প্রধানমন্ত্রীর ২ মেয়াদসীমায় আপত্তি, জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ চায় বিএনপি

একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না—সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবে আপত্তি তুলেছে বিএনপি। এছাড়া, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের শীর্ষ তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির মধ্য থেকে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি—যাতে করে বিতর্কিত নিয়োগ এড়ানো যায়।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার তৃতীয় দিনের শেষে এসব কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
তিনি জানান, পাঁচটি সংস্কার কমিশন থেকে দেওয়া ৬৯১টি প্রস্তাবের মধ্যে ৫০০টির বেশি প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত পোষণ করেছে। ৭৩টি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে এবং বাকি প্রস্তাবগুলোর ওপর মতামত বা আংশিক সমর্থন জানিয়েছে।
বৈঠক শেষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকের বলেন, রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় বিচার বিভাগকে যুক্ত করতে চায় না বিএনপি। তবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির পরিবর্তে আপিল বিভাগের শীর্ষ তিনজন বিচারপতির মধ্য থেকে যোগ্য কাউকে নিয়োগের পক্ষে দলটি।
তিনি বলেন, "সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে বিতর্কিত নিয়োগ হয়েছে। ভবিষ্যতে বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে চাইলে এই পদ্ধতি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা চাই, সিনিয়র মোস্ট বিচারপতির একক প্রস্তাবের বদলে অন্তত দুই-তিনজন বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়ার সুযোগ রাখা হোক। যদিও এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, আলোচনা চলছে।"
সুপারসিড পদ্ধতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "ফ্যাসিস্ট আমলে সিনিয়রদের উপেক্ষা করে যেভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হতো, আমাদের প্রস্তাব কার্যকর হলে সেই সুযোগ থাকবে না। কারণ, জুলাই সনদ ও সংবিধান সংশোধনের পর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপও বন্ধ হবে।"
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই আমাদের কাছে সর্বোচ্চ। তাই বিকল্প অপশন রাখা দরকার। না হলে রাষ্ট্র এমন একজন ব্যক্তির অধীনে চলে যেতে পারে, যা কল্যাণকর হবে না।"
এছাড়া, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর পদে সর্বোচ্চ দুইবার থাকতে পারবেন- সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবে আপত্তি তুলেছে বিএনপি।
দলটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি দুবার প্রধানমন্ত্রী থাকার পর বিরতি দিয়ে আবারও দায়িত্ব নিতে পারবেন- এমন নিয়োম থাকা উচিত। তবে আলোচনায় তিনবার মেয়াদে থাকার প্রস্তাব উঠলে বিএনপি তা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "তারা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেয়নি।"
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে নতুন ধারা যুক্ত করে রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষকদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগে নীতিগত সমর্থন দিলেও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) ধারণার বিরোধিতা করেছে দলটি।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্তে এনসিসিকে যুক্ত করার প্রস্তাব থাকলেও, আমরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছি। তবে রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় বিচার বিভাগকে যুক্ত করার বিপক্ষে আমরা।"
রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের বিষয়েও বিএনপি একমত নয় বলে জানান তিনি।
এছাড়া, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং ১০০ আসনে নারী প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষণের বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি, এবং এই বিষয়ে কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়।
সোমবার (২২ এপ্রিল) সকালে সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, "সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন এখন চূড়ান্ত আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। এরপর বিচার বিভাগসংক্রান্ত বিষয়াদি পর্যালোচনা শুরু করব। ধাপে ধাপে অন্য কমিশন নিয়েও আলোচনা হবে।"
তিনি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিএনপি অটল রয়েছে। এ জন্য বিচারপতি নিয়োগবিধিতে পরিবর্তন ও আলাদা বিচার বিভাগ সচিবালয় গঠনের পক্ষে দলটি মত দিয়েছে। তিনি বলেন, "আর এ সবকিছুই সংবিধান ও আইন অনুযায়ী হতে হবে।"
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এটি ছিল বিএনপির চলমান আলোচনার তৃতীয় দিন। এর আগে, গত ১৭ ও ২০ এপ্রিল দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ মার্চ দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সংস্কার প্রস্তাব জমা দেয়।
বিএনপি প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, সাবেক স্থাপন সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
মঙ্গলবারের বৈঠকের শুরুতে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এটি একটি 'ঐতিহাসিক মুহূর্ত'। তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টাকে প্রতিনিয়ত আলোচনা সম্পর্কে অবহিত রাখা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, "আগামী মে মাস থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনা শুরু হবে।"