ডম-ইনো এফেক্ট: ফ্ল্যাট ক্রেতারা প্রতারিত, প্রকল্পগুলো পরিত্যক্ত

এক সময় রাজধানীর আবাসনখাতে পরিচিত নাম ছিল ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেড। আধুনিক আবাসন নির্মাণের প্রতিশ্রুতিতে তারা প্রায় দুই দশক রাজধানীর অভিজাত এলাকায় প্রকল্প চালু করেছিল। কিন্তু এখন কোম্পানিটি ডুবে আছে মামলার বোঝায়, দুর্নীতির অনুসন্ধানে এবং হাজারো ফ্ল্যাট ক্রেতা ও জমির মালিককে প্রতারণার অভিযোগে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন– রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর তথ্য বলছে, গত দেড় যুগে ডম-ইনোর ১৪২টি প্রকল্প নিয়ে অভিযোগ এসেছে। যার মধ্যে অন্তত ৫৬টি প্রকল্প হাতে নিয়ে নির্মাণের আগেই সবগুলো অ্যাপার্টমেন্ট আগাম বিক্রি করা হলেও— গ্রাহকের কাছে একটিও হস্তান্তর করেনি। ক্রেতারা প্রায় দুই হাজার অ্যাপার্টমেন্টের জন্য অর্থ প্রদান করেছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এদিকে সব প্রকল্পে অংশিক কাজ হওয়ার পর এখন সেগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
ফ্ল্যাট ক্রেতারা প্রতারিত, উচ্ছেদ হওয়া জমির মালিক
আবাসন প্রকল্প/ ভবন নির্মাণে যেসব জমির মালিক ডম-ইনোর সাথে যৌথভাবে উন্নয়নের চুক্তি করেছিলেন, এখন তারা বাস করছেন ভাড়া বাসায়। কারণ প্রতিশ্রুত ফ্ল্যাট তো দূরের কথা, চুক্তি অনুযায়ী প্রাথমিক যে টাকা পাওয়ার কথা—সেটাও তারা পাননি। ক্রেতারাও অভিযোগ করেছেন—এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় থাকলেও প্রকল্পের কাজ এগোয়নি।
কোম্পানি মুখে বলে যাচ্ছে যে 'সমাধানের লক্ষ্য কাজ চলছে', কিন্তু ভুক্তভোগী ক্রেতারা বলছেন—ফ্ল্যাট হস্তান্তর ও ভাড়া প্রদানের প্রতিশ্রুতি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে।
ডম-ইনোর এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুস সালাম বর্তমানে বিদেশে আছেন। তবে এ তথ্য স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা যায়নি।
জমছে মামলার স্তূপ, দুদকের তদন্ত
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ করেছে, ডম-ইনোর এমডি আব্দুস সালাম ক্রেতাদের প্রতারণা করে অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন, বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়েছেন অন্যান্য খাতে। এর মধ্যে রয়েছে লিওন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। সালাম একবার দুর্নীতির মামলায় জেলও খেটেছেন।
ডম-ইনো এবং প্রতিষ্ঠানটির এমডির বিরুদ্ধে বর্তমানে ১৫০টির বেশি প্রতারণা-সংক্রান্ত মামলা চলছে, যার মধ্যে শুধুমাত্র বনানী থানাতেই দায়ের হয়েছে ১৩৬টি মামলা। প্রতারণা, চেক জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার—সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন।
ডম-ইনোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সালাম বিগত আওয়ামী লীগ সরকারে আমলে কয়েক দফা কারাগারে গেলেও জামিনে বের হন। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর তিনি বিদেশ চলে গেছেন বলে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে।
প্রতারণার কৌশল
রিহ্যাবের সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল মাহমুদ টিবিএস-কে বলেন, "আব্দুস সালাম তার ভাই আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সবুরের প্রভাব খাটিয়ে বছরের পর বছর এ ধরনের প্রতারণা চালিয়ে গেছেন, কোনো সমস্যাও হয়নি।"
তাঁর দাবি, "শুধু অ্যাপার্টমেন্ট মালিকের টাকা আত্মসাৎ করা ও জমির মালিকদের সাথেই প্রতারণা করেনি আব্দুস সালাম, তিনি ২০১০ সালের আগে থেকেই অনেক প্রকল্পের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির আগেই — ওই জমি ও নির্মাণাধীন অ্যাপার্টমেন্ট ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ রেখে ঋণ নিয়েছেন। ফলে অনেক অ্যাপার্টমেন্টে মালিকরা উঠলেও নিজেদের নামে দলিল বুঝে পাননি এখনও পর্যন্ত। এখন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওই মর্টগেজড সম্পত্তিগুলো নিলামে তোলার জন্য মামলা করেছে। ফলে এইসব অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা হারাতে পারেন ক্রেতারা।"
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিমের ঘটনাই বলা যাক। রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের 'ডম-ইনো ইনভিয়ার্নো' প্রকল্পে ২০০৮ সালে ১,২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনেন তিনি। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১০ সালে ফ্ল্যাটটি হস্তান্তরের কথা। ১৫ তলা ওই ভবনের অ্যাপার্টমেন্ট হলো মোট ১০৮টি।
আবদুল হালিম বলেন, "হস্তান্তরের আগেই অতিরিক্ত নির্মাণ খরচের কথা বলে ডম-ইনো প্রত্যেক ফ্ল্যাট মালিকের কাছ থেকে আরও ২ লাখ করে টাকা নেয়। আমি ফ্ল্যাটে উঠলেও দেখতে পাই নির্মাণকাজে নানান ধরনের ত্রুটি—ফলস ছাদ দিয়ে পানি পড়ে, ব্যালকনি নির্মাণে ত্রুটি, বৃষ্টি হলেই ভবনের নীচে গ্যারেজে পানি জমা হওয়া ইত্যাদি। গ্যারেজের জন্য যে পরিমাণ জায়গা রাখা দরকার সেটিও রাখা হয়নি। চুক্তির সব টাকা ও অতিরিক্ত চাওয়া সব টাকা পরিশোধের পর, মালিকানা নিবন্ধন করে দেয়ার বিধান থাকলেও—প্রায় ৬ বছর পর ডম-ইনো রেজিস্ট্রেশন করে দেয়। যার জন্যও চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত দেড় লাখ টাকা চার্জ দাবি করে।
ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম বলেন, "এই অ্যাপার্টমেন্টর মালিকানা নিবন্ধন পেতে সর্বশেষ হাইকোর্টে রিট করতে হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৬ সালের শুরুর দিকে নিবন্ধন করে দিতে বাধ্য হয় আবাসন কোম্পানিটি।"
তিনি বলেন, "ফ্ল্যাট কেনা থেকে মালিকানা পাওয়া পর্যন্ত ছিল শুধু ভোগান্তি আর ভোগান্তি। আমি একজন আইনজীবী হয়েও আমার ন্যায্য অধিকার আদায়ে প্রায় ছয় বছর লড়াই করতে হয়েছে। সাধারণ ক্রেতাদের দুর্ভোগ যে কত ভয়াবহ, তা শুধু কল্পনা করা যায়।"
ব্যারিস্টার হালিমের মতোই, ডম-ইনোর প্রকল্পগুলো থেকে ফ্ল্যাট কিনে শত শত মানুষ পড়েছেন একই দুর্ভোগে। এদের মধ্যে অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন, কিন্তু ফ্ল্যাট না পাওয়ায় সেই ঋণ শোধ করতে না পেরে তারা আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছেন।
যেমন ২০০৮ সালে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় ডম-ইনোর একটি প্রকল্প থেকে ১,৩০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন মেশিনারিজ পার্টস ব্যবসায়ী মাহমুদুল হাসান। ফ্ল্যাটটির দাম ছিল ৯২ লাখ টাকা, যার মধ্যে ৭০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দীর্ঘ ১৬ বছরেও প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়নি। মাহমুদুল হাসান টিবিএস-কে বলেন, "আমি এখন ফ্ল্যাটবিহীন, আর ওই ঋণের কারণে মামলার ঝামেলায় জড়িয়ে আছি।"
প্রতারিত ক্রেতারা ফ্ল্যাটের টাকা ফেরত পাবেন কি না, তা নির্ভর করছে চলমান প্রতারণার মামলাগুলোর নিষ্পত্তির ওপর — জানিয়েছেন ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম।
তিনি আরও বলেন, কোনো ক্রেতা চাইলে ব্যক্তিগতভাবে অথবা যৌথভাবে হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে পারেন। আদালত এ বিষয়ে প্রতিকার দিতে পারেন।
চুক্তি লঙ্ঘনের উদাহরণ অজস্র
রাজধানীর আরমানিটেলার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন। পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া তার ২৬ কাঠা জমির ওপর ১০৪টি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে ২০০৭ সালে চুক্তি করেন ডম-ইনোর সাথে। চুক্তির শর্ত ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করার। চুক্তির ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও, এখনো নির্মাণকাজ অসম্পন্ন রয়েছে।
২০১৫ সালে আলমগীর ডম-ইনোর বিরুদ্ধে মামলা করেন। তখন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুস সালাম হলফনামা দিয়ে আদালতকে আশ্বস্ত করেন যে কাজ আবার শুরু হবে। কিন্তু আলমগীরের অভিযোগ, কাজ শুরু হলেও এখনো শেষ হয়নি। এখনো পর্যন্ত মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ হয়েছে, বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে অর্ধনির্মিত ভবন।
চুক্তি অনুযায়ী, ১০৪ ফ্ল্যাটের অর্ধেক অর্থাৎ ৫২টি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা ছিল আলমগীরের। কিন্তু তিনি টিবিএস-কে বলেন, "এখনো শুধুমাত্র গ্রাউন্ড ফ্লোরের কাজ হয়েছে। কিন্তু ডম-ইনো তার ভাগের ৫২ টি ফ্ল্যাট জমি নিয়ে চুক্তির পরই বিক্রয় করে দিয়েছে। চুক্তির সময়ের মধ্যে অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করতে না পারলে, প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকা করে বাড়ি ভাড়া দেয়ার কথা থাকলেও, সেটিও দিচ্ছে না। এভাবে প্রায় ১০ কোটি টাকা পাওনা হয়েছে। এখন পথে বসে যাওয়ার দশা আমার। মামলা করেছি। আদালত টাকা দেয়ার আদেশ দিলেও ডম-ইনো তা মানছে না।"
মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী নাজমুল হক আরমানিটোলার এই প্রকল্পে ১২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য প্রায় ১৮ বছর আগে ৮০ লাখ টাকা দেন ডম-ইনোকে। ফ্ল্যাট দূরের কথা, এখন টাকাই ফেরত পাচ্ছেন না তিনি।
নাজমুল হাসান বলেন, "প্রবাস জীবনে উপার্জনের বেশিরভাগ অংশ একটি মাত্র অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য ডম-ইনোকে দিয়েছি। না কিনলে বুঝতেই পারতাম না তাদের প্রতারণার বিষয়ে। এখন মামলা করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে জীবন শেষ।"
এমন পরিস্থিতি শুধু এই প্রকল্পেই নয়, প্রায় ৫৬টি ডম-ইনো প্রকল্পে একইভাবে জমির মালিক ও ক্রেতারা ভুক্তভোগী হয়েছেন। অগ্রিম টাকা নেওয়ার পরও ফ্ল্যাট হস্তান্তর হয়নি বা বছরের পর বছর বিলম্বিত হচ্ছে।
চলমান ৫৬ প্রকল্পের প্রতিটি নিয়ে অভিযোগ
রিহ্যাবের কাছে ফ্ল্যাটের ক্রেতা ও জমির মালিকদের অভিযোগ অনুযায়ী, গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডিসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেড -এর ৫৬ টি আবাসন প্রকল্পে জড়িত। বেশিরভাগ প্রকল্প ১৫-১৮ বছর আগে শুরু করলেও এখন পর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারেনি।
ফ্ল্যাট ক্রেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করলেও এখনো ফ্ল্যাট পাননি। অন্যদিকে, কিছু জমির মালিকরাও অভিযোগ করছেন, তাঁদের চুক্তি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করা হয়নি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নয়াপল্টনের ৫৫ নম্বর হোল্ডিংয়ে ২৯ কাঠা জমির ওপর পাঁচটি বিলাসবহুল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে ডম-ইনো। ২০০৭ সালে জমি নিলেও কাজ শুরু করে চার বছর পর ২০১১ সালে। ২০১৪ সালে নির্মাণ সম্পন্ন করে হস্তান্তরের চুক্তি থাকলেও এখন পর্যন্ত ভবনটির ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়নি। নির্মাণ কাজ বন্ধ আছে।
জমির মালিকরা অভিযোগ করেছেন, তাঁরা গত ১৪ বছর ধরে ভাড়া বাসায় থাকছেন। চুক্তি অনুযায়ী, দেরিতে হস্তান্তরের জন্য মাসিক ৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও কোম্পানি সেটিও দেয়নি।
এছাড়া এই প্রকল্পে অ্যাপার্টমেন্ট কিনে প্রতারিত হয়েছে ৭০ জনের বেশি। কাজ শেষ না করেই অ্যাপার্টমেন্ট ক্রেতাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রায় এক কোটি টাকা করে নিয়েছে আবাসন কোম্পানিটি।
ডম-ইনোর বিভিন্ন প্রকল্পে একইভাবে জমির মালিক ও ক্রেতাদের প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করার পরও এখনো তাঁদের অনেককেই ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হয়নি।
জমি মালিকের স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগ
বনানীর আবাসিক এলাকায় মো. সিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি ১৯৭৪ সালে তৎকালীন ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) থেকে পাঁচ কাঠা জমি বরাদ্দ পান। তার মৃত্যুর পর ওই প্লটের ওয়ারিশসূত্রে তাঁর স্ত্রী বেগম রোকেয়া ইসলাম, ছেলে মো. এনামুল হক ও মো. একরামুল হক, মেয়ে আক্তার বানু ও নাহিদ আক্তার মালিকানা লাভ করেন।
২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেডের সঙ্গে ফ্ল্যাট নির্মাণের জন্য চুক্তিপত্র সই হয়। যেখানে একজন ওয়ারিশ এনামুল হকের স্বাক্ষর করেননি। তবুও ডম-ইনো একটি আমমোক্তারনামার মাধ্যমে নির্মাণকাজ শুরু করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এনামুল হক ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত লন্ডনে ছিলেন। দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, রাজউকের কাছ থেকে ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য ডম-ইনোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুস সালাম এনামুল হকের স্বাক্ষর জাল করেন।
এ ঘটনায় দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আলী আকবর পাঁচজনকে আসামি করে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর বনানী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে জাল সিল-স্বাক্ষর ব্যবহার করে মিথ্যা নকশা অনুমোদন দেখিয়ে নির্মাণকাজ করার অভিযোগ আনা হয়।
এই মামলাটি এখনো ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন। আব্দুস সালামকে এ মামলায় একবার কারাগারে যেতে হয়েছিল, তবে পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগ ছাড়াও আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫–১৬ অর্থবছরে সালাম তাঁর আয়কর রিটার্নে মোট ২৯.১০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য দেন। কিন্তু তিনি এই সম্পদের উৎসের প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হন। এমনকি যে আয়ের উৎস তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তা ঘোষিত সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে দুদকের তদন্তে উঠে আসে।
ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেড এবং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, চেক প্রত্যাখ্যান ও অর্থপাচারের অভিযোগে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫০টি মামলা দায়ের হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব মামলার বেশিরভাগই করেছে রিয়েল এস্টেট খাতের গ্রাহকরা এবং দুদক।
আবাসনের তহবিল অন্য খাতে সরানোর অভিযোগ
ডম-ইনোর আবাসন প্রকল্প থেকে সংগৃহীত অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের অভিযোগে দুদক আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে।
তদন্তে সম্পৃক্ত দুদকের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ডম-ইনোর আবাসন প্রকল্পের জন্য নেওয়া অর্থ ব্যবহার করে আব্দুস সালাম অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি অ্যাফিক্সবিডি (AffixBD) নামে একটি কৃষি ব্যবসা ও উৎপাদনভিত্তিক কোম্পানির মালিক। এছাড়া ২০১৩ সালে তিনি লিওন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন, যা স্থানীয় বাজারে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করে এবং ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে।
দুদকের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ফ্ল্যাট ক্রেতাদের বিনিয়োগ করা অর্থ ব্যবহার করেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। অথচ ডম-ইনো বিনিয়োগকারীদের প্রতিশ্রুত অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে আব্দুস সালামের এসব কোম্পানির কার্যক্রম এখনো চলছে।
এক সময়ে ডম-ইনোর বার্ষিক টার্নওভার ছিল এক হাজার কোটি টাকা
২০০২ সালে প্রতিষ্ঠার পর ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেড দ্রুত বিকসিত হয়। একের পর এক প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ২৫৪টি আবাসিক প্রকল্প নির্মাণ সম্পন্ন করে। শীর্ষ সময়ে কোম্পানিটির বার্ষিক টার্নওভার এক হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছিল বলে জানা যায়।
তবে ২০১০ সালের পর থেকে ডম-ইনোর কার্যক্রমে ধস নামে। খাতসংশ্লিষ্টরা এবং কোম্পানির সাবেক কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালামের অনিয়ম ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের কারণেই এই অবনতি শুরু হয়।
ডম-ইনোর এক সাবেক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "বিভিন্ন প্রকল্পে আব্দুস সালাম জমির মালিকদের কাছ থেকে জমি নিয়েছিলেন এবং সেসব প্লটে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই ফ্ল্যাট বিক্রি করে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছেন। পরে সেই অর্থ দিয়ে আলাদা কয়েকটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিও রয়েছে। এমনকি বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশেও স্থানান্তর করেন।"
নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, "যেসব প্রকল্প শেষ হয়েছে, সেখানে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে, ক্রেতাদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হয়েছে, এমনকি রাজউকের নকশা অনুমোদনের জন্য জাল স্বাক্ষরও ব্যবহার করা হয়েছে। আব্দুস সালাম আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে এসব কাজ করেছেন।"
ডম-ইনোর কর্তৃপক্ষ যা বলছে
এসব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য টিবিএসরে পক্ষ থেকে আব্দুস সালামের মুঠোফোনে কল করলে সেটি বন্ধ দেখায়। হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দিয়েও সাড়া মেলেনি।
কোম্পানির অ্যাসিট্যান্ট ম্যানেজার ওমর ফারুক ৩১ আগস্ট (রোববার) সন্ধ্যায় টেলিফোনে টিবিএসকে বলেন, "কোম্পানি ঝামেলার মধ্যে আছে। কোম্পানির এমডি (আব্দুস সালাম) দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। কোন দেশে রয়েছেন– সেটি জানি না। আমরা চেষ্টা করছি অ্যপার্টমেন্ট ক্রেতা ও জমির মালিকদের সাথে সমস্যা সামাধান করার। প্রতিদিনিই কিছু না কিছু ভালো সমাধান আসছে।"
ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতাদের জন্য সমাধান কী?
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম জানান, প্রতারিত ক্রেতারা বর্তমানে চলমান প্রতারণা মামলার ওপর নির্ভর করে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। এছাড়া চাইলে তারা এককভাবে বা কয়েকজন মিলে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে প্রতিকার চাইতে পারেন।
তিনি বলেন, যেসব জমির মালিক জমি দিয়েছেন ডম-ইনোকে, সেগুলো দেয়া হয়েছে সাধারণত স্থায়ী পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে। ফলে এসব সহজে বাতিল করা সম্ভব নয়। নিম্ন আদালতেও সুনির্দিষ্টভাবে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না।
তবে যেসব ক্রেতা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন, তারা রিট করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য অংশ পাওয়ার অধিকার উল্লেখ করে আদালতের কাছে প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে। আদালত চাইলে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, যদি আদালতের নির্দেশে পরিত্যক্ত প্রকল্পগুলো তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, তবে তার ভিত্তিতে আদালত ব্যবস্থা নিতে পারবে। এমনকি রিট আবেদনের মাধ্যমে বিশেষভাবে ডম-ইনোর সমস্যাগুলো সমাধানে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাবও করা যেতে পারে।