জে-৩৬: যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে দ্রুত এগোচ্ছে চীনের ষষ্ঠ প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রকল্প
শত্রুর রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার স্টেলথ প্রযুক্তির পুরোধা যুক্তরাষ্ট্র হলেও—চীনের স্টেলথ বিমান প্রযুক্তি এখন যেন দুরন্ত গতিতে এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বেইজিং-ও ব্যস্ত ষষ্ঠ প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান নির্মাণে। এরকম দুটি প্রকল্প রয়েছে চীনের। যার একটি হচ্ছে জে-৩৬। সম্প্রতি জে–৩৬ বিমানটির নতুন প্রোটোটাইপ ডানা মেলতে দেখা গেছে চীনের আকাশে। নতুন এই পরীক্ষামূলক সংস্করণটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, বেইজিং তার পরবর্তী প্রজন্মের বিমান আধিপত্যের দৌড়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলতে চায়।
গত মাসে চীনা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে, চীনের বৃহদাকৃতির তিন ইঞ্জিনবিশিষ্ট স্টেলথ যুদ্ধবিমান। অনানুষ্ঠানিকভাবে এই বিমানের নাম জে-৩৬ বলছেন প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষকরা। এটি বিমানটির দ্বিতীয় প্রোটোটাই। চেংদুর সামরিক-শিল্পাঞ্চলের কাছে এটি পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন করেছে, গতবছরের ডিসেম্বরে প্রথম প্রোটোটাইপ প্রদর্শনের মাত্র ১০ মাস পর।
এত কম সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় প্রোটোটাইপের উন্নয়নটাই বিস্ময়ের। কারণ আধুনিক যুদ্ধবিমান নির্মাণ, গবেষণা ও উন্নয়নে লাগে দীর্ঘসময়।
নতুন প্রোটোটাইপে রয়েছে আগেরটির থেকে বেশকিছু কাঠামোগত পরিবর্তন—নতুন এয়ার ইনটেক ডিজাইন, পুনঃনকশাকৃত ল্যান্ডিং গিয়ার, এবং নতুন এক্সহস্ট লেআউট। তবে আগের সংস্করণের ডেল্টা আকৃতির ডানা ও দুজন পাইলটের বসবার মতো সাইড-বাই-সাইড ককপিট ডিজাইন অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
আগের প্রোটোটাইপে ওয়াইএফ–২৩ মডেলের মতো রিসেসড এক্সহস্ট ব্যবহার করা হয়েছিল বিমানের ইঞ্জিননির্গত তাপপ্রবাহের ইনফ্রারেড সিগনেচার কমাতে, কিন্তু নতুন সংস্করণে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ–২২ র্যাপটর ফাইটার জেটের মতো ফ্ল্যাট, টু-ডাইমেনশনাল থ্রাস্ট-ভেক্টরিং নোজল। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ডিজাইনাররা হয়তো কিছুটা স্টেলথ সক্ষমতা ছাড় দিচ্ছেন—হাই এঙ্গেল অব অ্যাটাক বা উচ্চ কোণে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ ও ম্যানুভারিবিলিটি বাড়ানোর লক্ষ্যে।
সংশোধিত নকশার ডাইভার্টারলেস সুপারসনিক ইনলেট এবং সাইড-বাই-সাইড মেইন ল্যান্ডিং গিয়ার ইঙ্গিত দেয়, চীন এখন অ্যারোডায়নামিক গতিশীলতা, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও বিমানের অভ্যন্তরীণ স্থান বাড়ানোর জন্য কাঠামোগত পরিমার্জনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
এই দ্রুত পরিবর্তনগুলোর গতি আধুনিক যুদ্ধবিমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী। সাধারণত এমন প্রকল্পে একেকটি সংস্করণের পরিবর্তন আসতে বছরের পর বছর লেগে যায়, কিন্তু চীন কয়েক মাসের ব্যবধানেই প্রোটোটাইপ উন্নত করছে—এ যেন "লিপফ্রগিং" কৌশল, অর্থাৎ ধাপে নয়, এক লাফে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা।
এই প্রচেষ্টা আরও তুলে ধরছে, দূরপাল্লায় আকাশে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির দিকে চীনের একাগ্রতা ও আগ্রহকে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার হাতে রয়েছে সর্বাধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। বিভিন্ন দেশ চেষ্টা করছে নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের বিমান তৈরিতে। এরমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এসব যুদ্ধবিমান মনুষ্যহীন বিমান বা ড্রোনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিছু ড্রোন আবার নিজেরাও হবে যুদ্ধবিমানের মতোই আক্রমণ সক্ষমতার। চীনের প্রোটোটাইপটিও এধরনের ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিক থেকে মার্কিন বিমানবাহিনীর প্রকল্পের সাথে জে-৩৬ প্রকল্পের মিল রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের এয়ার ভাইস মার্শাল জেমস বেক সম্প্রতি বিজনেস ইনসাইডার-এ বলেন, "পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার এখন যে কোনো আধুনিক বিমান বাহিনীর জন্য মৌলিক প্রয়োজন—এমনকি সবচেয়ে প্রাথমিক হুমকির বিরুদ্ধে আকাশে সাময়িক আধিপত্য অর্জনের জন্যও।"
তবুও বিশ্বের অধিকাংশ বিমান বাহিনী, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনও, এখনো চতুর্থ বা চতুর্থ প্লাস প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের ওপর নির্ভরশীল। এ ধরনের বিমান সংখ্যায় বেশি, রক্ষণাবেক্ষণে সাশ্রয়ী এবং প্রস্তুত রাখাও সহজ।
বেক বলেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়েছে আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশ কতটা কঠিন। এমন বাস্তবতায় ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান প্রয়োজন হয়ে উঠছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), স্বয়ংক্রিয় ড্রোন সহযোগিতা, দীর্ঘ পাল্লা ও উন্নত স্টেলথ বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে।
তবে বেক সতর্ক করে বলেন, "ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি একটি দশকের কাজ, দিনের নয়।" কিন্তু চীনের দ্রুত অগ্রগতি সেই ধীরগতির যুক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করছে।
চীনের এই অগ্রগতি হয়তো নির্ভর করছে তাদের বিশ্বাসের ওপর—"ডিসরাপটিভ টেকনোলজি" বা বিপ্লবী প্রযুক্তি প্রচলিত দুর্বলতাকে ছাপিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ পুরোনো পদ্ধতি বাদ দিয়ে নতুন কনসেপ্টে বিনিয়োগই পারে যুদ্ধের ধরন বদলে দিতে এবং কৌশলগত সুবিধা এনে দিতে।
ফাইটার বিমান উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে, চীনের যদি সত্যিই ষষ্ঠ প্রজন্মের ফাইটার দ্রুত মাঠে নামাতে পারে, তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সংখ্যায় নয়, প্রযুক্তিতে-ও এগিয়ে যাবে।
তবে ওয়াশিংটনও বসে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের এফ–২২ ও এফ–৩৫ ফাইটারগুলোকে পরবর্তী দশকের জন্য সক্ষম রাখতে ধারাবাহিকভাবে আপগ্রেড করা হচ্ছে, যতদিন না তাদের ষষ্ঠ প্রজন্মের— নেক্সট জেনারেশন এয়ার ডমিন্যান্স (এনজিএডি বা এনগ্যাড) প্রকল্প পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়।
দ্য ওয়ার জোন জানায়, "এফ–২২ ক্যাপাবিলিটি পাইপলাইন" কর্মসূচির অধীনে বিমানটি নতুন এইম-২৬০ জেট্যাম ক্ষেপণাস্ত্র, উন্নত ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম, এবং উন্নত সেন্সর পাচ্ছে। ককপিটের t ডিসপ্লে ও রাডারও আধুনিক হচ্ছে, যাতে সফটওয়্যার দ্রুত আপডেট দেওয়া যায়।
একইভাবে, অনলাইন প্রতিরক্ষা প্রকাশনা ওয়ার জোন ২০২৫ সালের এপ্রিলে এক প্রতিবেদনে জানায়, লকহিড মার্টিন তাদের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের এফ–৩৫ যুদ্ধবিমানকে "পঞ্চম প্রজন্ম প্লাস" সংস্করণে রূপ দিচ্ছে, যেখানে এনগ্যাড প্রকল্পের প্রযুক্তি সংযোজন করা হচ্ছে—যাতে ষষ্ঠ প্রজন্মের সক্ষমতার ৮০ শতাংশই এতে পাওয়া যায় অর্ধেক খরচে।
এই আপগ্রেডে থাকবে নতুন স্টেলথ উপকরণ, সেন্সর, এআই অটোনমি বা নিজ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এবং মানব পাইলটের সহযোগী হিসেবে থাকা ড্রোন দিয়ে যৌথ যুদ্ধ সক্ষমতা।
যুক্তরাষ্ট্র এখন তার এনগ্যাড প্রোটোটাইপগুলো গোপনে উড়াচ্ছে, প্রকাশ না করেই। ন্যাশনাল সিকিউরিটি জার্নাল–এর ক্রিশ্চিয়ান ওর উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের এনগ্যাড ডেমোনস্ট্রেটর আকাশে উড়ছিল, অর্থাৎ চীনের আগে থেকেই তারা পরবর্তী প্রজন্মের বিমান তৈরি শুরু করেছে।
তবুও চীনের উৎপাদন ক্ষমতা এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট–এর বিশ্লেষক ব্র্যান্ডন ওয়েইচার্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বর্তমানে ১৮৫টি এফ–২২ ও ৪০০টি এফ–৩৫ থাকলেও, চীনের হাতে ৩০০-এর বেশি জে–২০ রয়েছে এবং পাঁচটি উৎপাদন লাইন থেকে প্রতি আট দিনে একটি নতুন বিমান তৈরি হচ্ছে।
চীন যদিও অল্পসংখ্যক পঞ্চম প্রজন্মের জে–৩৫ ফাইটার তৈরি করেছে, তবে তাদের লক্ষ্য বছরে এই বিমানের ৫০টি ইউনিট উৎপাদন করা। তুলনায়, যুক্তরাষ্ট্রের এফ–৩৫ উৎপাদন হার বছরে ১৪০টি, যা আগামী দুই–তিন বছরের মধ্যে চীনের পেছনে পড়ে যেতে পারে।
ওয়েইচার্ট বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের বিমানগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু চীন তার পুরো বিমানশক্তি (দক্ষিণ চীন সাগরের) ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করতে পারে"—যা জাপান থেকে ফিলিপাইন হয়ে বোর্নিও পর্যন্ত বিস্তৃত একটি কৌশলগত প্রতিরক্ষা বলয়। এতে চীন আঞ্চলিকভাবে সংখ্যাগত আধিপত্য বজায় রাখতে পারবে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রতিরক্ষা শিল্পভিত্তি চীনের উৎপাদনগত গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না।
আরেকটি প্রতিরক্ষা প্রকাশনা, ব্রেকিং ডিফেন্স গত মাসে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী যুদ্ধবিমানের বহর বাড়ানোর জন্য জরুরি অনুরোধ জানিয়েছে, কারণ বর্তমানে বিদ্যমান ৪৫টি স্কোয়াড্রন—যা স্নায়ুযুদ্ধের সময় ১৩৪টি ছিল—চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর থেকে আসা বর্ধিত বৈশ্বিক হুমকি মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়।
যুক্তরাষ্ট্র এখন পুরোনো বিমান আধুনিকায়নের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের এনগ্যাড এবং সিসিএ সিস্টেম একসঙ্গে মিশিয়ে সংখ্যাগত ও প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব ফিরিয়ে আনতে চায়।
তবুও প্রশ্ন রয়ে যায়—যদি যুক্তরাষ্ট্র আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি ও আত্মতুষ্টিতে ভোগে, আর চীন তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান প্রকল্পের গতি আরও বাড়ায়, তাহলে আগামী প্রজন্মের বিমান আধিপত্য হবে একটি এশীয় শক্তির, আমেরিকার নয়। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো ক্ষুণ্ণ হতে পারে আকাশপথে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য। এই পাশা খেলায় বাজি খুবই উচ্চ, তাই ওয়াশিংটন বা বেইজিং কারো জন্যই পিছিয়ে পড়ার সুযোগ নেই।
