গাজীপুরে সাংবাদিককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা, আটক ৫

গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি মার্কেটের ভেতর প্রকাশ্যে এক সাংবাদিককে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ জনকে আটক করেছে।
নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন (৩৮) দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীন খান জানান, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাসন থানায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি মামলার বাদী হয়েছেন তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম। অপর মামলার বাদী তুহিন হত্যার আগে সংঘটিত আরেকটি হামলার ঘটনায় আহত বাদশা মিয়ার ভাই।
তিনি আরও বলেন, 'এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে যাচাই করা হচ্ছে। উক্ত ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদেরকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে।'
পুলিশ ও স্থানীয়রা বলেন, চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় মসজিদ মার্কেটে তুহিনের অফিস রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তার অফিসের নিচে এক মহিলার সাথে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে কতিপয় সন্ত্রাসী বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে এবং তাকে তাড়া করে। তুহিন তখন এ ঘটনার ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিও ধারণ করার বিষয়টি হামলাকারীরা দেখে ফেললে তারা তুহিনকেও তাড়া করে। একপর্যায়ে তুহিন তার অফিসের নিচে একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলে সন্ত্রাসীরা তাকে সেখান থেকে টেনে বাইরে এনে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
পরে পুলিশ আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। একটি ফুটেজে দেখা যায়, মসজিদ মার্কেটের একটি জায়গায় ভিড়ের মধ্যে একজন পুরুষ এক নারীকে ধাক্কা দেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ৪-৫ জন সশস্ত্র লোক ওই ব্যক্তিকে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকেন। ভুক্তভোগী দৌড় দিলে তাকে ধাওয়া করা হয়। হামলাকারীদের হাতে রামদা, বড় ছুরি, চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ছিল। ফুটেজের শেষ পর্যায়ে উপস্থিত লোকজনকে একটা নির্দিষ্ট ভিড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, ওই ফুটেজের বাইরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। উৎসুক জনতা সেদিকেই তাকিয়ে ছিল।
এ বিষয়ে জিএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) রবিউল ইসলাম বলেন, 'প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দা তথ্য এবং প্রাপ্ত সিসিটিভির ফুটেজ থেকে দেখা যায়, একজন নারীকে দিয়ে ফাঁদ পেতে এক ব্যক্তির সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ানোর একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা ওই ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে এবং তাড়া করে। সাংবাদিক তুহিন এ ঘটনার দেখে ফেলেন এবং ভিডিও ধারণ করেন।'
তিনি আরও বলেন, 'ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ঘটনাস্থল চান্দনা চৌরাস্তা মসজিদ মার্কেটের পশ্চিম পাশে। সময় গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিট। কালো রঙের জামা পরা এক নারী হেঁটে যাচ্ছেন। পেছন দিক থেকে নীল রঙের জামা পরা এক ব্যক্তি ওই নারীকে পেছন দিক থেকে টেনে ধরেন। নারী জোর করে চলে যেতে চাইলে তার সামনে গিয়ে গতি রোধ করেন ওই ব্যক্তি। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি নারীকে চড়থাপ্পড় মারেন। এমন সময় পাশ থেকে ধারালো অস্ত্র হাতে কয়েকজন যুবক ওই ব্যক্তিকে কোপানোর চেষ্টা করেন। নীল শার্ট পরা ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালিয়ে যান। তখন এ ঘটনা নিজের মোবাইলে ধারণ করেন সাংবাদিক তুহিন। ভিডিও করাকে কেন্দ্র করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে।'
রবিউল বলেন, 'সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সন্ত্রাসীদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না। তাদেরকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলমান রয়েছে।'
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও তুহিনের সহকর্মী শামীম হোসেন বলেন, 'ঘটনার কিছুক্ষন আগে তুহিন আমাকে ফোন করে। আমি অফিসে মোবাইল চার্জ দিচ্ছি জানাই। এর কিছুক্ষণ পরে মসজিদ মার্কেটে এক নারী ও পুরুষ মারামারি করছিলেন। পরে কতিপয় পুরুষ লোকটিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালানো চেষ্টা করলে সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাকে ধাওয়া করে। তখন তুহিন মুঠোফোন বের করে ধাওয়া করার ঘটনা ভিডিও করতে তাদের পেছনে দৌড় দেন। সন্ত্রাসীরা এ বিষয়টি দেখে ফেলে তুহিনকে ধাওয়া করে। তখন তুহিন দৌড়ে চায়ের দোকানে ঢুকে যান। ঠিক ওই মুহূর্তে তারাও চায়ের দোকানে ঢুকে ওকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। আমি চৌরাস্তা এলাকায় পুলিশের গাড়ি খুঁজতে থাকি। কোনো গাড়ি দেখতে না পেয়ে বাসন থানার ওসিকে ফোন করি। কিছু সময় পর পুলিশ আসে।'
স্থানীয়দের অভিযোগ, সিসিটিভির ফুটেজে যেসব সন্ত্রাসীদের দেখা গেছে, তারা সবাই ছিনতাইকারী দলের সদস্য। ভিডিওতে যে নারীকে দেখা গেছে, তিনিও ছিনতাইকারী চক্রের সাথে জড়িত। একটি সূত্রের দাবি, ফুটেজে যাদের দেখা গেছে, তাদের সবাই এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী।
সিসিটিভি ফুটেজে নারীর সঙ্গে যে ব্যক্তির ধস্তাধস্তি হয়েছিল তার নাম বাদশা মিয়া। তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি দাবি করেন, 'ওই মেয়েরা একটি দল। ওরা আমার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। আমি তাদের চিনতাম না।'
শুক্রবার সকালে হাসপাতালে মর্গের সামনে লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম ও পরিবারের সদস্যরা।
সেলিম বলেন, 'তুহিনের স্ত্রী আর দুই ছেলে অভিভাবক হারাল। আমার ভাইকে কেন হত্যা করা হলো? এখন তাদের দায়িত্ব কে নেবে?' তিনি এ হত্যার বিচার ও আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।