যেভাবে ট্রাম্প-মোদি 'ব্রোম্যান্স'-এর ইতি

এই তো মাত্র কয়েক মাস আগের কথা, ফেব্রুয়ারিতে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, তখন তার চোখেমুখে ছিল উচ্ছ্বাস। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফেরার সম্ভাবনায় তিনি ছিলেন উল্লসিত। আর হবেনই বা না কেন? ডোনাল্ড ট্রাম্প তো কেবল একজন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন না, তিনি ছিলেন মোদির চোখে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু, যার সঙ্গে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক গভীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক।
সেই দিন মোদি স্মৃতিচারণ করছিলেন বন্ধুত্বের সোনালী দিনগুলোর কথা। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অনুষ্ঠিত বর্ণাঢ্য 'হাউডি মোদি' সমাবেশ, যেখানে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি ভারতীয়-আমেরিকানের সামনে দুই নেতা হাতে হাত ধরে হেঁটেছিলেন। কিংবা ২০২০ সালে মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটের আহমেদাবাদে আয়োজিত 'নমস্তে ট্রাম্প' মেগা-ইভেন্ট, যেখানে লক্ষাধিক মানুষের জনসমুদ্রে ভেসেছিলেন দুই রাষ্ট্রনায়ক। মোদির আশা ছিল, আগামী দিনগুলোতেও তারা "একই উষ্ণতা, একই বিশ্বাস, একই উত্তেজনা" নিয়ে মার্কিন-ভারত সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।
কিন্তু রাজনীতির মঞ্চে নাটকীয় পট পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগে না। দৃশ্যত, সেই উষ্ণতা এখন আর নেই।
মার্কিন-ভারত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কয়েক মাস ধরে চলা আলোচনা যখন অচলাবস্থায়, ঠিক তখনই গত ৩০ জুলাই ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম 'ট্রুথ সোশ্যালে' এক পোস্ট দিলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, ভারতীয় আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছেন। এই ঘোষণার মাত্র আট ঘণ্টার ব্যবধানে, ট্রাম্প যেন ভারতের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিলেন। ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির ঘোষণা দিয়ে তিনি জানালেন, সেখানে শুল্কের হার হবে মাত্র ১৯ শতাংশ, যা ভারতের চেয়েও কম।
এরপর থেকেই উত্তেজনার পারদ কেবলই চড়তে থাকে। ট্রাম্প একধাপ এগিয়ে ভারতের অর্থনীতিকে 'মৃত' বলে আখ্যা দেন এবং গত সোমবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভারতের ওপর শুল্ক 'উল্লেখযোগ্যভাবে' বাড়ানো হবে। বুধবার সেই সংখ্যাটিও প্রকাশ করা হয়: ৫০ শতাংশ! এটি বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত সর্বোচ্চ শুল্কহারগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা নয়াদিল্লির জন্য এক বিরাট ধাক্কা।
কিন্তু হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ কী?
যদি ট্রাম্পের সামাজিক মাধ্যমের পোস্টগুলোকেই কারণ হিসেবে ধরা হয়, তবে এর সহজ উত্তর হলো—রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা। ভারত বিপুল পরিমাণে রুশ তেল আমদানি করে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ভারতীয় উৎপাদকরা রাশিয়াকে যন্ত্রাংশ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে, এমন অভিযোগ ওয়াশিংটনের।
কিন্তু এই যুক্তিটিও বড় ঠুনকো। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসন যে অন্য অনেক দেশকে রাশিয়া থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে, তা ভারতীয় কর্মকর্তারা বারবার তুলে ধরেছেন। যেমন, ভারতের চেয়েও বেশি পরিমাণ অপরিশোধিত তেল ও তেলজাত পণ্য রাশিয়া থেকে কেনে চীন। অথচ ভারতের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপের ঠিক একদিন আগেই সেই চীনকে বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার জন্য বাড়তি সময় দেওয়া হয়। এমনকি, খোদ রাশিয়ার ওপর মার্কিন শুল্কের হার মাত্র ১০ শতাংশ!
তাছাড়া, ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই কাজ করেছে, যা এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার তেল কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু মূল সমস্যা ছিল, ইউরোপ তখনও রাশিয়ার জ্বালানির ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল ছিল। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই নীরব সমর্থনে ভারত সস্তায় রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কিনে, তা প্রক্রিয়াজাত করে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করে। এর ফলে ইউরোপ নিজেদের নিষেধাজ্ঞা সরাসরি লঙ্ঘন না করেও জ্বালানি সংকট এড়াতে পেরেছিল।
কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো অ্যাশলি টেলিস যেমনটা বলছিলেন, "ভারতের রাশিয়ান তেল কেনাটা এই খেলার একাধিক পক্ষকেই সন্তুষ্ট করেছিল। কিন্তু সেসব এখন পুরোনো ইতিহাস। কারণ আমরা আমাদের নীতি পরিবর্তন করেছি। ভারত আগে যা কোনো শাস্তি ছাড়াই করতে পারত, তা এখন এই প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের বাইরেও এই নাটকীয় পরিবর্তনের পেছনে ব্যক্তিগত রেষারেষি বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের পর নয়াদিল্লির আচরণে ট্রাম্প যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ, যুদ্ধবিরতিতে তার মধ্যস্থতার ভূমিকাকে ভারত প্রকাশ্যে স্বীকার করতে অস্বীকার করে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মুখিয়ে থাকা ট্রাম্প ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের অবসান ঘটানোকে এই পুরস্কার পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বারবার উল্লেখ করেছেন।
অ্যাশলি টেলিস বলেন, "ভারত-পাকিস্তান সংকট যেভাবে শেষ হয়েছিল, তাতে ট্রাম্পের মনে একটা তিক্ততা রয়ে যায়। তিনি ভেবেছিলেন, তার হস্তক্ষেপের জন্য ভারতীয়দের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তার বদলে তারা উল্টো তার ভূমিকা নিয়েই সমালোচনা শুরু করে। আমার মনে হয়, সেই সময় থেকেই তিনি ভারতের দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করেন।"
ট্রাম্পের এই বিরক্তিই যেন হোয়াইট হাউসের ভারত-বিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য পোয়াবারো হয়েছে। ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোর মতো কট্টর ডানপন্থীরা ভারতের সংরক্ষণশীল অর্থনীতি ও উচ্চ বাণিজ্য বাধা নিয়ে তাদের পুরোনো অভিযোগগুলো সামনে নিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছেন। আবার, ট্রাম্পের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ স্টিফেন মিলারের মতো অভিবাসন-বিরোধীরাও ভারতকে নিশানা করেছে, কারণ দক্ষ কর্মীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেওয়া এইচ-ওয়ানবি ভিসা প্রোগ্রামের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হলো ভারত।
দেশের ভেতর উভয় সংকটে মোদি
ওয়াশিংটনের এই চাপে নিজ দেশে মোদি সরকার পড়েছে উভয় সংকটে। মার্কিন শুল্কের বোঝা থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো একটি বাণিজ্য চুক্তি করা। কিন্তু তা করতে গিয়ে মোদিকে দেশের ভেতর কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রধান দাবি হলো, মার্কিন কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য ভারতের বাজার খুলে দিতে হবে। কিন্তু মোদির জন্য দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হলো, দেশের কৃষি ও দুগ্ধ শিল্প ভারতের রাজনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়। এই দুটি খাতকে সুরক্ষা দেওয়া বাণিজ্য বাধা শিথিল করার যেকোনো প্রচেষ্টা পরবর্তী নির্বাচনে হেরে যাওয়ার একটি নিশ্চিত উপায়।
ভারতের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫ শতাংশই কৃষক, এবং তারা মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জন্য এক ভোটব্যাংক। ২০২০ সালের ঘটনা এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সে সময় তার সরকার বিতর্কিত কৃষি আইন পাস করলে কৃষকদের আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কায় উত্তর ভারতজুড়ে কৃষকরা ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৬ মাস ধরে চলা হাইওয়ে অবরোধ এবং রাজ্য পর্যায়ের নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের পর সরকার শেষ পর্যন্ত সেই আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল।
একইভাবে, মার্কিন দুগ্ধজাত পণ্য আমদানিও ভারতের জন্য একটি অসম্ভব বিষয়। কারণ, কিছু মার্কিন গরুকে পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি খাবার খাওয়ানো হয়, যা ভারতের ৮০ শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের পরিপন্থী।
যদিও ভারতের বিরোধী দলগুলো ট্রাম্পকে পছন্দ করে না—বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী এই শুল্ককে "অর্থনৈতিক ব্ল্যাকমেইল" বলেছেন—তারা জানে যে, মোদি যদি কৃষি বা দুগ্ধ খাতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেন, তবে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ তারাই পাবে। বিরোধী কংগ্রেস দলের সদস্য মণীশ তেওয়ারি যেমনটা বলেছেন, "এই জবরদস্তি এবং গুণ্ডামির বিরুদ্ধে সরকারের উচিত সোজা হয়ে দাঁড়ানো এবং কিছুটা মেরুদণ্ড দেখানো।"
আপাতদৃষ্টিতে, মোদি চাপের মুখে নত না হওয়ার নীতি নিয়েছেন। ২ আগস্ট এক সমাবেশে তিনি ট্রাম্পের নাম না নিয়ে মার্কিন শুল্কের দিকে ইঙ্গিত করে "ভোকাল ফর লোকাল" (স্থানীয় পণ্যের জন্য সোচ্চার হোন) স্লোগান দেন এবং নাগরিকদের "ভারতীয়দের ঘামে তৈরি" দেশীয় পণ্য কেনার আহ্বান জানান।
কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে এমন প্রতিবাদী কথার দাম কম। ২০২০ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের পর মোদি চীনা আমদানি বয়কট করে "আত্মনির্ভর ভারত" গড়ার ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চীন থেকে ভারতীয় আমদানি ২০২০ সালের ৬৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ১১৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত মোদিকে হয়তো রাশিয়ার তেলের প্রশ্নে নতি স্বীকার করতে হতে পারে। এর কারণ এটা নয় যে, ভারত রাশিয়াকে অর্থায়ন করছে বলে ট্রাম্প খুব চিন্তিত, বরং নয়াদিল্লি যে মাথা নোয়াতে ইচ্ছুক, সেই সংকেত দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য।
এই শুল্কের ধাক্কায় ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। কিন্তু তার চেয়েও বড় ক্ষতি হতে পারে কয়েক দশক ধরে অনেক কষ্টে গড়া মার্কিন-ভারত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত "জোট নিরপেক্ষ" নীতি অনুসরণ করে এসেছে। তবে ২০০৮ সালে বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে মার্কিন প্রশাসনগুলো ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত প্রতিরোধ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এই কৌশলগত সম্পর্ক এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, বাণিজ্য বা মেধাস্বত্বের মতো বিষয়গুলো দিয়ে একে প্রভাবিত হতে দেওয়া হয়নি।
কিন্তু ট্রাম্পের কাছে সেই দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত প্রতিযোগিতার কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না। তিনি ভারতকে তার প্রতিরক্ষা স্বার্থ এবং সংরক্ষণশীল বাণিজ্য নীতির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করছেন। টেলিসের মতে, ট্রাম্পের এই ভারত নীতি "সত্যিই অবোধ্য" এবং "এটি প্রেসিডেন্টের আরেকটি খুব ব্যয়বহুল খামখেয়ালিপনা হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে, যার জন্য শেষ পর্যন্ত দেশকেই মূল্য দিতে হবে।"
ট্রাম্প-মোদির পুরনো সেই মধুর সম্পর্কে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা এখন প্রায় শূন্য। এর পরিবর্তে, ভারত এখন রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর করার পথে হাঁটছে। মোদি এরই মধ্যে তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে মস্কোতে পাঠিয়েছেন এবং সাত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সেপ্টেম্বরে চীন সফরের ঘোষণা দিয়েছেন।
শুক্রবার এক জনসভায় মোদির কথাতেই যেন এই নতুন বাস্তবতার প্রতিধ্বনি শোনা গেল। তিনি বলেন, ট্রাম্পের কাছে নতি স্বীকার না করার জন্য "আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে। কিন্তু আমি এর জন্য প্রস্তুত।"
তার এই কথাই হয়তো বলে দিচ্ছে, ট্রাম্প-মোদি ব্রোম্যান্স যুগের সত্যিই অবসান হতে চলেছে।