জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি বিএনপির

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। আজ (২২ মে) দুপুরে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির পক্ষে এ দাবি জানান দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
রিজভী বলেন, 'তারেক রহমানকে নিয়ে ড. খলিলের বক্তব্য গণতন্ত্রের স্থায়ী নিরাপত্তা ও ঐতিহাসিক সার্থকতার প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত। আমি ড. খলিলের গতকালের বক্তব্য—যেখানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানকে জড়িয়েছেন—তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমি এই বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাচ্ছি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানকে জানাতে চাই—এই ধরনের বিতর্কিত ব্যক্তিদের উপদেষ্টা পরিষদে রাখলে তা সরকারের জন্য কল্যাণকর হবে না। অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবি করছি।'
তার ভাষ্যে, 'ফ্যাসিবাদের দেড় দশক ড. খলিল কোথায় ছিলেন? কীভাবে ছিলেন? কোন দেশে ছিলেন? বিদেশে তার স্ট্যাটাস কী ছিল? ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে তার ভূমিকা কী ছিল? অবশ্যই এসকল প্রশ্নের জবাব জনগণকে জানাতে হবে। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট—রাষ্ট্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। ড. খলিলকে অবিলম্বে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে দেশে-বিদেশে তার অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য দেশের জনগণের সামনে হাজির করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের দেয়া বক্তব্যে দেশের মানুষ বিস্মিত, হতবাক, উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ হয়েছে। ফ্যাসিবাদের প্রতিভূ হাসিনা যেভাবে গণতন্ত্রকে কফিন পড়িয়ে, তথাকথিত উন্নয়নের ইন্দ্রজাল সৃষ্টির জন্য জিয়া পরিবারকে নিয়ে কুৎসা রটাতেন, উপদেষ্টার এই মন্তব্য বা এই বক্তব্য তারেক রহমানকে নিয়ে যেন সেটারই, সেই ফ্যাসিবাদেরই বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি বলে জনগণ মনে করে।'
তিনি আরও বলেন, 'এখনও যেন লোকমানুষে উজ্জ্বলতর তারেক রহমানের ভাবভূর্তিকে বিনষ্ট করার জন্য প্রতিশোধের চোরা স্রোতে আঘাত হানার চেষ্টা চলছে—নানা মহল থেকে, নানা দিক থেকে। ড. খলিলুর রহমান যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত জীবন প্রসঙ্গটি যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিমূলক।'
রিজভী বলেন, 'ধান ভাঙতে শিবের গীত গাওয়ার মতো ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, "কেবলমাত্র আমেরিকায় থাকি বলে যদি আমাকে বিদেশি নাগরিক বলা হয়, তাহলে কালকে তারেক রহমানকেও একই কথা বলতে হবে। আমাকে ঢিল নিক্ষেপ করলে, সেই ঢিল কিন্তু অন্যদের ওপর গিয়েও পড়তে পারে।" এটা কে বলেছে? যারা আপনাকে এসব বলেছে, তাদের সঙ্গে আপনার কথাবার্তা হতে পারে। তারেক রহমান এখানে আসলো কী করে? সাংবাদিকদের সঙ্গে আপনার আলোচনায় উনি উপযোগ্য হলেন কী করে?'
'তিনি (তারেক রহমান) একজন বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই দলের চেয়ারম্যান তিনি নিজেই। তাহলে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তাকে আলোচনায় টেনে আনার অর্থ কী? নিশ্চয়ই আপনারা মুখে যাই বলুন, অন্তরে অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া, বিস্ময় বা বিষক্রিয়া কাজ করছে—সেটা বারবার প্রকাশ পাচ্ছে', যোগ করেন রিজভী।
রিজভী আরও বলেন, 'এর আগেও আমরা বলেছি—সব উপদেষ্টার ব্যাপারে নয়—কিছু কিছু উপদেষ্টা মনে হচ্ছে নিরপেক্ষতার আড়ালে কোনো নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন। বিশেষ করে ড. খলিলুর রহমান যেভাবে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত জীবন প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করেছেন, তা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিকর।'
তারেক রহমানের যুক্তরাজ্যে থাকা নিয়ে রিজভী বলেন, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে এক নির্মম হত্যা চেষ্টা ও গুরুতর আহত অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে যান এবং বর্তমানে পরিবারসহ সেখানে বসবাস করছেন। ২০০৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা মামলা সাজানো হয়েছে, যার মধ্যে মানি লন্ডারিং, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, ঘোষিত-অঘোষিত সম্পদ ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা উল্লেখযোগ্য। এসব মামলায় তাকে দণ্ডিত করা হয়েছে, তবে ৫ আগস্ট দেশত্যাগের পর বেশিরভাগ সাজা বাতিল হয়েছে।
'তারেক রহমান তার জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশে ফিরতে পারেননি। ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের অধীনে পর্যটক, কর্মক্ষেত্র, ছাত্র, বিনিয়োগকারী এবং পরিবার বা শরণার্থী ভিসাসহ ভিসা বিভাগের অধীনে একজন বিদেশী নাগরিকের জন্য যুক্তরাজ্যে স্বল্প সময়ের (ছয় মাস), বর্ধিত সময়ের জন্য বা অনির্দিষ্টকালের জন্য বসবাস করা আইনত বৈধ, বলেন রিজভী।
তিনি আরও বলেন, 'জনগণের ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। সমর্থন অব্যাহত রাখার পরও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মনে হচ্ছে এই সমর্থনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ মনে হচ্ছে, বিএনপির সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধাতে চায়।'
রাখাইনের মানবিক কড়িডর নিয়ে রিজভী বলেন, 'ইতোমধ্যে কথিত মানবিক করিডর ইস্যু নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিশেষ করে ড. খলিলের ভূমিকা নিয়ে দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের মনে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। মানবিক করিডর নিয়ে গত এক মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একেকজনের একেক রকম বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে—এই সরকার পথ হারিয়ে ফেলেছে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের কথা পরিষ্কার—এসব করার দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নয়। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের ভোটে নির্বাচিত, জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি সরকার। এই সরকারের নিরপেক্ষতা এবং শাসনক্ষমতা নিয়ে জনগণের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অবিলম্বে এই সরকারের যেসব ব্যক্তিকে ঘিরে জনগণের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করুন।'
প্রসঙ্গত, গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে থাকার কারণে যদি আমাকে বলা হয় বিদেশি নাগরিক, তাহলে কাল তো তারেক রহমানকেও বলবে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আজকের সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের জাতীয়তা তার নেই। তিনি বলেন, 'আমার অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেই, থাকলে আপনারা প্রমাণ করেন।'
তিনি বলেন, 'আমার একটাই সিটিজেনশিপ, বাংলাদেশি। বাংলাদেশ ছাড়া আমার অন্য কোনো দেশের পাসপোর্ট নেই। আমি জাস্ট আমেরিকায় ছিলাম, বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশের পাসপোর্ট নেই। আরেক দেশে অবস্থান করার কারণে সেদেশের নাগরিকত্বের কথা বললে তো তারেক জিয়ার ওপরেও প্রশ্ন চলে আসবে।'
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, 'আমার জাতীয়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। আমি যেটা নই, আমাকে সেটা বানাবেন না প্লিজ। পারলে প্রমাণ করেন, আদালতে গিয়ে প্রমাণ করেন। আমার একটা অধিকার আছে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে। সেই অধিকার যদি আপনারা রক্ষা না করেন, সেটি যে কারও ওপর প্রযোজ্য হতে পারে।'
উপদেষ্টা আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে থাকার কারণে যদি আমাকে বলা হয় বিদেশি নাগরিক, তাহলে কাল তো তারেক রহমানকেও বলবে। আমি আবেদন করব একটু বুঝে কথা বলবেন। যদি আমাকে ঢিল নিক্ষেপ করেন, সেই ঢিল কিন্তু অন্যের ওপর গিয়েও পড়তে পারে।'