পিআর প্রত্যাখ্যান বিএনপির, চালু করার পক্ষে জামায়াতের চাপ; তীব্র মতবিরোধ

প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ব্যবস্থা প্রবর্তন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) ৩২টি দল নীতিগতভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে থাকলেও উচ্চকক্ষের সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার পিআর ব্যবস্থাকে 'বিপজ্জনক' বলে উল্লেখ করেছেন—এমন প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই বিভক্তি আরও তীব্র হয়েছে।
তবে গতকাল (২২ আগস্ট) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে তিনি স্পষ্ট করে ন যে পিআর পদ্ধতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই আছে।
তিনি বলেন, 'পিআর পদ্ধতিতে ভোটের হারে আসন নিধারিত হয়। এতে মানুষের ভোটের যথাযথ প্রতিফল হয়। আবার এ পদ্ধতিতে সরকারে অস্থিতিশীলতাও তৈরি হতে পারে।'
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আরও বলেন, 'পিআর পদ্ধতির ইতিবাচক দিকও আছে, আবার নেতিবাচক দিকও আছে। এ পদ্ধতিতে মানুষের ভোটের যথাযথ প্রতিফল হয়। অন্যদিকে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোটের হারের সামান্য তারতম্যে আসনের ক্ষেত্রে অসামান্য তফাত হতে পারে।
'এজন্য আমরা উভয় ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছি। উচ্চকক্ষে পিআর ও নিম্নকক্ষে প্রচলতি ব্যবস্থা রাখার পক্ষে আমরা বলেছি।'
লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ঐকমত্য তৈরিতে ব্যর্থতা সংস্কারকে থামিয়ে দিয়েছে। 'পিআর পদ্ধতি হলে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য ভালো হতো, কিন্তু এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি। যারা এ পদ্ধতির পক্ষে, তারাও আগে থেকে জনগণকে বোঝায়নি। জনগণের সমর্থন নিয়ে দাবিটা আদায় করতে হবে, সেই কাজটা তারা করেনি।'
তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষ এখনও পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে তেমন বোঝে না। সে কারণে এ পদ্ধতির বিরোধিতা করা রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যে মানুষ ভয় পেয়ে গেছে। অন্যদিকে অন্য দলগুলোও এ পদ্ধতির পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন আদায় করতে পারেনি।
শ্রীলঙ্কা ও নেপালের উদাহরণ টেনে আলতাফ পারভেজ বলেন, ওই দেশগুলোতে পিআর পদ্ধতি হয়েছে, সেখানে কোনো সমস্যা চলছে না। 'পিআর পদ্ধতির সুবিধা হলো ছোট দলগুলোও সংসদে চলে আসতে পারে। সব আদর্শের মানুষই পার্লামেন্টে থাকতে পারে। ফলে রাজনীতিতে অস্থিরতা কম থাকবে।'
কমিশনের খসড়া প্রস্তাব
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ চূড়ান্ত করে ১৬ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা পাঠিয়েছে। এতে প্রস্তাব করা হয়েছে, বাংলাদেশে একটি দ্বি-কক্ষ আইনসভা থাকবে, যার নিম্নকক্ষের নাম হবে জাতীয় সংসদ ও উচ্চকক্ষের নাম হবে সিনেট। উচ্চকক্ষ ১০০ সদস্য নিয়ে নিয়ে গঠিত হবে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সিনেটের আসন বণ্টন হবে এবং ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
সিনেটরদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। তবে নিম্নকক্ষ মেয়াদপূর্তির আগে ভেঙে দেওয়া হলে সিনেটও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে। সাধারণ নির্বাচনের সময় উভয় কক্ষের প্রার্থীর তালিকা একসঙ্গেই প্রকাশ করা হবে।
বিএনপি সরাসরি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে জামায়াত উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালুর দাবি করছে, আর এনসিপি শুধু উচ্চকক্ষে এ পদ্ধতি প্রয়োগের পক্ষে।
পিআর প্রত্যাখ্যান বিএনপির
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, পিআর পদ্ধতি রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও গভীর করতে পারে এবং অস্থিতিশীলতাকে উসকে দিতে পারে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ পিআর পদ্ধতি বোঝে না, যা গোপন এজেন্ডার সন্দেহ তৈরি করতে পারে।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, 'পিআর পদ্ধতি নিয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। আমরা এ প্রস্তাবে সম্মত নই।'
এর পরিবর্তে বিএনপি প্রস্তাব করেছে, সিনেটের আসন নিম্নকক্ষের ফলাফলের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। সিনেট সদস্যদের মধ্যে খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দলটির ২০২৩ সালের ৩১ দফায় বলা হয়, বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে 'উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা'প্রবর্তন করা হবে।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ বিএনপির সমমনা কয়েকটি দল সিনেটের আসন কঠোরভাবে নিম্নকক্ষের ফলাফলের ভিত্তিতে বণ্টনের দাবি জানিয়েছে এবং আনুপাতিক মনোনয়নের বিরোধিতা করেছে।
উভয় কক্ষে পিআর চায় জামায়াত
অন্যদিকে জামায়াত উভয় কক্ষেই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি করেছে। দলটি ঢাকায় বিভিন্ন সমাবেশে বলেছে, পিআর পদ্ধতি 'মানসম্মত নির্বাচন' নিশ্চিত করার পাশাপাশি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ৯১টি দেশে পিআর পদ্ধতি চালু আছে। এ ব্যবস্থা ব্যক্তির চেয়ে দলকে অগ্রাধিকার দেয় এবং অর্থের প্রভাব ও মনোনয়ন বাণিজ্য কমাবে।
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দেশব্যাপী কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি দিয়ে পিআর পদ্ধতিকে কয়েক দশকের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
কয়েকটি ইসলামপন্থি দলও উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। সম্প্রতি এ দাবিতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করে ইসলামী আন্দোলন। মহাসমাবেশে দলটি জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে ১৬ দফা ঘোষণা করে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর জামায়াত প্রথম এই বিষয়টি উত্থাপন করে।