বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল ভিত্তি এখনো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত: অর্থ উপদেষ্টা

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল ভিত্তি এখনো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত।
তিনি বলেন, 'এ খাতের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানও হয়। সামনের দিনে এই খাতের সম্ভাবনাও অনেক বেশি। সেজন্য এ খাতের অর্থায়ন সমস্যা দুর, প্রযুক্তিগত সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা ও আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সংযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।'
আজ বুধবার (২ জুলাই) রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে আয়োজিত এসএমই ফাউন্ডেশন-ইআরএফ মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ফাউন্ডেশন এর চেয়ারপার্সন মুশফিকুর রহমান। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। এ সময় ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও ইআরএফ সভাপতি দৌলত আক্তার মালা বক্তব্য রাখেন।
এসএমই খাত নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টিং এর জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে ২১ জন সংবাদকর্মীকে অনুষ্ঠানে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'বাংলাদেশের গ্রোথ নিয়ে অনেক ন্যারেটিভ আছে। তবে এখনো মূল ভিত্তি এসএমই। কর্মসংস্থানের বেলায়ও এসএমই এগিয়ে। তবে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২৬ শতাংশ এটি পর্যাপ্ত না।'
তিনি বলেন, 'অন্যান্য অনেক দেশের ৬০ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে। বলা হয়, উন্নত দেশের শিল্প অনেক বড় কিন্তু আসলে তা নয়।'
উপদেষ্টা বলেন, 'এসএমইকে এগিয়ে নিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। হাতুড়ি-বাটালের দিন শেষ হয়ে গেছে। যদিও কিছু কিছু এসএমএস প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কিন্তু এর ব্যবহার আরো বাড়াতে হবে।'
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, 'এসএমই খাতের সম্ভাবনা অনেক। এখাতের একটি মেজর রোল রয়েছে যে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ বেশি। নারীর স্বাধীনতা, অংশগ্রহণ বাড়ানো মানে শুধু কথা বলা নয়, নারীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা। সেটি এসএমই খাতের মাধ্যমে হচ্ছে।'
এসএমই খাতের অর্থায়ন সমস্যা স্বীকার করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'এ খাতের অর্থায়নে বড় সমস্যা রয়েছে। ব্যাংকাররা এসএমই খাত নিয়ে ভাবেন না। তারা বড় ঋণ দিতে চান। ১০ কোটি টাকার ঋণ দিয়ে দিলেন, আদায় হলো কি হলো না সেটি তাদের ব্যাপার না। ব্যাংকারদের এবং পলিসি মেকার এ নিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হবে।'
তিনি বলেন,'এসএমই নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রি-ফিন্যান্স স্কীম আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে এই স্কীমটি বাড়াতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় সেক্ষেত্রে সহায়তা করবে। জ্বালানিতে ৬০ থেকে ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এসএমইতে কিছু ভর্তুকি দিলে অসুবিধা কি?'
অর্থ উপদেষ্টা এসএমই খাতের ডিজিটাল তথ্যভান্ডার গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। সেজন্য প্রয়োজন হলে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থায়ন করা হবে বলেও জানান তিনি। তিনি জানিয়েছেন, বিদেশি উদ্যোক্তারা এখন ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার চান।
এসএমই ফাউন্ডেশনের অর্থায়ন করার সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য তিনি পিকেএসএফের মত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, 'ভালোভাবে প্রজেক্ট নেন, কর্মকর্তা ঠিক করেন। পিকেএসএফকে বিশ্ব ব্যাংক, আইএফএডি সকলেই অর্থায়ন করে। পিকেএসএফ এখন বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান, সকল দাতা সংস্থা এগিয়ে আসছে। এজন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা রাখতে হবে, কোন ধরনের কম্প্রোমাইজ করা যাবে না।'
তিনি বলেন, 'এসএমই খাতকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সংযুক্ত করে দিতে হবে। কারণ আমাদের রপ্তানিতে বহুমুখীকরণ দরকার। শুধু নির্ভর করে আর চলবে না।'
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ডিসেম্বরের মধ্যে আর্থিক খাতে কিছু রিফর্ম করা হবে। পলিটিক্যাল রিফর্ম কি হবে সেটা জানিনা। ব্যাংক খাতে রিফর্ম কিছু হবে। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। সেজন্য বাজেটে ২,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে; যদিও তা অপ্রতুল। আমরা শুরু করে যাবে। আশা করি পরের সরকার এসে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে।'
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মুশফিকুর রহমান বলেন, 'ফাউন্ডেশনের বড় সমস্যা সক্ষমতার অভাব। উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী ফাউন্ডেশন অর্থায়ন করতে পারে না। দেশে এক কোটি ১৮ লাখ এসএমই উদ্যোক্তা থাকলেও এসএমই ফাউন্ডেশন অর্থায়ন করেছে মাত্র ১১ হাজার উদ্যোক্তাকে। কিন্তু এসএমই খাতির উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধ খুবই ভালো। এখাতে রিকভারি রেট ৯৯ শতাংশের বেশি।'
তিনি এসএমই ফাউন্ডেশনের তহবিল বাড়ানোর জন্য অর্থ উপদেষ্টাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন।
এসএমএস ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, '২০০৬ সালে যখন এসএমই ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করেছিল তখন ২০০ কোটি টাকা তহবিল দেওয়া হয়েছিল। এরপর সরকার আরো ৩০০ কোটি টাকার তহবিল দিয়েছে। এই ৫০০ কোটি টাকা কোন পুনঃঅর্থায়ন স্কিম এর মাধ্যমে পরিচালনা করে এ পর্যন্ত ১১ হাজার উদ্যোক্তাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে।'
এসএমই খাতকে এগিয়ে নিতে না পারলে অর্থনীতির অগ্রগতির যে লক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি অর্জন সহজ হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এসএমই ফাউন্ডেশনের নিজস্ব কার্যালয় নেই, নিজস্ব কার্যালয় দরকার। দরকার ইনকিউবেশন সেন্টার, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও প্রদর্শনী কেন্দ্র। এজন্য একটি জায়গা হলে এসএমই ফাউন্ডেশনের জন্য ভালো হয় উল্লেখ করে তিনি অর্থ উপদেষ্টাকে সহযোগিতার অনুরোধ করেন।'
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'সাংবাদিকদের নেতিবাচক রিপোর্টিং এর কারণে নানান রকমের সমস্যায় পড়তে হয়। আধা গ্লাস পানিকে ভর্তি না বলে সাংবাদিকরা আগেই খালি বলে থাকেন। আপনারা সমালোচনা করবেন সেটা ঠিক আছে করুন, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করুন।'
এ সময় অর্থ উপদেষ্টা উদাহরণ দিয়ে বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিষয়ে 'নেতিবাচক' রিপোর্টিং এর কারণে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফকে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, 'রিপোর্টিং হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মীরা সরকারের সিদ্ধান্ত মানছে না বিধায় সরকার সংস্থাটি দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে। এরপর আইএমএফ বলেছে যে ফাইন্যান্স এডভাইজরকে লিখিতভাবে জানাতে হবে যে এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার বাস্তবায়ন করবে। পরে আমাকে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে।'
বাজেট ছোট হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'আগের সরকারের প্রকল্পে অনেক অপচয় ও অহেতুক ব্যয় ছিল। আমরা চেষ্টা করেছি অপচয় কমিয়ে নিয়ে আসার জন্য। যে কারণে বাজেট ছোট হয়েছে।'