গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল: জাতিসংঘ তদন্ত কমিশন

জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল।
নতুন ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যার যে পাঁচটি ধারা রয়েছে, তার মধ্যে চারটি ধারা অনুযায়ী ২০২৩ সালে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল সেখানে গণহত্যা চালিয়েছে। খবর বিবিসির।
ধরা ৪টি হলো—কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা, তাদের গুরুতরভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা, পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করা এবং জন্ম প্রতিরোধ করা।
প্রতিবেদনে ইসরায়েলি নেতাদের বক্তব্য এবং সেনাদের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যার অভিপ্রায়ের (ইচ্ছার) প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে দেওয়া এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, এটি 'বিকৃত ও মিথ্যা'।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র কমিশনের তিন বিশেষজ্ঞকে 'হামাসের প্রতিনিধি' আখ্যা দিয়ে অভিযোগ করেছেন, তারা পুরোপুরি "হামাসের মিথ্যা প্রচারণার ওপর নির্ভর করেছেন—যা ইতোমধ্যেই খণ্ডিত হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এই প্রতিবেদনের মিথ্যার বিপরীতে হামাস নিজেই গণহত্যার চেষ্টা করেছে। তারা ইসরায়েলে ১,২০০ লোককে হত্যা করেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে, পরিবারগুলোকে জীবন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে এবং প্রকাশ্যে প্রতিটি ইহুদিকে হত্যার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে।"
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাস-নেতৃত্বাধীন নজিরবিহীন হামলার জবাবে গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সেনারা। হামাসের ওই হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এরপর থেকে ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনের অন্তত ৬৪,৯০৫ জন নিহত হয়েছেন।
গাজায় বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অধিকাংশ মানুষ। অনুমান করা হচ্ছে, ৯০ শতাংশের বেশি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। স্বাস্থ্য, পানি, স্যানিটেশন ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা গাজা শহরে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেছেন।
এদিকে, অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সব ধরনের মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে ২০২১ সালে স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল।
তিন সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্বে রয়েছেন নাভি পিল্লাই। দক্ষিণ আফ্রিকার এই সাবেক জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান রুয়ান্ডার গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদে বর্ণিত গণহত্যার সংজ্ঞায় যে পাঁচটি কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ আছে, তারমধ্যে মধ্যে ৪টিই গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ও সেনারা। এ কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- সুরক্ষিত জায়গায় হামলা চালিয়ে গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা; লক্ষ্যভিত্তিকভাবে বেসামরিক এবং অন্যান্য সুরক্ষিত ব্যক্তিদের টার্গেট করা; এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা।
- বেসামরিক ও সুরক্ষিত স্থানে সরাসরি হামলা চালিয়ে গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি সাধন, বন্দিদের ওপর অমানবিক আচরণ, জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি এবং পরিবেশ ধ্বংসের মাধ্যমে ক্ষতি সাধন।
- ফিলিস্তিনিদের ধ্বংসের উদ্দেশ্যে জীবনযাপনের এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে পুরো বা আংশিক গোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়। এর মধ্যে রয়েছে—ফিলিস্তিনিদের জন্য জরুরি অবকাঠামো ও জমি ধ্বংস, চিকিৎসা সেবা ধ্বংস করা ও প্রবেশাধিকার বন্ধ, জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি; জরুরি সাহায্য, পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে বাধা; প্রজননে বাধা এবং শিশুদের ওপর বিশেষ ক্ষতিকর পরিস্থিতি চাপিয়ে দেওয়া।
- ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গাজার সবচেয়ে বড় ফার্টিলিটি ক্লিনিকে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৪ হাজার ভ্রূণ, ১ হাজার শুক্রাণু নমুনা ও নিষিক্ত না হওয়া ডিম্বাণু ধ্বংস হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এটি জন্ম প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েলি নেতাদের দেওয়া বক্তব্য পর্যালোচনার পর দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট গণহত্যায় উসকানি দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ড বিবেচনায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, একমাত্র গণহত্যার উদ্দেশ্যই এসব কাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
কমিশনের মতে, এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে—ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে নজিরবিহীন সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে; নিয়মিত ও ব্যাপক আকারে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো; এবং গাজায় অবরোধ আরোপ করে সেখানকার জনগণকে অনাহারে রাখা হয়েছে।
তবে অন্যদিকে, ইসরায়েলি সরকার দাবি করেছে, তাদের প্রচেষ্টা কেবল হামাসের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংসের জন্য, গাজার জনগণের বিরুদ্ধে নয়। তারা বলছে, সেনারা আন্তর্জাতিক আইন মেনেই কাজ করছে এবং বেসামরিক মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে।