যে কারণে ‘জেন জি’ বিক্ষোভের মুখে সরকার ভেঙে দিতে হলো মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্টকে

মাদাগাস্কারে গত এক সপ্তাহ ধরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন। বিদ্যুৎ-পানির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সংকটকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভের শুরু, তা দ্রুতই তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।
বিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা পুরো সরকারকে ভেঙে দিলেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। বরং রাজধানী আন্তানানারিভোর রাজপথ এখন 'রাজোয়েলিনা হটাও' স্লোগানে মুখর।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই অস্থিরতায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২২ জন নিহত এবং ১০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। যদিও মাদাগাস্কার সরকার এই সংখ্যাকে 'গুজব' বলে উড়িয়ে দিয়েছে। গত প্রায় ১৫ বছরের মধ্যে দেশটিতে এটিই সবচেয়ে বড় গণবিক্ষোভের ঘটনা।
শুরুটা যেভাবে
সংকট শুরু হয় গত ১৯ সেপ্টেম্বর। রাজধানী আন্তানানারিভোতে বিদ্যুৎ ও পানির সংকট নিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ডাক দেওয়ায় দুই শীর্ষ রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ঘটনাই অসন্তোষের আগুনে ঘি ঢালে। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহকারী সংস্থার ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে জনজীবন আগে থেকেই বিপর্যস্ত ছিল।

গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ভিন্নমত দমনের চেষ্টা হিসেবে দেখে রাজপথে নেমে আসে সাধারণ মানুষ। 'জেন জেড মাডা' নামে তরুণদের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম দ্রুতই এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে। যা প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে রাজধানী ছাড়িয়ে দ্বীপের আরও আটটি শহরে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণে ব্যর্থ এবং এর পেছনে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি।
কী চান বিক্ষোভকারীরা?
সরকারি পরিষেবার সংকট নিয়ে শুরু হলেও বিক্ষোভটি এখন পুরোপুরি রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবিতে রূপ নিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের সুনির্দিষ্ট কোনো ইশতেহার না থাকলেও তাদের মূল দাবি প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনার পদত্যাগ।
অনিরাপদ ভবিষ্যৎ ও স্বল্প বেতনের চাকরিতে থাকা তরুণেরা দেশের দুরবস্থার জন্য প্রেসিডেন্টকেই দায়ী করছেন। 'জেন জেড মাডা'-র একজন মুখপাত্র বলেন, তারা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের পাশাপাশি 'জাতীয় পরিষদকে দুর্নীতিমুক্ত' করতে চান। এ ছাড়া, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহতদের দায়ভার প্রেসিডেন্টকে নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
বিক্ষোভে সমর্থন জানিয়েছে দেশটির বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠনসহ একাধিক ইউনিয়ন। বিরোধীদলীয় নেতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্টও এক যৌথ বিবৃতিতে বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তারা প্রেসিডেন্টের সরকারে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবকে জনগণের সঙ্গে 'বিশ্বাসঘাতকতা' বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার দমন-পীড়নের পথেই হাঁটছে। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করা হচ্ছে। সহিংসতা ও লুটপাটের পর রাজধানীতে জারি করা হয়েছে সান্ধ্য আইন।
তবে একদিকে দমন-পীড়ন, অন্যদিকে আলোচনার আশ্বাসও দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা। সরকার বরখাস্ত করার পর তিনি কিছু মন্ত্রীকে ব্যর্থ বলে উল্লেখ করেন। বিদ্যুৎ সংকট কাটাতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তরুণদের সঙ্গে আলোচনার কথাও বলেছেন। তবে তার এই পদক্ষেপ ক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করতে পারেনি।

প্রেসিডেন্টের ভবিষ্যৎ কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভিন্নমত দমন করার চেষ্টা করে, তবে এই বিক্ষোভ আরও দীর্ঘায়িত ও তীব্র হতে পারে।
মাদাগাস্কার বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটি দেশ, যেখানে ৭৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দেশের ৩ কোটি মানুষের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণের কারণে রাজোয়েলিনা হয়তো এই ধাক্কা সামলে নিতে পারবেন বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। তবে চূড়ান্ত নির্ধারক হতে পারে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। যদি সামরিক বাহিনী জনগণের ওপর বলপ্রয়োগের আদেশ অমান্য করে, তবে পরিস্থিতি যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে।
উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মাদাগাস্কারে একাধিকবার অভ্যুত্থান ও গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস রয়েছে। ২০০৯ সালে এমনই এক গণবিক্ষোভের মুখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সে সময় প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন রাজোয়েলিনা। পরে ২০১৮ সালে নির্বাচনে জিতে এবং ২০২৩ সালে বিরোধী দলগুলোর বর্জন করা বিতর্কিত নির্বাচনে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন।