বেনাপোলে 'লাগেজ পার্টি'র দৌরাত্ম্য: বিজনেস ভিসায় আসা ভারতীয়রা বিক্রি করছে পণ্য

যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে ভারতীয় যাত্রীরা বিজনেস ভিসার [ব্যবসায় ভিসা] অপব্যবহার করে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের পণ্য বাংলাদেশে এনে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, এসব যাত্রী বিনা শুল্কে অবৈধভাবে পণ্য দেশে ঢোকাচ্ছেন, যার ফলে দেশীয় শিল্প পড়েছে চাপে। একই সঙ্গে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
সরেজমিনে চেকপোস্টে গিয়ে দেখা যায়, এসব ভারতীয় যাত্রী কম্বল, মোবাইল, বিদেশি মদ, বিয়ার, শাড়ি, থ্রি-পিস, চকলেট, ফুচকা, তৈরি পোশাক ও কসমেটিকসসহ নানা পণ্য নিয়ে আসছেন এবং সেগুলো স্থানীয় দোকানে বিক্রি করছেন। স্থানীয়ভাবে তারা পরিচিত 'ল্যাগেজ পার্টি' হিসেবে।
সাধারণ যাত্রীরা বেনাপোল দিয়ে যাতায়াতের সময় ব্যাগেজ স্ক্যানিং বা তল্লাশির নামে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হলেও ভারতীয় 'ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরা' অনায়াসে প্রবেশ করছেন বলে অভিযোগ। বর্তমানে দুটি স্ক্যানিং মেশিনে চেকিংয়ের পাশাপাশি চারটি পয়েন্টে ব্যাগেজ তল্লাশি চালান কর্মকর্তারা। যাত্রীরা জানান, ব্যাগপ্রতি টাকা না দিলে মালামাল আটকে রাখা হয়। অথচ ভারতীয় ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরা অবাধে মালামাল নিয়ে প্রবেশ করলেও কোনো চেকিং করা হয়না।
বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাসেল মিয়া বলেন, 'ভারতীয় যাত্রীরা বৈধ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। তারা কী আনছেন, তা কাস্টমস ও বিজিবি দেখছে। আমাদের সেখানে সরাসরি চেকিংয়ের সুযোগ নেই। তবে গোপন তথ্য পেলে পুলিশ অভিযান চালায়।'
বেনাপোল ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশিদের ট্যুরিস্ট ও বিজনেস ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে ভারত সরকার। আপাতত মেডিকেল ভিসা ছাড়া অন্য কোনো ভিসা মিলছে না। অথচ প্রতিদিন ভারতীয়দের শত শত বিজনেস ভিসা দিচ্ছেন কলকাতার বাংলাদেশি উপ-হাইকমিশনার।
গেল এক মাসে ২৫ হাজার ৬৭৮ জন ভারতীয় পাসপোর্টধারী বেনাপোল দিয়ে যাতায়াত করেছেন। এর মধ্যে প্রায় ২৪ হাজার যাত্রী বিজনেস ভিসায় এসে লাগেজভর্তি পণ্য এনেছেন।
এসব যাত্রী বিজনেস ভিসায় সকালে বেনাপোল আসছেন। আবার বিকেলে ফিরে যাচ্ছেন। বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনে এ দৃশ্য প্রতিদিনের।
স্থানীয়রা জানান, যশোর, খুলনাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত নারী-পুরুষ এসব পণ্য কিনতে বেনাপোল আসেন। দুই দেশের প্রশাসনের একাংশের সহযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরেই এ চোরাচালান চালু রয়েছে। এতে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সরকারের রাজস্ব হারানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
চেকপোস্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় হাইকমিশন বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা কমিয়ে দেওয়ায় ভারতে যাওয়া যাত্রী সংখ্যা অনেকটা কমেছে। অথচ প্রতিদিন ভারত থেকে ৫০০ থেকে ৭০০ জন নাগরিক বিজনেস ভিসায় পাসপোর্ট দেখিয়ে বেনাপোল দিয়ে দেশে প্রবেশ করছেন। এসব ভিসা ইস্যু করছে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন। যাত্রীদের বড় একটি অংশ কম্বলসহ নানা চোরাচালানপণ্য আনার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, ভারতের বনগাঁ, অশোকনগর, হাবড়া, হরিদাসপুর, জয়ন্তীপুর ও পেট্রাপোল এলাকার একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট বেনাপোল সীমান্তে সক্রিয়। তারা প্রতিদিন কয়েকটি ব্যাগভর্তি পণ্য নিয়ে আসেন, যা চোরাচালানপন্থায় বেনাপোলের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করা হয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসব নারী-পুরুষ আবার ভারতে ফিরে যান। বিজনেস ভিসা থাকায় তাদের যাতায়াতে কোনো বাধা পড়ে না। পুরো কার্যক্রমে দুই দেশের কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশের সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, চেকপোস্টে লাগেজ পার্টির যাত্রীদের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে ব্যাগপ্রতি টাকা নেওয়া হয় বিভিন্ন সংস্থার কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে এসব কর্মকাণ্ড চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তাদের সহায়তায় প্রতিদিন শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য দেশে প্রবেশ করছে।
অন্যদিকে সাধারণ যাত্রীরা চেকপোস্টে নানা হয়রানির শিকার হন। দুটি স্ক্যানিং মেশিনে চেকিংয়ের পাশাপাশি চার জায়গায় অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যাগ তল্লাশি হয়। যাত্রীরা অভিযোগ করেন, টাকা না দিলে ব্যবহারের জন্য আনা মালামাল কাস্টমসে জমা দিতে হয়। সেখানে লাগেজ পার্টির সদস্যরা অনায়াসে তাদের পণ্য নিয়ে চলে যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমসের এক কর্মকর্তা বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। পাসপোর্টধারী যাত্রীদের কোনো হয়রানির অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। লাগেজ পার্টি বন্ধে আমরা প্রতিনিয়ত চেকপোস্টে মালামাল ডিএমের মাধ্যমে আটক করছি। সেটা পরে যাত্রীরা কাস্টমস হাউজ থেকে শুল্ক দিয়ে ছাড় করে নিচ্ছেন।'
এ প্রসঙ্গে যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, 'সীমান্তে চোরাচালান ঠেকাতে বিজিবি দিন-রাত কাজ করছে। প্রতিদিনই আমরা বিপুল পরিমাণ অবৈধ পণ্য আটক করছি। পাশাপাশি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযানও চালানো হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় পণ্য প্রবেশ করলে দেশীয় শিল্প হুমকির মুখে পড়ে এবং সরকার রাজস্ব হারায়। এই প্রবণতা ঠেকাতে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি।'
বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, 'শুল্ক ফাঁকি রোধে আমরা সবসময় সতর্ক। অবৈধ পণ্য পেলে তা জব্দ করা হয়। যদি কোনো কাস্টমস কর্মকর্তা ল্যাগেজ পার্টির সহায়তা করেন, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'