ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোকান ও সেখানকার আড্ডা
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলাম, সমাজ তখনো আমাদের মতো এতটা বিভক্ত বা সংঘর্ষময় হয়নি। আচরণ, সম্পর্ক আর আড্ডার জগৎ, সবকিছুই ছিল খানিকটা আলাদা, খানিকটা উষ্ণ। আমরা ছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচ। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পরেই দেখি চারপাশে নতুন নতুন মুখ, নতুন সম্পর্ক, নতুন ভাবনা।
১৯৭২ সালের কথা। আমি ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছি সবে। এসেছিলাম ঢাকা কলেজ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা অসংখ্য রকমের মানুষ ছিলাম। বন্ধুদের কেউ এসেছে এই শহর থেকে, কেউ আবার দূরের কোনো জেলা থেকে।
তবে আমার কলেজের যারা বন্ধু ছিল, তাদের কেউ কেউ রাশিয়ায় পড়তে চলে যায়। ফলে অনেকটা বন্ধুশূন্য হয়ে পড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমার নতুন নতুন বন্ধু হয়। পরিসর বড় হলো আস্তে আস্তে। আমরা ছিলাম যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আসা জেনারেশন। ফলে আমাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা সবকিছুই ছিল অনেক বেশি। এমনকি আমার বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই ছিল যাদের বাবা যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। ফলে তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এসে অভিযোজন করা ছিল কষ্টসাধ্য।
তাছাড়া আমরা একাত্তরের আগে ছিলাম ভদ্রলোক সমাজের মানুষ। সুশীল, নিয়মমাফিক জীবনযাপন করা এক প্রজন্ম। কিন্তু যুদ্ধ আমাদের সেই পরিমিত জীবনের ছাঁচ ভেঙে দেয়। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। একটা বেয়াদব শহর, বেয়াদব দেশ, আর বেয়াদব ব্যবস্থা তৈরি হলো চোখের সামনে।
সে সময়ে অনেক বন্ধু শহীদ হলো, আবার কেউ যুদ্ধোত্তর বিশৃঙ্খলায় পথ হারিয়ে ফেলল, কেউ ডাকাত হয়ে গেল, কেউ ঝুঁকে পড়ল চরমপন্থী রাজনীতির দিকে। সবাই এককভাবে খুব সহজ-সরল ছিলাম, তাও কিন্তু না।
এই অবস্থায়ই ঢাকায় ঢুকল ড্রাগস। ১৯৭২ সালে ঢাকা শহরে গাঁজা ঢোকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেকেই এর ক্রেতা হতে শুরু করে। আমি ছিলাম মোটামুটি ওপরের তলার মানুষ। ফলে আমাদের বাড়িতে অনেক কাজের লোক থাকতেন, সাধারণত নিম্নবর্ণের হিন্দু।
বিকেল বেলা, সপ্তাহে এক-দুই দিন তারা মিলেমিশে গাঁজার আড্ডা দিতেন। তখন সোনারগাঁও হোটেলের পাশে 'পালপাড়া' নামে একটা বস্তি ছিল। সেটি পাকিস্তানিরা ২৫ মার্চ রাতে পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেই বস্তির মানুষেরা বিকেলে গাঁজার আড্ডা দিলেই আমার মা তাদের জন্য দুধ আর নাস্তা পাঠাতেন। কারণ, গাঁজা খেলে ক্ষুধা বাড়ে, আর না খেলে শরীর খারাপ হয়ে যায়। তাই মা নিজের স্বার্থে ওদের জন্য দুধ-নাস্তা পাঠাতেন। তখন গাঁজা খাওয়া ঠিক এতটাই স্বাভাবিক ছিল। মূলত আমাদের জেনারেশন থেকেই ভদ্রলোকেরা গাঁজা খাওয়া শুরু করে৷ আগে তারা এসব খেত না। এটা ছিল নিম্নবর্ণের মানুষের খাবার, নিম্ন শ্রেণির মানুষের নেশা৷
১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম আমি। বিশ্ববিদ্যালয় তখন আড্ডায় মুখর থাকত। এমনকি তখন অনেক বহিরাগত আমাদের আড্ডায় আসত। আসর জমাতো।
আমরা ছিলাম ভালো ছাত্র, পড়াশোনায় মনোযোগী। আমাদের মতো মানুষেরা একসঙ্গে জুটতাম আড্ডাখানাগুলোতে। তবে আমাদের সময়ের আড্ডাগুলোতেও পার্থক্য ছিল৷ যেমন- সে সময়ে যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারা যেত মধুর ক্যান্টিনে। আর যারা রাজনীতির বাইরে, তারা ভিড় জমাতাম শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনেই ছিল শরিফ মিয়ার দোকান। শরিফ মিয়া পুরান ঢাকার লোক। ভালো রান্না জানতেন। তার চায়ের খ্যাতি ছিল ক্যাম্পাসজুড়ে। আট আনায় ডাল, চা আর দুটো পরাটা পাওয়া যেত তার দোকানে। দুই-তিন টাকাতেই হয়ে যেত সব। পাশেই ছিল পেড্রো নামের আরেকটা ক্যান্টিন। সেখানেও অনেকে ভিড় জমাতো।
লাইব্রেরি থেকে আর্টস ফ্যাকাল্টিতে যাওয়ার পথে একটা দেয়াল ছিল। সেটার পাশেই ছিলো ক্যান্টিনগুলো। অবশ্য শরিফ মিয়ার দোকান উচ্ছেদ হয়ে গেলেও 'পেড্রো' নামের দোকানটি অনেকদিন টিকে ছিল।
শরিফ মিয়ার দোকানে কবি-সাহিত্যিকদেরও ভিড় জমত। আল মাহমুদ, রফিক আজাদ ভাই, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল ভাই, আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার, আবুল হাসান, আসাদ চৌধুরী- এরা সবাই আসতেন।
মূলত শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে লেখক শিবিরের লোকেরা আড্ডা দিতেন। ওই ক্যান্টিনে বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপ-আলোচনা হতো বেশি। ওখান থেকেই চিন্তা-ভাবনা, বিতর্ক আর সাহিত্য চর্চা জন্ম নিত।
সে সময়ে টিএসসিতে আমরা খুব কম যেতাম। কারণ, অন্য জায়গার তুলনায় খাবারের দাম সেখানে কিছুটা বেশি ছিল। আর মানুষও থাকত কম। আজকের মতো এত এত দোকান ছিল না তখন। যে কয়েকজন টিএসসি যেতেন, তারা গার্লফ্রেন্ড নিয়েই যেতেন৷ তাই ছেলেরা সেখানে যেতে তেমন স্বাচ্ছন্দবোধ করতো না।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া হলের বাইরেও তখন অনেক খাবারের দোকান ছিল; হলের খাবার খেতে না পারলে বাইরে গিয়ে এসব দোকানে খেত অনেকেই। আমাদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার মানে ছিল ক্যান্টিনে যাওয়া। কারণ, সেগুলোই ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপ-আলোচনার প্রাণকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আকর্ষণ।
ক্যান্টিনগুলোতে তখন সিঙ্গারা, পরোটা, বুটের ডাল, ড্রাই কেক পাওয়া যেত; শরিফ মিয়ার দোকানে এসবই পাওয়া যেত। এসব খাবার আমাদের কাছে বেশ মজাদার ছিল। আবার মধুর ক্যান্টিনে খাবারের মান ভালো ছিল।
শাহবাগেও আড্ডা হতো। কবি-সাহিত্যিকেরা রাতের আড্ডা দিত নিউ মার্কেটের একটা ক্যান্টিন, মনিকোতে। আসলে কারা কোথায় আড্ডা দেয়—তা দিয়েই মানুষের পরিচিতি তৈরি হতো: মধুর ক্যান্টিনে পলিটিশিয়ানদের আড্ডা, দিনে কবিদের আড্ডা শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে, রাতে মনিকো, আর আমাদের মতো সাধারণ ছেলেরা যেখানে পারে সেখানেই। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে মদও পাওয়া যেত। যদিও সবাই জানত না কোথায়, যারা খেত কেবল তারাই জানত।
একটা মজার ঘটনা বলি। একবার এক চরমপন্থী ছেলেকে পার করানোর জন্য আমরা তাকে মদ খাইয়েছিলাম। তাকে মাতাল বানিয়ে পুলিশের কাছে মাতাল প্রমাণ করে টিএসসি পার করেছিলাম। সে সময়ে মাতাল হলে পুলিশ কিছু বলে না বা করে না বলে আমাদের ধারণা ছিল। সত্যিই পুলিশ সেদিন কিছুই করেনি।
গাঁজা তখন ক্যাম্পাসে সহজলভ্য ছিল। এক গ্রাম এক টাকা, আর মদের দাম ছিল ২০ টাকা। আমাদের এক বন্ধু প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে গাঁজা খেত; কিন্তু এটায় কারো ক্ষতি হয়নি। গাঁজা খেলে মানুষ খারাপ হয় এমনটি তো নয়। এখন দেখলাম দোকান উচ্ছেদ হচ্ছে। অনেক কিছু বলাও হচ্ছে। কিন্তু দোকান উচ্ছেদ করলেও মদ-গাঁজার সাপ্লাই কখনোই স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে না।
আমাদের সময়ে অনেক বহিরাগত ছিল। যেমন- আহমদ ছফা ভাই, যিনি ইন্টারন্যাশনাল হলে থাকতেন। তিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না। তবুও কোনো ঝামেলা সৃষ্টি হতো না। প্রতিটি হলের সামনে অনেকগুলো ছাপড়া দোকান (টিনের চালের ছোট ছোট দোকান) ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন হত্যাযজ্ঞ হয়, তখন ইকবাল হলের ছাপড়ার দোকানের এক দোকানিও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এসব দোকান আসলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। প্রায় ১৫–২০টা এমন দোকান ছিল যেগুলো শিক্ষার্থীদের আড্ডাখানা হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল।
তখন 'অবৈধ দোকান' বলে তেমন কোনো সংজ্ঞা ছিল না। যদি কোনো নির্মাণ কাজের দরকার হতো, হয়ত কোনো দোকান সরিয়ে দেওয়া হতো; কিন্তু আইন করে নয়। আর তেমন জোর-জবরদস্তি আমরা দেখিনি তখন। অবশ্য আমাদের কাছে অনেক কিছুই সহজ ছিল। হয়তো যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে একটা বড় হওয়া প্রজন্মের কাছে কোনো কিছু খারাপ নয় বলেই এমন মনে হতো। তাই আমরা সহজ একটি বিশ্বের মানুষ হয়ে বড় হয়েছি। ফলে আমাদের কাছে অনেক কিছুই স্বাভাবিক ছিল।
