একই জাহাজে বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
র্যানকন সি ফিশিং ডিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর শাহরিয়ার রিমন বলেন, "এটি কেবল একটি বাণিজ্যিক চালান নয়, এটি একটি মাইলফলক। আমরা প্রথম কনটেইনার পাঠিয়েছি—এখন বিশ্বাস করি, নির্ভুলতা ও গুণগত মানের মাধ্যমে নতুন এই বাজারকে আরও প্রসারিত করতে পারব এবং দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারব।"
অন-বোর্ড ব্লক ফ্রিজিংয়ের বিশেষত্ব
সাধারণ হিমায়িত চিংড়ির তুলনায় অন-বোর্ড ব্লক ফ্রোজেন চিংড়ির প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পূর্ণ আলাদা। সাধারণত জাহাজ থেকে চিংড়ি নামিয়ে স্থলভিত্তিক কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কিন্তু অন-বোর্ড ব্লক ফ্রিজিং পদ্ধতিতে চিংড়ি সমুদ্রে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের ভেতরেই প্রক্রিয়াজাত ও হিমায়িত করা হয়।
রিমন বলেন, "চিংড়িগুলো ধরার পর বাছাই, শ্রেণিবিন্যাস বা মাথা অপসারণ এবং ধোয়ার কাজ সম্পন্ন হয়। এ সময় আলোকমাত্রা নিশ্চিত করতে প্রথমে 'লাক্স মিটার' ব্যবহার করা হয়, যাতে বাছাই ও শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিটি ধাপ আরও সতর্ক ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন হয়।"
"প্রতিটি ব্যাচ সমুদ্রে হাতে ধরার মতো মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করা হয়, যেন কোনো ধরনের দূষক না থাকে। এরপর চিংড়িগুলোকে ৮০০ গ্রাম, ১.৫ কেজি ও ২ কেজি ওজনের ব্লকে প্রক্রিয়াজাত করে জাহাজের কোল্ড স্টোরেজে মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। তীরে আনার পরও একই তাপমাত্রায় স্থলভিত্তিক কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হয়," ব্যাখ্যা করেন রিমন।
তিনি আরও বলেন, চালান পাঠানোর আগে ফিশ ইনস্পেকশন অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল (এফআইকিউসি) অফিস থেকে স্বাস্থ্য সনদ নেওয়া হয়, এবং প্রতিটি ব্যাচ পুনরায় স্ক্যান করে নিশ্চিত করা হয় কোনো ধরনের দূষক অবশিষ্ট নেই।
রিমন জানান, "আমাদের জাহাজগুলো আইএসও ও এইচএসিএসপি সার্টিফায়েড, এবং আমরা কঠোরভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গুণগত মান নির্দেশিকা অনুসরণ করি। আমাদের ক্রুরা নিয়মিত হ্যান্ডলিং, স্বাস্থ্যবিধি ও অন-বোর্ড প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পান, যাতে এসব মান বজায় থাকে।"
ইইউ সার্টিফিকেশনের পথে
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ মূলত জাপানে ব্লক ফ্রোজেন চিংড়ি রপ্তানি করলেও ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হয়নি। যদিও স্থলভিত্তিক কারখানায় প্রক্রিয়াজাত চিংড়ি বহু বছর ধরে ইউরোপীয় বাজারে রপ্তানি হচ্ছে, তবে সমুদ্রে জাহাজে ধরা ও প্রক্রিয়াজাত করা অন-বোর্ড ব্লক ফ্রোজেন চিংড়ির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমোদন আগে ছিল না।
এ বছর শুরুর দিকে সার্টিফিকেশন পাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসে। ফিশ ইনস্পেকশন অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল (এফআইকিউসি), মেরিন ফিশারিজ ডিপার্টমেন্ট (এমএফডি) এবং এক্সপোর্ট প্রোমোশন ব্যুরো (ইপিবি)-এর সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই অনুমোদন নিশ্চিত হয়।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইউরোপীয় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের (ইইউ ফুড সেফটি অথরিটি) একটি পরিদর্শন দল বাংলাদেশের নির্বাচিত কয়েকটি জাহাজ পরিদর্শন করে। দলের সদস্যরা ইউরোপীয় মান অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা যাচাই করেন। কয়েক মাসের মূল্যায়নের পর ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পাঁচটি জাহাজকে অন-বোর্ড ব্লক ফ্রোজেন সামুদ্রিক পণ্য রপ্তানির অনুমোদন দেয়।
অনুমোদনপ্রাপ্ত জাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে—র্যানকন সি ফিশিং ডিভিশনের এফভি সি স্টার ও এফভি যৌথ উদ্যম, সি রিসোর্স গ্রুপের এফভি এসআরএল–৩, এবং ডিপ সি ফিশিং লিমিটেডের ডিপ সি–১ ও ডিপ সি–৩।
এফআইকিউসি–এর উপপরিচালক ফারহানা লাভলী বলেন, "ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যে এসব জাহাজকে তাদের ওয়েবসাইটে তালিকাভুক্ত করেছে। আরও কয়েকটি জাহাজের সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া চলছে—এসআরএল ফিশিংয়ের দুটি এবং র্যানকনের একটি জাহাজ মূল্যায়নাধীন রয়েছে। আমরা শিগগিরই তাদের অনুমোদন পাওয়ার আশা করছি।"
আশার আলো
একসময় বিশ্বের শীর্ষ চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশগুলোর একটি ছিল বাংলাদেশ। ২০১৬–১৭ অর্থবছরে খাতটি ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছিল। তবে রোগবালাই, আন্তর্জাতিক মান রক্ষায় দুর্বলতা এবং চাষকৃত 'ভ্যানামি' চিংড়ির প্রতিযোগিতায় রপ্তানি দ্রুত কমে যায়। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি দাঁড়ায় ২৪৮ মিলিয়ন ডলারে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
পরের বছর বহুমুখীকরণের প্রচেষ্টায় রপ্তানি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ২৯৬ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
এফআইকিউসি–এর উপপরিচালক ফারহানা লাভলী বলেন, "ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ এ খাতের পুনরুদ্ধারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এতদিন আমরা কেবল জাপানেই ব্লক ফ্রোজেন চিংড়ি পাঠাতাম, ফলে দাম নিয়ে আলোচনার সুযোগ ছিল সীমিত। ইউরোপের প্রিমিয়াম পণ্যের চাহিদা রপ্তানিকারকদের লাভের পরিমাণও বাড়তেও সহায়ক হবে।"
খরচ বাড়ছে, কমছে আহরণ
রপ্তানিতে সামান্য প্রবৃদ্ধি এলেও শিল্পভিত্তিক মৎস্য আহরণ খাত চাপে রয়েছে বাড়তি খরচ ও সামুদ্রিক সম্পদের ঘাটতির কারণে।
র্যানকন সি ফিশিং ডিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর শাহরিয়ার রিমন বলেন, "গত পাঁচ বছরে জ্বালানির দাম প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে অতি আহরণ, দূষণ ও অগভীর সমুদ্রে অবৈধ ট্রলিংয়ের কারণে গত বছর সামুদ্রিক চিংড়ি ও মাছের আহরণ প্রায় ২১ শতাংশ কমেছে।"
তিনি আরও বলেন, "কিছু জাহাজ তাদের জ্বালানির খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছে।"
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এনাম চৌধুরীও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি সরকারের ৮ শতাংশ রপ্তানি প্রণোদনার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, "এই প্রণোদনাই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখছে।"
তিনি জানান, বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পর ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে এই ভর্তুকি কমিয়ে ৫ শতাংশে আনা হবে এবং একই বছরের নভেম্বরে পুরোপুরি তুলে নেওয়া হবে এটি।
তিনি বলেন, "আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি, ভর্তুকি বন্ধের পরও যেন বিকল্প কোনো উপায়ে এই খাতকে সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়।"
বিশ্ব চিংড়ি বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান
অবজারভেটরি অব ইকনমিক কমপ্লেক্সিটি (ওইসি)–এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী হিমায়িত চিংড়ি ও প্রন বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশ ছিল প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ববাজারে মোট রপ্তানির প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ অংশীদারিত্ব নির্দেশ করে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য (ইপিবির উদ্ধৃতি অনুযায়ী) বলছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানির শীর্ষ গন্তব্য ছিল চীন (৫৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার), এরপর রয়েছে নেদারল্যান্ডস (৪৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার), যুক্তরাজ্য (৪৫ মিলিয়ন ডলার), বেলজিয়াম (৪০ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার), জার্মানি (২৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার), যুক্তরাষ্ট্র (২০ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার), ফ্রান্স (১৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার), জাপান (১১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার), পর্তুগাল (৮ মিলিয়ন ডলার) এবং স্পেন (৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার)।
বাংলাদেশ মূলত ইউরোপে ইনডিভিজুয়াল কুইক ফ্রোজেন (আইকিউএফ), সেমি–আইকিউএফ, পিলড আন–ডিভেইন্ড (পিইউডি), পিলড অ্যান্ড ডিভেইন্ড (পিঅ্যান্ডডি) এবং সেমি–কুকড চিংড়ি রপ্তানি করে থাকে। তবে ব্লক ফ্রোজেন চিংড়ির রপ্তানি এতদিন সীমিত ছিল জাপান ও চীনের বাজারে।
রিমন বলেন, "এটি ইউরোপে পাঠানো প্রথম ব্লক ফ্রোজেন চিংড়ির চালান, এবং এটি আমাদের জন্য একটি বড় অগ্রগতি। এবার আমরা 'ওশান টাইগার' প্রজাতির চিংড়ি রপ্তানি করেছি; আমাদের মোট আহরণের প্রায় ৩০ শতাংশই এই প্রজাতির চিংড়ি। বাকি অংশে রয়েছে ব্রাউন, হোয়াইট, ফ্লাওয়ার টাইগার ও রেড চিংড়ি—এর মধ্যে আবার বেশিরভাগই ব্রাউন।"
তিনি আরও বলেন, "যদি আমরা ব্রাউন ব্লক ফ্রোজেন চিংড়িও ইউরোপীয় বাজারে রপ্তানি করতে পারি, তবে সেটি হবে বড় অর্জন। রপ্তানির সেই পরিধি বাড়ানোই আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য।"
রিমন জানান, "আমরা ইতোমধ্যে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশের সম্ভাব্য ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছি, যাতে অন-বোর্ড ফ্রোজেন চিংড়ি ও মাছের মাধ্যমে সেসব দেশের বাজারে বাংলাদেশের উপস্থিতি বাড়ানো যায়।"
"আমাদের মূল লক্ষ্য হলো গুণগত মান, ট্রেসেবিলিটি ও টেকসই আহরণের সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে বাজার সম্প্রসারণ করা," যোগ করেন তিনি।
