বিগত সরকার গণঅভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি: জাতিসংঘ

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং তাদের কর্মীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে ক্ষমতাচ্যুত সরকার কোনো 'উপযুক্ত কোনো পদক্ষেপ' নেয়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, বাংলাদেশের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ আইনে নিশ্চিত করা সত্ত্বেও নিরাপত্তা বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে কোনো তদন্ত করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের তদন্ত করে জবাবদিহি নিশ্চিত করা তো দূরের কথা, আগের সরকারের কোনো উপযুক্ত প্রচেষ্টাও ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত করতে পারেনি।
আরো বলা হয়েছে, নির্যাতন ও গুরুতর দুর্ব্যবহারের অভিযোগগুলো তদন্ত করা হয়নি, যদিও সাবেক কর্মকর্তারা ওই সময়ে বিরাজমান চাপের মধ্যে নিরাপত্তা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। তারা দাবি করেছেন, কোনো ভুক্তভোগী তখন অভিযোগ করেননি।
তবে ওএইচসিএইচআর বলেছে, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বস্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত অসংখ্য প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশদ বিবরণ ও বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীর প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো তাদের (ওএইচসিএইচআর) নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত শুরু করার জন্য যথেষ্ট কারণ ছিল।
মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে বিদেশি ও আন্তর্জাতিক নেতাদের উদ্বেগ সম্পর্কিত তথ্যও ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের আগস্টের শুরুতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাও ব্যক্তিগতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
আরও বলা হয়েছে, ১৭ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তিনজন বিচারকের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। যেখানে সব ঘটনার জন্য 'বিরোধী দলের উসকানিদাতা' ও 'সন্ত্রাসীদের' দায়ী করা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতের ঘটনা, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
তদন্তের পরিধিতে শুধু বিক্ষোভকারীদের কর্মকাণ্ডে একচেটিয়া দৃষ্টি দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে নিরাপত্তা বাহিনীকে আরো ব্যাপক সহিংসতার সুযোগ দেওয়া হয়।
সরকারের ঊর্ধ্বতন সাবেক দুই কর্মকর্তার সাক্ষ্য অনুযায়ী, এই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি কখনো কোনো অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এমনকি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যখন এটি তদন্তের কাজ বন্ধ করে দেয়, তখন এর কার্যকলাপের কোনো রেকর্ডও রেখে যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ সংঘটিত লঙ্ঘনের সত্যতা দমন করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
ওএইচসিএইচআর আরো জানিয়েছে, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হাসপাতালগুলোতে তাদের উপস্থিতি বজায় রাখত। সেখানে চিকিৎসাধীন অনেক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণসহ রেকর্ডও জব্দ করেছে তারা।
প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, হত্যাকাণ্ড গোপন করতে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে গেছে, পরিবারের কাছ থেকে মরদেহ লুকিয়ে রেখেছে অথবা পুড়িয়ে ফেলেছে। কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভুক্তভোগীদের মরদেহ থেকে প্রজেক্টাইল অপসারণ করা হয়েছে ও তাদের ওপর হামলার উৎস সম্পর্কিত কোনো রেকর্ড ছাড়াই পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, তারা পুলিশ ও র্যাবের ইউনিটগুলোকে রেকর্ডহীন গোলাবারুদ বরাদ্দ দেওয়ার তথ্য পেয়েছে। যাতে তাদের ব্যাপক গুলিবর্ষণের পরিমাণ গোলাবারুদ ব্যয়ের হিসাবের মধ্যে না ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র্যাব তখন দাবি করেছিল অভ্যুত্থানের সময় মোতায়েন করা তাদের ১৫টি ব্যাটালিয়নের মধ্যে ১৪টির একটিও রাইফেলের গুলি চালায়নি, যা ওএইচসিএইচআরের নথিভুক্ত বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের ওপর র্যাবের গুলিবর্ষণের ঘটনার সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ। পুলিশ ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ অভ্যুত্থানে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবার, আইনজীবী, সাংবাদিক ও অন্যান্যদের ভয় দেখিয়েছিল, যারা জবাবদিহির দাবি করে নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
আরও বলা হয়, কর্তৃপক্ষ অন্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন গোপন করার চেষ্টা করেছিল। উল্লেখ্য, আবু সাঈদ হত্যার প্রতীকী মামলার সঙ্গে জড়িত কয়েকশো লোককে ভুলভাবে অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যদিও ব্যাপকভাবে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্য স্পষ্ট করে দেয়, পুলিশই তাকে হত্যা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) তার নিজস্ব এখতিয়ারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করা ও ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দিতেও ব্যর্থ হয়েছে।
তবে ওএইচসিএইচআর উল্লেখ করেছে, এনএইচআরসি ৩০ জুলাই একটি 'অস্পষ্ট বিবৃতি' দিয়েছিল, যেখানে প্রাণহানির ঘটনাকে 'অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন' বলে বর্ণনা করা হয়।
বিবৃতিতে কর্তৃপক্ষকে গণগ্রেপ্তার না করতেও আহ্বান জানানো হয়। তবে এই জাতীয় অধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুরো সময় আর কোনো প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ করেনি বা কোনো তদন্ত শুরু করেনি।