‘আমি বিমানে ছিলাম, কিন্তু ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বলছে আমি ছিলাম না!’

মাদ্রিদগামী এক ফ্লাইটে অদ্ভুত এক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক ক্যাথরিন স্নোডন। নিজের অজান্তেই তিনি ভুল পরিচয়ে পুরো যাত্রা করেছেন। অথচ বিমান কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধরতে পারেনি। খবর বিবিসি'র।
ঘটনাটি শুরু হয় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে। বিবিসির একটি ডকুমেন্টারির কাজে স্পেন যাচ্ছিলেন ওই সাংবাদিক। অনলাইনে চেক-ইনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিস্টেমে সমস্যা দেখা দেয়। বাধ্য হয়ে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন চেক-ইন করতে।
ক্যাথরিন সেলফ-চেক-ইন বুথেও সফল হননি। মেশিনে লেখা ওঠে, 'অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়্যার্ড' (সহযোগিতা প্রয়োজন)। এরপর বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা তার ব্যাগ চেক-ইন করেন এবং হাতে দেন একটি বোর্ডিং পাস। যাত্রী বোর্ডিং পাসটি ভালো করে না দেখে সরাসরি নিরাপত্তা যাচাইকরনে চলে যান।
২৩ এপ্রিল সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে রওনা হওয়া ফ্লাইট বিএ-৭০৫৫ পরিচালনা করছিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের স্প্যানিশ সহযোগী বিমান সংস্থা আইবেরিয়া। ছয় নম্বর সারিতে থাকায় তিনি প্রথম দিকেই বোর্ডিং শেষ করেন। গেটের দায়িত্বে থাকা কর্মী তার পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাস এক নজরে দেখে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেন।
বিমানে উঠে ক্যাথরিন দেখেন, নিজের সিট বিজনেস ক্লাসে! সাধারণত তিনি ইকোনমি ক্লাসে ভ্রমণ করেন। তাই ভেবেছিলেন হয়ত বিনামূল্যেই অতিরিক্ত সুবিধাটি পেয়েছেন। ফ্লাইট চলাকালীন তাকে পরিবেশন করা হয় বিলাসবহুল খাবার দাবার, সেদ্ধ কড মাছ ও ছোলার স্ট্যু। মিষ্টান্নতে ছিল তিরামিসু। তবে কাজের সফর হওয়ায় তিনি কোনো পানীয় নেননি।
সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু স্পেনে পৌঁছানোর পরই ঘটতে শুরু করে অস্বাভাবিক ঘটনা।
বোর্ডিং পাসের রহস্য
মাদ্রিদে পা রাখার পরপরই ফ্লাইটে থাকা ক্যাথরিনের মোবাইলে একটি ইমেইল আসে। জানানো হয়, তার ফিরতি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে।
তার মনে প্রশ্ন এলো, বাতিল কেন? এখন কীভাবে তিনি দেশে ফিরবেন?
বিবিসির ট্রাভেল এজেন্সি জানায়, ক্যাথরিন যেহেতু ফিরতি ফ্লাইটে 'অনুপস্থিত' ছিলেন, তাই সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরতি টিকিট বাতিল করেছে। অবাক হয়ে তিনি জানান, তিনি তো এখন মাদ্রিদেই। লাগেজ বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগের অপেক্ষায় আছেন!
ব্রিটিশ বিমানের সাথে কিছুটা গোলমেলে আলাপচারিতার পর কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ক্যাথরিন আদৌ ফ্লাইটে ছিলেন না। তার হাতে থাকা বোর্ডিং পাসেও নাকি সঠিক তথ্য ছিল না।
এখানেই বেরিয়ে আসে মূল রহস্য। তিনি বোর্ডিং পাসের নামটি খেয়াল করে দেখেন, সেটি তার নিজের নয়। সেখানে 'হিউ এইচ' (পুরো নাম প্রকাশ করা হয়নি) নামে এক ব্যক্তির নাম লেখা ছিল।
এমনকি তার লাগেজ ট্যাগেও ছিল সেই হিউ এইচ-এর নাম।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ জানায়, বিমানের কঠোর নিরাপত্তা প্রক্রিয়ার কারণে এমন ভুল নামে কেউ ফ্লাইটে উঠতেই পারেন না। কিন্তু বাস্তবে ক্যাথরিন উঠেছিলেন। তার সহকর্মী, যিনি কয়েক সারি পেছনে বসেছিলেন, নিশ্চিত করেছেন যে সাংবাদিকটি ফ্লাইটে ছিলেন।
ক্যাথরিন যাত্রা করেননি– তা নিয়ে বিমান সংস্থা এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, তাকে অতিরিক্ত খরচ দিয়ে নতুন করে টিকিট কেটে ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হয়। খরচও বেশি ছিল। যদিও পরে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ দুঃখ প্রকাশ করে তাকে ৫০০ পাউন্ডের 'গুডউইল' ভাউচার দেয়। সঙ্গে অতিরিক্ত টিকিটের টাকা ফেরত দেয়।
যাত্রীরা বিমানে ওঠার আগে নিরাপত্তা প্রক্রিয়াটি বেশ সহজ: বোর্ডিং পাসে থাকা নামটি পাসপোর্টে থাকা নামের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়।
কিন্তু এই যাত্রীর ক্ষেত্রে সেই নিয়ম কোথাও মানা হয়নি। চেক-ইন ডেস্ক কিংবা বোর্ডিং গেটে কেউই বোর্ডিং পাসের নাম ও পাসপোর্টের নামের পার্থক্য ধরতে পারেননি।
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, এই ভুল কোথায় হলো? আর হিউ এইচ নামের ব্যক্তিই বা কে?
ক্যাথরিন নিজেই খোঁজ নিতে শুরু করলেন।
'অস্বাভাবিক' এক ঘটনা
ইন্টারনেটে অনুসন্ধান চালিয়ে হিউ এইচ নামের তেমন কোনো ব্যক্তির খোঁজ মেলেনি। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তার পুরো নাম ব্যবহার করে যোগাযোগের চেষ্টা করেন ক্যাথরিন। কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি।
তাতে সন্দেহ ক্যাথরিনের মনে সন্দেহ জাগে, এই মানুষটি আদৌ কি বাস্তবে আছেন?
অবশেষে তিনি যোগাযোগ করতে সক্ষম হন এক ব্যক্তির সঙ্গে, যার নাম জনাথন হিউ এইচ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই জনাথন ২৪ এপ্রিল, অর্থাৎ তার এক দিন পর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে লন্ডনের হিথ্রোতে পৌঁছান। এ নিয়ে জনাথন মন্তব্য করেন, 'এমন ঘটনা সত্যিই উদ্বেগজনক।'
তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় আর তা হলো, জনাথনের নাম কি কোনোভাবে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ব্যবস্থায় আগে থেকেই ছিল? আর সেখান থেকেই কি এই ভুল?
আরেকটি দিক হলো, সাংবাদিকের পাসপোর্টে ও বুকিং কনফারমেশনে তার বিবাহ পরবর্তী পরিবর্তিত নাম ছিল। যার প্রথম অক্ষরও 'এইচ'। তবে সেটি হিউ-এর পুরো নামের সঙ্গে মোটেও মেলে না। তবু কি নামের অক্ষরের মিল এই বিভ্রান্তির কারণ?
এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবে কেউ দিতে পারছে না। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বলেছে, গোপনীয়তার কারণে তারা কিছু জানাতে পারছে না।
এই ঘটনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর ভ্রমণবিষয়ক সাংবাদিক সাইমন ক্যালডার বলেন, বিমান চলাচলের জগতে চাপ ও সময়সীমার কারণে মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। তিনি বলেন, 'এই ঘটনাটি ব্যতিক্রম। কারণ, গেটেই এই ভুল ধরা পড়লে সহজেই ঠিক করা যেত। বিমান সংস্থার উচিত দ্রুত তদন্ত করা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া।'
বিমান নিরাপত্তা ও পরিচালনা বিশেষজ্ঞ জুলিয়ান ব্রে বলেন, 'এখানে একটি নিরাপত্তা সমস্যা হয়েছে। কারণ বিমানটি উড়েছে ভুল যাত্রী তালিকা নিয়ে। এটা ভুল, এমনটা কখনোই হওয়া উচিত নয়।'
তবে তিনি আরও বলেন, 'বোর্ডিং পাস ও লাগেজ ট্যাগের নাম যদি মিলে যায়ব এবং ফ্লাইটে মোট যাত্রীসংখ্যা ঠিক থাকে, তাহলে ভুলটি কীভাবে ঘটতে পারে তা অনুমান করা যায়।'
তবে কেউ কেউ বলছেন, এটা আদৌ নিরাপত্তা ঝুঁকি ছিল না। কারণ ক্যাথরিন ও তার লাগেজ– দুটিই যথারীতি সব ধরনের নিরাপত্তা চেক পেরিয়ে বিমানে ওঠে।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এক মুখপাত্র বলেন, 'এটি নিঃসন্দেহে একটি মানবিক ভুল। আমরা যাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং দুঃখ প্রকাশ করেছি। এমন ঘটনা খুবই বিরল। তবে আমরা ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি যেন ভবিষ্যতে এমন না ঘটে।'
এদিকে যুক্তরাজ্যের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
হিথ্রো বিমানবন্দরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই ঘটনার সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ ওই যাত্রীর দায়িত্বে ছিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। নিরাপত্তা যাচাই প্রক্রিয়া যথারীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
এ ফ্লাইটটি পরিচালনা করেছিল স্প্যানিশ বিমান সংস্থা আইবেরিয়া। তারা শুধু ফ্লাইট পরিচালনা ও কেবিন ক্রুর দায়িত্বে ছিল। এ বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে তাদের কাছে অনুরোধ জানানো হলেও, কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে বিমানের ভেতরে সাধারণত পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাস যাচাই করা হয় না।
দুঃখ প্রকাশ, তদন্ত কিংবা কর্তৃপক্ষের বিবৃতি সব কিছুর পরও মূল প্রশ্ন থেকে যায়, এত আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার যুগে কীভাবে এমন জিনিস ঘটল?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের ভুল নিয়ে অতীতেও নানা ঘটনার কথা উঠে এসেছে। তবে সেসব ঘটনায় সাধারণত দুই যাত্রী একই আসনে বসতে যাওয়ার মতো ভুল ধরা পড়েছে উড্ডয়নের আগেই।
কিন্তু এই ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তির নামের জায়গায় অন্য একজনের নামে (যিনি হয়ত সেদিন ভ্রমণই করেননি) যাত্রী তালিকা তৈরি হয়েছিল।
এই পুরো ঘটনাটি কীভাবে ঘটল, সেই রহস্য হয়ত কখনোই পুরোপুরি জানা যাবে না।
তবে এই ঘটনা ক্যাথরিনকে একটি বিষয় শিখিয়েছে। আগামীতে চেক-ইন ডেস্ক থেকে কোনো বোর্ডিং পাস নেওয়ার পর তা না পড়ে আর কোনোদিনই তিনি সামনে এগোবেন না।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা