রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে বিশ্বে শীর্ষে ভারত, কিন্তু ট্রাম্পের করারোপে খেতে পারে বড় ধাক্কা, ঝুঁকিতে বাংলাদেশও

যুক্তরাষ্ট্রে প্রস্তাবিত একটি নতুন বিলের আওতায় বিদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর কর আরোপের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের কর চালু হলে ভারতের মতো শীর্ষ রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশসহ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মেক্সিকো ও ফিলিপাইনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। খবর বিবিসি'র।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশালাকৃতির 'ওয়ান, বিগ, বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট'-এর একটি ধারা নীরবে বিদেশে পাঠানো অর্থ থেকে কোটি কোটি ডলার কেটে নেওয়ার পথ খুলে দিতে পারে।
প্রস্তাবিত এই ধারায় বলা হয়েছে, বিদেশি শ্রমিকরা—যাদের মধ্যে গ্রিন কার্ডধারী এবং এইচ-১বি ভিসাধারী অস্থায়ী কর্মীরাও রয়েছেন—যখন দেশে টাকা পাঠাবেন, তখন সেটির ওপর ৩.৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে।
২০২৩ সালে প্রবাসী ভারতীয়রা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১১৯ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতের পণ্য বাণিজ্য ঘাটতির অর্ধেক মেটাতে যথেষ্ট এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকে ছাপিয়ে গেছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) অর্থনীতিবিদদের একটি প্রবন্ধে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এই অর্থের সবচেয়ে বড় অংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
রেমিট্যান্সের ওপর হঠাৎ কোনো কঠোর কর আরোপ করা হলে অভিবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার কেটে নেওয়া হতে পারে—যাদের অনেকে ইতোমধ্যেই আমেরিকায় কর দেন। এর ফলে বেড়ে যেতে পারে অনানুষ্ঠানিকতা, নজরদারির বাইরে থাকা নগদ লেনদেন এবং ভারতের সবচেয়ে স্থিতিশীল বৈদেশিক অর্থের উৎসটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে প্রবাসী আয়ে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে ভারত। ২০০১ সালে বিশ্বের মোট প্রবাসী আয়ের ১১ শতাংশ ভারতের ছিল, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশে।
ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, প্রবাসী আয়ের প্রবণতা আগামী বছরগুলোতেও শক্তিশালী থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৯ সালের মধ্যে এ আয় বেড়ে ১৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
২০০০ সাল থেকে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৩ শতাংশই এসেছে প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে—এ হার দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা ১৯৯০ সালের ৬৬ লাখ থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৮৫ লাখে। বৈশ্বিক অভিবাসীদের মধ্যে ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যাও বেড়েছে—১৯৯০ সালে যা ছিল ৪.৩ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৬ শতাংশের ওপরে উঠেছে।
যদিও এখনো ভারতের প্রায় অর্ধেক প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থান করছেন, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নত দেশগুলো—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রমুখী দক্ষ পেশাজীবী অভিবাসনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এর পেছনে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বৈশ্বিক প্রভাবকে একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্সের শীর্ষ উৎস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০২০–২১ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব যেখানে ছিল ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশে।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে দেশটিতে কর্মসংস্থানের দ্রুত পুনরুদ্ধার এবং ২০২২ সালে বিদেশে জন্ম নেওয়া কর্মীর সংখ্যা ৬ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে যাওয়াই এ বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ভারতীয় অভিবাসীদের ৭৮ শতাংশই ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা, বিজ্ঞান ও শিল্পকলা—এ ধরনের উচ্চআয়ের পেশায় নিয়োজিত।
রেমিট্যান্স পাঠাতে গৃহীত ফি এবং মুদ্রা রূপান্তরের খরচ দীর্ঘদিন ধরেই বৈশ্বিক নীতিনির্ধারকদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে, কারণ এর সরাসরি প্রভাব পড়ে প্রবাসীদের পরিবারে। বৈশ্বিক গড় ব্যয় এখনও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি থাকলেও, রেমিট্যান্স গ্রহণে ভারতের অবস্থান ব্যতিক্রম। খরচের দিক থেকে দেশটি এখন অন্যতম সাশ্রয়ী গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে ডিজিটাল চ্যানেলের প্রসার ও বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি।
দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই)-এর অজয় শ্রীবাস্তবের মতে, রেমিট্যান্সে ১০-১৫ শতাংশ হ্রাস ঘটলে ভারত বছরে ১২ থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হারাতে পারে। এতে ডলারের সরবরাহ সংকুচিত হবে এবং রুপি আরও চাপে পড়বে। তিনি মনে করেন, মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ ব্যাংককে আরও ঘন ঘন হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে।
তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা লাগবে কেরালা, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার প্রভৃতি রাজ্যের পরিবারগুলোতে—যেখানে রেমিট্যান্সই শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসনের মতো মৌলিক খরচের যোগান দেয়।
অজয় শ্রীবাস্তব এক বিবৃতিতে বলেন, এই কর 'পরিবারগুলোর ভোক্তা ব্যয়ে বড় রকমের আঘাত হানতে পারে', বিশেষ করে এমন সময়ে যখন ভারতীয় অর্থনীতি বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও মুদ্রাস্ফীতির চাপে দিশেহারা।
ভারতের ঘরোয়া বাজেটে চাপ সৃষ্টি করতে পারে রেমিট্যান্স কর—ভোগব্যয় ও বিনিয়োগে এর প্রভাব পড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম স্থিতিশীল উৎসও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে দিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাংক 'সেন্টার ফর ডব্লিউটিও স্টাডিজ'। প্রতিষ্ঠানটির এক সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
ভারতের রেমিটেন্সপ্রাপ্ত রাজ্যগুলোর তালিকায় এখনও শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র। এরপর রয়েছে কেরালা ও তামিলনাড়ু।
ভারতে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ প্রধানত ব্যয় হয় পরিবারের ভোগব্যয়, সঞ্চয় এবং বাড়ি, সোনা ও ক্ষুদ্র ব্যবসার মতো সম্পদে বিনিয়োগে—এ তথ্য উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির প্রীতম ব্যানার্জি, সপ্তর্ষি মণ্ডল ও দিব্যাংশ দুয়ার যৌথভাবে রচিত নীতিনির্ধারণ-সংক্রান্ত এক সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে।
রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে এলে দেশের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় হ্রাস পেতে পারে এবং আর্থিক ও বাস্তব সম্পদ—দুই ধরনের বিনিয়োগেই বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমলে পরিবারগুলো সাধারণত 'সঞ্চয় ও বিনিয়োগের চেয়ে ভোগের চাহিদা—যেমন খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা—অগ্রাধিকার দেয়।'
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক 'সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট'-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত এই কর প্রবাসীদের বৈধ পন্থায় দেশে অর্থ পাঠানো (ফরমাল ট্রান্সফার) উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে পারে। এতে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে মেক্সিকো। প্রতি বছর দেশটির লোকসান হতে পারে ২৬০ কোটি ডলারের বেশি।
এছাড়া, ভারত, চীন, ভিয়েতনাম এবং গুয়াতেমালা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র ও এল সালভাদরের মতো লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশও বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হতে পারে।
তবে এখনো এই কর সংক্রান্ত কিছু বিষয় পরিষ্কার নয়। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এটি সিনেটের অনুমোদন এবং প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের অভিবাসন ও রেমিটেন্স বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. দিলীপ রাঠা বিবিসিকে বলেন, 'এই কর সব বিদেশির ওপরই প্রযোজ্য হবে—এমনকি দূতাবাস, জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের কর্মীদের ওপরও। তবে যারা কর পরিশোধ করেন, তারা কর রিটার্নের সময় ট্যাক্স ক্রেডিট দাবি করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে এই রেমিটেন্স কর কেবল তাদের ওপরই কার্যকর হবে, যারা কর পরিশোধ করেন না। এর আওতায় মূলত অনিবন্ধিত অভিবাসী ও কূটনীতিকরা পড়বেন।'
লিঙ্কডইনে প্রকাশিত একটি নোটে ড. রাঠা লেখেন, অভিবাসীরা রেমিটেন্স পাঠানোর খরচ কমাতে অনানুষ্ঠানিক পন্থার দিকে ঝুঁকবেন—যেমন নগদ অর্থ নিজে বহন করা, বন্ধু, কুরিয়ার, বাসচালক বা বিমানকর্মীদের মাধ্যমে টাকা পাঠানো, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা পরিচিতদের মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রায় অর্থ প্রদান নিশ্চিত করা, কিংবা হাওলা, হুন্ডি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো পদ্ধতি ব্যবহার করা।
তিনি বলেন, আমেরিকায় সর্বনিম্ন মজুরির কাজেও বছরে প্রায় ২৪ হাজার ডলার উপার্জন করা যায়—যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের চার থেকে ত্রিশ গুণ বেশি। ড. রাঠার ধারণা, অভিবাসীরা সাধারণত বছরে ১,৮০০ থেকে ৪৮,০০০ ডলার পর্যন্ত টাকা দেশে পাঠান।
তিনি বলেন, '৩.৫ শতাংশ কর এই রেমিট্যান্স কমাবে বলে মনে হয় না। কারণ, অভিবাসনের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো পরিবারের জন্য টাকা পাঠানো। সেই কারণেই মানুষ নদী, সাগর, পর্বত পেরিয়ে এখানে আসে।'