ম্যালেরিয়া রোগীর ৮৮% রাঙ্গামাটি, বান্দরবানে; ২০৩০ সাল নাগাদ শূন্যে পৌঁছানোর লক্ষ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের

২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্যে কার্যক্রম জোরদার করেছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ম্যালেরিয়া রোগীর ৮৮ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে কেবল দুটি পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও রাঙামাটিতে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৯৯ জন। এর মধ্যে শুধু বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলা থেকেই শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৫০১ জন। বান্দরবানে জেলার মোট রোগীর ৬৩ শতাংশই এসেছে লামা, আলীকদম ও থানচি উপজেলা থেকে। অন্যদিকে রাঙামাটিতে মোট রোগীর ৮৬ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বাঘাছড়ি ও বরকল উপজেলা থেকে।
ম্যালেরিয়া একটি প্রাণঘাতী রোগ, যা সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩৬ প্রজাতির অ্যানোফেলিস মশা রয়েছে। এর মধ্যে চারটি প্রজাতিকে ম্যালেরিয়ার প্রধান বাহক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পার্বত্য জেলাগুলোতে রোগীর ঘনত্ব উদ্বেগজনক হলেও, গত এক দশকে দেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৪৮০ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৪৫ জনের। এর তুলনায় ২০২৪ সালে আক্রান্তের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৯৯ জনে এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৬টি।
তবে এখনও দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৩টিতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। এসব জেলা হলো—শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, কুড়িগ্রাম, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া ও এডিস-সংক্রমিত রোগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার শ্যামল কুমার দাস বলেন, 'ম্যালেরিয়া এ মুহূর্তে আছে ১৩ জেলায়। এর মধ্যে ময়মনসিংহ জোনের চার জেলায় ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ নেই।'
তিনি বলেন, 'সিলেট জোনের চার জেলায় অল্প মাত্রায় সংক্রমণ আছে। তবে, সবচেয়ে ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি।'
পার্বত্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ
শ্যামল কুমার দাস উল্লেখ করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ভৌগোলিক ও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা তৈরি করছে।
তিনি বলেন, 'ঘন জঙ্গল এবং দূরবর্তী পার্বত্য বসতি ঝুঁকিপূর্ণ জনগণের কাছে পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন করে তোলে। জুম চাষ বা বনভিত্তিক কাজের সাথে যুক্ত মানুষরা সাধারণত যাযাবরের মতো জীবনযাপন করে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য বাড়ির বাইরে চলে যায়। যার ফলে রোগের তদারকি এবং চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে।'
শ্যামল কুমার আরও জানান, এই এলাকার সীমান্ত অঞ্চলগুলো ম্যালেরিয়া সংক্রমণের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত, কারণ সেগুলো এমন দেশের কাছাকাছি, যেখানে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। তিনি বলেন, 'ভাষার প্রতিবন্ধকতা এবং যোগাযোগের ঘাটতিও উদ্যোগকে কার্যকর করতে আরও জটিলতা তৈরি করে।'
সম্প্রসারিত উদ্যোগ
ঘন ম্যালেরিয়া প্রাদুর্ভাবের প্রতিক্রিয়ায়, সরকার ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কৌশল বাড়াচ্ছে। রুটিন পদক্ষেপ যেমন কীটনাশক মশারি বিতরণ, মশার ওষুধ স্প্রে করা, দ্রুত রোগ নির্ণয় করতে পরীক্ষা এবং বিনামূল্যে মুখে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে টার্গেটেড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিডিএ) কার্যকর করছে।
টিডিএ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করা একটি পদ্ধতি। এতে পুরো জনগোষ্ঠীকে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধের পূর্ণাঙ্গ কোর্স করানো হয়। এটি ব্যক্তিগত সংক্রমণ অবস্থা না দেখে করা হয়। বিশেষত যেখানে পরীক্ষা করার সুযোগ কম, সেসব এলাকায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
শ্যামল কুমার দাস বলেন, 'বান্দরবানের চারটি গ্রামে টিডিএ-এর ফলাফল আশাজনক ছিল এবং নতুন কোনো রোগীর খবর পাওয়া যায়নি।' তিনি বলেন, 'এই সফলতার ভিত্তিতে আমরা রাঙামাটির ৩১টি গ্রামে উদ্যোগটি সম্প্রসারণ করেছি এবং মে মাস থেকে এটি বান্দরবানের আরও ৩১টি গ্রামে চালু করা হবে। আমরা আশাবাদী, এটি রোগের সংখ্যা কমাতে সহায়তা করবে।'
সরকার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে ভ্যাকসিন ট্রায়ালও চালাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আফ্রিকায় শিশুদের জন্য দুটি কার্যকর ম্যালেরিয়া ভ্যাকসিন সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশ এখন এসব ভ্যাকসিনের প্রভাব স্থানীয়ভাবে মূল্যায়ন করতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এমএ ফয়েজ বলেন, 'কর্তৃপক্ষ লামা এবং আলীকদমের ১০০টি গ্রামে ট্রায়াল চালাচ্ছে। সেখানে বাসিন্দাদের ২৫টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'প্রতিটি গ্রুপে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা মাপতে বিভিন্ন সেবা এবং কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এই গবেষণা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে করা হচ্ছে এবং আমরা আগামী বছর ফলাফল আশা করছি।'
'আমাদের সাথেই ম্যালেরিয়া শেষ: পুনঃবিনিয়োগ, পুনর্কল্পনা, পুনর্জাগরণ'– এই স্লোগানকে ধারণ করে আজ বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস পালিত হবে।