করদাতাদের অনলাইন রিটার্নের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবের তথ্যে প্রবেশাধিকার চায় এনবিআর

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করদাতাদের অনলাইন রিটার্নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ব্যাংকের তথ্য—যেমন অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স, সুদের আয় এবং উৎসে কর্তনকৃত কর—রিয়েল-টাইমে জানার সুযোগ চাইছে। কর ফাঁকি রোধ, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া সহজ করতেই এনবিআর এই পদক্ষেপ নিতে চাইছে বলে জানান এর কর্মকর্তারা।
রাজস্ব কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান, গত ১৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগে চিঠি দিয়ে এনবিআরের এ পর্যালোচনার প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, এটি কর ফাঁকি ও ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম কমাতে সাহায্য করবে এবং গোপন হিসাব ও লেনদেনের তথ্য আড়াল করার সুযোগ কমিয়ে দেবে। তবে ব্যাংকাররা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এতে করদাতাদের গোপনীয় ব্যাংক তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, যা মানুষকে ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত করবে।
এনবিআরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টিআইএনধারী (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরধারী) রয়েছেন। এরমধ্যে গত বছর রিটার্ন দাখিল করেছেন প্রায় ৪৫ লাখ করদাতা, যার মধ্যে অনলাইনে রিটার্ন জমা পড়েছে প্রায় ১৫ লাখ। কেবল কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, এ বছর থেকে অনলাইন রিটার্ন দাখিল সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে এনবিআরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আমরা করদাতাদের সব তথ্য চাইছি না। আমরা শুধু সেই তথ্য চাইছি যা কর রিটার্নে ইতোমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। সেগুলো অনলাইন রিটার্ন ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করার প্রস্তাব দিয়েছি, যাতে করদাতারাও একই তথ্য সমন্বিতভাবে দেখতে পারেন।"
তিনি বলেন, "এটি করদাতাদের জন্যও সুবিধাজনক হবে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো উৎসে কর (টিডিএস) কর্তন করে, আর করদাতাদের ফাইল রিটার্নের সময় প্রত্যেক ব্যাংক থেকে আলাদা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়। রিয়েল-টাইম অ্যাক্সেস থাকলে রিটার্ন দাখিলের সময় এই তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইনে চলে আসবে। এতে একাধিক ব্যাংক থেকে সনদ জোগাড়ের প্রয়োজন থাকবে না।"
আরেক কর্মকর্তা জানান, "আমরা শুধু তিন ধরনের তথ্য চাইছি—সুদের আয়, উৎসে কর্তনকৃত কর এবং সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের শেষ দিনে অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স। এর বাইরে কোনো লেনদেনের তথ্য চাইছি না।" তিনি আরও বলেন, "এজন্য বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করতে হলে, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা সেটি বিবেচনা করবে।"
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "আমি এখনও এনবিআরের এমন কোনো চিঠি পাইনি, তবে এনিয়ে আলোচনা চলছে। বর্তমানে আমরা (করদাতারা) রিটার্ন দাখিলের সময় ব্যাংক স্টেটমেন্ট যুক্ত করি। এনবিআরের প্রস্তাব হচ্ছে, এসব স্টেটমেন্ট সরাসরি ব্যাংকিং সিস্টেম থেকেই সরবরাহ করা যেতে পারে, যাতে অনলাইন রিটার্ন সিস্টেমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব তথ্য যুক্ত হয়। তবে করদাতাদের সব তথ্য নয়—শুধুমাত্র যেসব তথ্য রিটার্নে সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক, সেগুলোই চাওয়া হয়েছে।"
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও- তাকে পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী গ্রাহকের ব্যাংকিং তথ্য গোপন রাখা হয়। এর ফলে এনবিআর বা অন্য কোনো সংস্থা সরাসরি কিংবা রিয়েল-টাইমে আমানতকারীর ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত তথ্যের অ্যাক্সেস পায় না। বর্তমানে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার তথ্য প্রয়োজন হলে—ব্যাংকগুলো কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাওয়ার পরেই তা সরবরাহ করে থাকে।
তবে প্রস্তাবিত নতুন রিয়েল-টাইম অ্যাক্সেস ব্যবস্থা চালু হলে কর কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট করদাতার এসব তথ্য সরাসরি সংগ্রহ করতে পারবেন।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং ফার্ম - চৌধুরী এমদাদ অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজিং পার্টনার এস. কে. জামি চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "এখানে মূল লক্ষ্যটি মনে হচ্ছে, কর ফাঁকি রোধ করা। যদি কর কর্মকর্তারা এই তিন ধরনের তথ্যের সরাসরি অ্যাক্সেস পান, তাহলে তারা অন্য তথ্যেও প্রবেশাধিকার পেতে পারেন। একবার এ ব্যবস্থা চালু হলে— ভবিষ্যতে নগদ লেনদেনও সীমিত করার উদ্যোগ নিতে পারে কর্তৃপক্ষ।"
জামি আরও বলেন, "এতে ব্যাংকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে, আর করদাতারাও হয়তো ব্যাংকে টাকা রাখতে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করবেন।" তবে তাঁর মতে, "এনবিআরের এই উদ্যোগ প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী। ব্যাংকিং লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে শুধু কর ফাঁকিই নয়, ব্যাংক খাতের নানা অনিয়মও প্রতিরোধ করা সম্ভব।"
যেভাবে কাজ করবে নতুন ব্যবস্থা
বর্তমানে টিআইএন খুলতে ব্যক্তি করদাতাকে তার এনআইডি নম্বর দিতে হয়। একই এনআইডি তথ্য দিয়ে ব্যাংক হিসাবও খোলা হয়। ফলে অনলাইন রিটার্ন ব্যবস্থা— ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হলে কোনো এনআইডির অধীনে থাকা সব অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এতে মোট আমানত, বার্ষিক সুদ আয় ও উৎসে কর্তনকৃত কর (টিডিএস) রিটার্ন ফাইলের সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে এবং করের হিসাবে এর প্রতিফলন থাকবে।
করবিশেষজ্ঞ নিজাম উদ্দিন মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, "এখন অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের সময় করদাতাকে শুধু ব্যাংকে উৎসে কর্তনকৃত করের পরিমাণ উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু তা যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে কেউ যদি কর ফাঁকির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু ব্যাংক হিসাবের তথ্য গোপন করেন বা আংশিক তথ্য দেন— তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।"
তিনি আরও বলেন, "বর্তমান নিয়মে এ ধরনের তথ্য পেতে ব্যাংকে চিঠি পাঠাতে হয়। কিন্তু বাস্তবে এভাবে লাখ লাখ করদাতার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, বিশেষত এই বছর থেকে প্রায় সব ব্যক্তি করদাতার জন্যই যখন অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। সরাসরি অ্যাক্সেসের মাধ্যমে এনবিআর সহজেই গোপন হিসাব বা তথ্য শনাক্ত করতে পারবে এবং ফাঁকফোকর রোধ করতে সক্ষম হবে।"
তিনি মনে করছেন, "এই ব্যবস্থা আসলে সৎ করদাতাদের জন্যও প্রক্রিয়াটিকে অনেক সহজ করে দেবে।"
গোপন তথ্যের অপব্যবহার নিয়ে আশঙ্কা
এদিকে ব্যাংকার ও কিছু বিশেষজ্ঞ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, করদাতাদের গোপন ব্যাংক তথ্যে সরাসরি প্রবেশাধিকার দেওয়া হলে তার অপব্যবহার হতে পারে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "যদি অন্য সংস্থাগুলো করদাতাদের ব্যাংকিং তথ্যের অ্যাক্সেস পায়, তাহলে এ তথ্য বহু হাত ঘুরে যেতে পারে, যা নতুন ঝুঁকি তৈরি করবে। এ ধরনের আশঙ্কা আমানতকারীদের নিরুৎসাহিত করতে পারে এবং ব্যাংক আমানতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।"
তিনি বলেন, "এটা শুধু কর ফাঁকি রোধের বিষয় না—প্রশ্ন হচ্ছে, সংবেদনশীল তথ্যগুলো শেয়ার করা হবে কিনা।"
বর্তমানে কর কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ব্যাংকগুলো করদাতাদের তথ্য দিয়ে থাকে, যা একটি ভালো চর্চা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) -এর সাবেক সভাপতি শাহাদাৎ হোসেনও তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এসব উদ্বেগের প্রেক্ষিতে, করদাতার গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না—এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, "আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। অন্যান্য দেশে প্রচলিত নিয়মগুলো পর্যালোচনা করার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।"
দীর্ঘমেয়াদে কর ফাঁকি প্রতিরোধে এনবিআরের পদক্ষেপের প্রশংসা করলেও শাহাদাৎ হোসেন মনে করেন, এই অ্যাক্সেস কেবল নির্দিষ্ট স্তরের অনুমোদিত এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত।