‘আমরা সবাই ঈশ্বরের সৃষ্টি’: সিরিয়ান মুসলিম শরনার্থীদের পা ধুইয়ে চুম্বন করে উদাহরণ গড়েছিলেন যে পোপ

পোপ ফ্রান্সিস আধুনিক পোপের পদকে যেভাবে বদলে দিয়েছেন, সেটি তার আগে কোনও পোপই করতে পারেননি। তিনি গাম্ভীর্য ও বিশিষ্টতার অনেক আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করে এই পরিবর্তন ঘটান।
শুরু থেকেই রক্ষণশীলরা পোপ ফ্রান্সিসকে ভালো চোখে দেখেননি। তার অনানুষ্ঠানিক চালচলন, সাদাসিধে জীবনযাপন এবং পবিত্র বৃহস্পতিবারের এক ধর্মীয় রীতিতে মুসলিম ও নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত রক্ষণশীলদের অসন্তোষের মূল কারণ হয়ে ওঠে। আগে এই রীতি কেবল ক্যাথলিক পুরুষদের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল।
পোপ ফ্রান্সিস নানাভাবে প্রমাণ করেছেন ধর্মীয় সীমারেখা নয়, মানবতা হলো তার বার্তা। খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু সিরীয় মুসলিম শরণার্থীদের পা ধুয়ে চুমু খেয়ে ভালোবাসা, সংহতি ও সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। খ্রিস্টান ধর্মীয় উৎসবে তৈরি হয় একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ সালে ইতালির রোমের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি শরণার্থী শিবিরে, 'পা ধোয়ার বৃহস্পতিবার' (হলি থার্সডে) উপলক্ষে পোপ ফ্রান্সিস বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর ১২ জন শরণার্থীর পা ধুয়ে দেন। এদের মধ্যে ছিলেন মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। বিশেষ করে সিরিয়া থেকে আগত মুসলিম শরণার্থীদের প্রতি তার আন্তরিক সম্মান ও সহমর্মিতা সকলের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
এ সময় তিনি বলেন, 'আমরা সবাই একসাথে—মুসলিম, হিন্দু, ক্যাথলিক, কপ্ট, ইভ্যাঞ্জেলিক। কিন্তু সবাই ভাই, একই ঈশ্বরের সন্তান।'
পোপ বলেন, 'ধর্ম, জাতি বা ভাষা আমাদের বিভাজন করতে পারে না। ভালোবাসা, ক্ষমা ও শান্তিই আমাদের পথ।'
তিনি আরও বলেন, 'যারা ঘর হারিয়েছে, যুদ্ধের ভয়াবহতার শিকার হয়েছে এবং আজ নতুন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে এসেছে, এই পা ধোয়ার মধ্য দিয়ে আমি তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি।'
খ্রিস্টান ধর্ম অনুসারে ক্রুশবিদ্ধ হবার আগে যিশু খ্রিষ্ট তাঁর শিষ্যদের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন। ঐতিহ্যবাহী এই ইস্টার সানডের রীতি পোপ ফ্রান্সিস নিয়মিত পালন করেন।
বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে পোপ ফ্রান্সিসের এই পদক্ষেপ একটি শান্তির বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি কেবল খ্রিস্টানদের জন্যই নন, বরং সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য একজন নৈতিক পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন। তার এমন আচরণ কেবল ধর্মীয় সহনশীলতার উদাহরণ নয়, বরং তা বিশ্ব মানবতার প্রতীক।
পোপের এই মানবিক কার্যক্রম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। অনেকেই বলেছেন, পৃথিবীতে ঘৃণা ও বিভাজন ক্রমেই বাড়ছে, পোপ ফ্রান্সিসের এই কাজ আমাদের হৃদয়ে আবারও মানবতাবোধে জাগিয়ে তোলে।
পোপের নেতৃত্বে ভ্যাটিকান বহুবার মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংলাপ ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ইসলাম ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মন্তব্য এবং আন্তঃধর্মীয় সম্মেলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন—ভালোবাসা ও শান্তির জন্য নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম নেই।
বিশ্বজুড়ে শরণার্থী ইস্যু রাজনৈতিক বিতর্কে পরিণত হওয়ার এই সময়ে পোপ ফ্রান্সিসের মতো একজন ধর্মীয় নেতার এমন সংবেদনশীল এবং দৃষ্টান্তমূলক আচরণ আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে শেখায়—আমরা কে, এবং আমরা কেমন পৃথিবী চাই।
এছাড়া, ২০১৩ সালে পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর পোপ ফ্রান্সিস রোমের এক কারাগারে মুসলিম, নারী ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের পা ধুয়ে রক্ষণশীলসহ পুরো বিশ্বকেই বিস্মিত করেছিলেন।

২০১৩ সালে পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শের পদত্যাগের পর ফ্রান্সিস নেতৃত্বে আসেন। সে সময় ভ্যাটিকানের গীর্জা ছিল নানা মতাদর্শের ব্যক্তিদের দ্বারা চরমভাবে বিভক্ত।
আর্জেন্টিনার এই ধর্মগুরু ছিলেন ১৩০০ বছরের মধ্যে প্রথম অ-ইউরোপীয় পোপ।
২০২২ সালে বেনেডিক্টের মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে ভ্যাটিকানে একইসঙ্গে দুজন পোপ ছিলেন। আজ ২১ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে ভ্যাটিকানের কাসা সান্তা মার্তায় নিজ বাসভবনে পোপ ফ্রান্সিস মারা গেলেন।
সাধারণত পোপদের পূর্ব ইচ্ছানুযায়ী তাঁদের মৃত্যুর পর সাইপ্রাস কাঠ, সীসার অথবা দামী ওক গাছের কাঠের তৈরি কফিনের যেকোনো একটিতে রাখা হতো। তবে পোপ ফ্রান্সিস মৃত্যুর পরেও যেন তার স্বভাবসুলভ ধারা বজায় রাখলেন। বিবিসিতে প্রকাশিত একটি খবর অনুযায়ী তিনি কফিনের জন্য বেছে নিয়েছেন একটি সাধারণ কাঠের কফিন, যার ভেতরে থাকবে সাধারন দস্তার প্রলেপ মাত্র।
এছাড়া, পোপদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানও বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। তবে কিছুদিন আগেই পোপ ফ্রান্সিস জানিয়েছিলেন, কোনোরকম আড়ম্বরতা ছাড়াই যেন তার শেষকৃত্য আয়োজন করা হয়।