আশুলিয়ায় তীব্র লোডশেডিং; জনজীবন ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত

ঢাকার আশুলিয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে চলমান লোডশেডিংয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকাবাসী। টানা গরমের মধ্যে দিনে আট-দশবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় শিল্প কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম।
স্থানীয় পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, আশুলিয়ার কিছু এলাকায় লোডশেডিংয়ের হার ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
জামগড়া কাঠালতলা এলাকার বাসিন্দা সিরাজ খান স্থানীয়ভাবে একটি লন্ড্রির দোকান চালান। তিনি জানান, আগে দিনে ১০০ থেকে ১২০ পিস কাপড় আয়রন করতে পারলেও এখন বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ২০ পিস আয়রন করাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'দিনে গড়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। অন্তত ৮ থেকে ১০ বার লোডশেডিং হয়,' বলেন তিনি।
একই এলাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির কর্মী শামীম হোসেন জানান, ঘরে আইপিএস থাকলেও বিদ্যুৎ না থাকায় তা চার্জ হয় না। ফলে লোডশেডিংয়ে আইপিএসও কার্যকরভাবে কাজ করছে না।
তবে আশুলিয়ার পল্লি বিদ্যুৎ অফিস সংলগ্ন এলাকাগুলোতে তুলনামূলকভাবে লোডশেডিং কিছুটা কম বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা মিঠু শামসুজ্জোহা। তিনি বলেন, 'বেশিরভাগ এলাকায় দিনে ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হলেও আমাদের এলাকায় গড়ে ৩ থেকে ৪ বার লোডশেডিং হয়, যা বড়জোর এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়।'
পল্লি বিদ্যুৎ এলাকার আরেক বাসিন্দা সাইফুল ইসলামও একই তথ্য দিয়ে বলেন, 'আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট সহনীয় পর্যায়ে আছে।'
তবে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় অবস্থিত লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম. খোরশেদ আলম জানান, কারখানায় দিনে ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। যদিও তাদের মূল কার্যক্রম গ্যাস নির্ভর, তবুও ২০ শতাংশ কাজে বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় পল্লি বিদ্যুৎ থেকে ৯০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ অনুমোদন থাকলেও লোডশেডিংয়ের কারণে এসব কাজও ব্যাহত হচ্ছে।
পোশাক খাতের একটি শিল্পগ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'বিদ্যুৎ কতক্ষণ থাকে—এই প্রশ্ন করাটাই যুক্তিযুক্ত। কারণ এত লোডশেডিং হচ্ছে যে হিসাব রাখা কঠিন। কারখানায় জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন চালাতে হচ্ছে, এতে খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা—দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'
ঢাকা পল্লি বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আক্তারুজ্জামান লস্করও এই সংকট স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, 'এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, তবে হয়তো মানুষ যতটা বলছে, বাস্তবে তার চেয়ে কিছুটা কম লোডশেডিং হচ্ছে।'
তিনি জানান, ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর আওতাধীন ৫টি সোর্স লাইনের মধ্যে জামগড়া ও ইয়ারপুর এলাকায় কড্ডা গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এই গ্রিডে গত কয়েকদিন ধরে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, শনিবার বিকেল ৫টায় কড্ডা গ্রিডে তাদের চাহিদা ছিল ১০০ মেগাওয়াট, কিন্তু সরবরাহ পেয়েছেন মাত্র ৫৯ মেগাওয়াট—যার ফলে ঘাটতি দাঁড়ায় ৪১ মেগাওয়াট।
তিনি আরও বলেন, 'এই সময়ে আমাদের মোট চাহিদা ছিল ৪৯১ মেগাওয়াট, অথচ সরবরাহ ছিল মাত্র ৩৬৮ মেগাওয়াট—ঘাটতি ১২৩ মেগাওয়াট। কাজেই একটা প্রভাব তো পড়ছেই।'
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, জামগড়া ও ইয়ারপুর এলাকায় বিদ্যুৎ ঘাটতি ৪১ শতাংশ, যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্পষ্ট করে।
উল্লেখ্য, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, আশুলিয়া ও সাভারের একটি অংশ ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর অধীন, যার বড় অংশজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন শিল্প কারখানা।
অন্যদিকে, আশুলিয়ার তুলনায় সাভারে পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয়। ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর আওতাধীন সাভারের নামা গেন্ডা, ব্যাংক টাউন, ব্যাংক কলোনি—এইসব এলাকায় দিনে ২ থেকে ৩ বার লোডশেডিং হয়, যার স্থায়িত্ব সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা ও কারখানা কর্তৃপক্ষ।
হেমায়েতপুর চামড়া শিল্প নগরীর সালমা ট্যানারির মালিক এবং বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, 'শিল্প নগরীতে লোডশেডিং খুব একটা নেই। দু-একদিন হলেও পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়েই আছে।'
সাভারের আমিনবাজার, হেমায়েতপুর ও ধামরাই এলাকা ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর আওতাধীন।
সমিতির সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (ওএন্ডএম) শাহেদুজ্জামান জানান, তাদের এলাকায় লোডশেডিং তুলনামূলকভাবে কম। তিনি বলেন, 'আমাদের চাহিদা ৩৩০ থেকে ৩৩৫ মেগাওয়াট, কিন্তু গ্রিড ওভারলোড ও জেনারেশন ট্রিপের কারণে সরবরাহ ৩০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত সীমিত থাকে।'
তিনি আরও জানান, 'একটি গ্রিডে ধরুন সক্ষমতা ১৪০ মেগাওয়াট, কিন্তু ডিমান্ড ১৭০ মেগাওয়াট হলে আমাদের ফোর্স শেডিং করতে হয়। এছাড়া ঢাকা নর্থ পাওয়ার জেনারেশন থেকে আমরা ৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাই, সেটি মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে গেলে সাভার গ্রিডেও ২০ থেকে ৩০ মেগাওয়াট ঘাটতির কারণে লোডশেডিং হয়।'
এই পরিস্থিতিতে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেখানে একদিকে ভয়াবহ ঘাটতি, অন্যদিকে সহনীয় মাত্রায় সংকট চলছে।