বিলেতি নারীর ভারতযাত্রা

যাত্রা হলো শুরু
বিলেত থেকে জাহাজে চড়ে ভারত ভ্রমণ সহজ ছিল না মোটেও। তাও আবার সেই আঠার শতকে! বিলেতিদের চোখে ভারত তখন একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ। যে দেশের মানুষ অশিক্ষিত, কুলি, মজুর; আর যে দেশটা রাক্ষসখোক্কস এবং একইসঙ্গে রাজা-মহারাজাদের আবাসস্থলও— এরকম একটি অঞ্চলে ভ্রমণ করা ঘোরতর চিন্তার বিষয়।
কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের পরেই এই ভারতর্ষ হয়ে উঠল প্রচুর সোনাদানা, অর্থ, মনিমুক্তা, আর মশলাপাতির দেশ। এই বিশ্বাস যে একেবারে অমূলক ছিল না, ইউরোপীয়দের ভারতমুখি অভিযাত্রাগুলোই তার প্রমাণ। কারণ প্রাচুর্যময় এই ভারতবর্ষের লোভে এসেছে আরবরা, তুর্কি-পারসিয়ানরা, পরে পুর্তগীজ, দিনেমার, ওলন্দাজ ও ইংরেজরা।
ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপন করে প্রায় ২০০ বছর শাসন এবং সম্পদ লুণ্ঠন চালায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরে ব্রিটিশরাজ। এই ব্রিটিশ শাসনামলেই উন্নত ও আরাম-আয়েশপূর্ণ জীবনের আশায় শত শত দরিদ্র বিলেতি নারীর ভারতবর্ষে আগমন ঘটতে থাকে! তাদের সামনে রবার্ট ক্লাইভের বাইরে আরও বড় উদাহরণ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এখানকার সাধারণ সেনাপতিরা, যাদের বিপুল সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি আর আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপনের খবর মূল ভূখণ্ডেও নিয়মিত আলোচনার বিষয় ছিল। ফলে ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষে যত দৃঢ় হচ্ছিল, ভারতমুখি বিলেতি মেয়েদের ভিড়ও তত বাড়ছিল ব্রিটিশ বন্দরগুলোয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজগুলো ছিল লম্বায় ১৮০ ফুট। যথেষ্ট প্রশস্ত। জাহাজগুলোতে ৫০০ থেকে ১২০০ টন মালামাল পরিবহন করা যেত। ১৭৯৩ থেকে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ রকম ৯৮টি সমুদ্রগামী জাহাজ বানায়। ধারণা করা হয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল প্রতি বছর অন্তত ৫ থেকে ১০টি জাহাজ ভারত থেকে ইংল্যান্ডের লিভালপুর বন্দরে ভেড়ানো। জাহাজগুলোর নির্মাণশৈলি খুব যে আধুনিক ছিল, তা নয়; তবে মালামাল বহন এবং সঙ্গে যাত্রী বহনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
ভারতগামী জাহাজের ক্যাপটেনের নিয়োগের কাজটিও আগেভাগে সেরে রাখা হতো। কারা হতেন এইসব জাহাজের ক্যাপটেন? তাদের বেশির ভাগই যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। এর বাইরে প্রাক্তন সৈনিক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দক্ষ ও বিশ্বস্ত লোকও সুযোগ পেতেন ক্যাপটেন হওয়ার। সঙ্গে ক্যাপটেন নিয়োগে অন্য কয়েকটি বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হতো: যাদের ইউরোপ থেকে ভারতে জাহাজ নিয়ে যাওয়ার পূর্বাভিজ্ঞতা রয়েছে, এবং নাবিক হিসেবে সুপরিচিতি। যেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষ ক্যাপটেনের হাতে জাহাজের দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।
ক্যাপটেন বাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিটি জাহাজে ১৩০ জনের মতো দক্ষ নাবিক সমুদ্রযাত্রায় অংশ নিতেন। আর থাকত গোলা-বারুদসহ ৩৮টি কামান। জাহাজের পাটাতনের নিচের অংশে রাখা হতো মালামাল ও অন্য পণ্যসামগ্রী। জাহাজের ডেক শুধুমাত্র ওপরের দিকের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা, তাদের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের জন্যে বরাদ্ধ থাকত।
ডেকের ছোট ছোট কেবিনগুলো বরাদ্ধ থাকত জাহাজ ভ্রমণে ইচ্ছুক কিছু পর্যটক এবং অভিজাত যাত্রীর জন্যে। এর বাইরে জাহাজের খালাসীদের বেশিরভাগই ছিলেন চাইনিজ, ভারতীয় আর কয়েকজন ইউরোপিয়ান।

ইংল্যান্ড থেকে ভারতে যেতে কেপ অব গুড হোপ চক্কর দিয়ে মোট যাত্রাপথ ছিল ১২ হাজার মাইল। দূরত্বের হিসেব করলে এটা দীর্ঘ পথ। জাহাজ প্রতিদিন গড়পরতা ৭৫ থেকে ১৫০ মাইল পর্যন্ত যেতে পারত। জাহাজ যাত্রার হিসেবে ৪ থেকে ৫ নট (knots)। তবে এই হিসাব-নিকাশের পুরোটাই নির্ভর করত জলবায়ু, প্রকৃতিক দুর্যোগ, বাতাসের বেগ— এসবের ওপর। সে হিসাব কষলে ভারত পৌঁছাতে সময় লাগত পাক্কা চার থেকে পাঁচ মাস।
এখন কল্পনা করুন, এই সমুদ্র যাত্রায় একজন বিলেতি নারী চলেছেন ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে, তার সামনে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা। এ রকম একাকী কোনো যাত্রার পূর্বাভিজ্ঞতাও তার নেই। কিন্তু তিনি বুকে সাহস রেখেছেন, ভারতের মাটিতে নামার পর তার ভাগ্য খুলে যাবে। তিনি নিশ্চিতভাবেই কোনো না কোনো ইংরেজ অফিসারের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হবেন। তারপর চাকর, বাকর, বাবুর্চিসমেত এক আয়েশি জীবন।
এই যাত্রায় তাদের মনে কিছু দুর্বিপাকের আশঙ্কাও কাজ করত: এমনও শুনেছেন তারা, সমুদ্রযাত্রায় মাঝপথে বিকল হয়ে গেছে জাহাজ। তখন অনির্দিষ্টকাল সমুদ্রে আটকে থাকার ঝুঁকি থাকে। ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজডুবির ঘটনাও ঘটে। কিন্তু এসব ঝুঁকি তাদের শেষ পর্যন্ত হতোদ্যম করতে পারেনি।
বিলেত থেকে ভারতবর্ষে আসার জাহাজের রাহা খরচ মোটেও কম ছিল না। সরকারি আমলা বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যাত্রীর জন্য ভাড়া ছিল গড়ে ২৫০ পাউন্ড। তবে কোম্পানির কেরানি বা আরও নিম্নশ্রেণির পদের যাত্রীদের টিকেট দাম হতো ১১০ পাউন্ডের মতো। তবে সাধারণ বিলেতি নারী বা পুরুষ যারা ভাগ্য পরীক্ষার জন্যে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে যাচ্ছেন, তাদের ভ্রমণ বাবদ খরচ হতো ৪০০ থেকে ৫০০ পাউন্ড। দুয়েক ক্ষেত্রে জাহাজের ক্যাপটেনের সঙ্গে দরকষাকষি করে টিকিটের দাম কিছুটা কমানো যেত। তবে দরদামে যৎসামান্য যা-ই কমানো সম্ভব হোক না কেন, ওই সময়ের ৪০০ থেকে ৫০০ পাউন্ড এখনকার সময়ে প্রায় ২০ হাজার পাউন্ডের সমান। ভাবা যায়, ওই সময়েই এত টাকা খরচ করে তারা ভারতে আসতেন! তার মানে, ভারতে যে জীবনের জন্য আসতেন, তা কি পরিমাণ লোভনীয় বা আকর্ষণীয় ছিল, সহজেই অনুমান করা সম্ভব।
উচ্চমূল্যে টিকিট কেনা এসব নারী যাত্রীর জন্য জাহাজের বরাদ্দ ছিল: ডেকে ৯ স্কয়ার ফুটের কাঠের তৈরি ছোট একটি কেবিন। এ রকম এক সারিতে ৫ থেকে ৬টি কেবিন থাকত, তবে একেবারেই পলকা, যা হালকা বাতাসেই নড়বড় মনে হতো। দরজার কপাট ছিল; কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সেই কপাট সশব্দে বন্ধ হতো আর খুলত। দরজার হুড়কো বহু আগেই খসে পড়েছে। মেরামত করা হয়নি।
১৮৪৫ সালে ইমা রবার্ট নামে এক বিলেতি নারী তার এই ভ্রমণ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন; সেখানে তিনি লিখছেন:
'যাত্রাটা গোড়ায় একটা উৎসবের মতো মনে হয়। একে জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে স্বাক্ষাতের উৎসবও বলা যেতে পারে। গভীর সমুদ্রে পড়ে আমরা এক কেবিন থেকে আরেক কেবিনে ছুটছি, দুলছি, সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। তবে সমুদ্র যাত্রায় মেয়েদের এই ধরনের অভিজ্ঞতায় পড়তে না হলে খুব ভালো হতো। তাহলে এই পুরো যাত্রা আনন্দঘন হতো নিঃসন্দেহে। একমাত্র ভরসা ছিল, জাহাজ পরিচালনায় রয়েছেন একদল দক্ষ নাবিক। তারপরও অবস্থাটা ছিল অশেষ: দিন নেই, রাত নেই— কেবিনে আমরা বসে বসে দোল খাচ্ছি। বাইরে জাহাজের ক্রুরা দাঁড়িয়ে। তাদের যে কোনো সাহায্যের দরকার হলেই পাওয়া যায়। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ায় জাহাজের ডেক যখন দুলতে শুরু করে, তখন যাত্রীদের ভয়ার্ত চিৎকার, আহাজারি, দড়ির খরখর শব্দ ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করে।'

তবে ধনাঢ্যরা সবখানেই সুবিধা পান। সেই সময়ের সমুদ্রযাত্রায়ও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তারা চাইলে একাধিক কেবিনও ভাড়া নিতে পারতেন, যেখানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকায় কোনো বাধা ছিল না। শিশুদের জন্যেও আলাদা করে বানানো ছোট কেবিন ছিল।
১৮০৭ সালে ব্রিটিশ শিল্পপতি উইলিয়াম হাইকে ভারত থেকে ক্যাসল ইডেন (Castle Eden) জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ড ফিরেছিলেন। তার ওই যাত্রায় খরচ পড়েছিল ১১০০ পাউন্ড! অর্থাৎ অতিরিক্ত পয়সা খরচ করে জাহাজে তিনি সব রকম আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন।
এই সমুদ্রযাত্রায় তার ছোট্ট একটা বর্ণনা পাঠ করা যাক:
'গোলাবারুদে ভরা কেবিনটাকে এড়িয়ে একটু নিরিবিলিতে কেবিন নেওয়ার আনন্দই আলাদা। অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, চুপচাপ গোলাকার বৃত্তের মতো কেবিনে বসে গান কিংবা বাইরের মনোরম দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে?'
১৮৯০ সালে অ্যানি উইলসন নামে এক বিলেতি নারী ভারতের মাদ্রাজের উদ্দেশে জাহাজে চড়েছিলেন; তিনি ভারতে যাচ্ছিলেন স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে। ফলে তার সমুদ্রযাত্রা ভাগ্যান্বেষণে যাওয়া বিলেতি নারীদের মতো হয়নি। বরং তিনি আনন্দদায়ক ভ্রমণের কথাই বলেছেন:
'ভারত পৌঁছতে হাতে এখনো অনেক সময় বাকি। ক্যাপটেন সাহেব জানিয়েছেন, আর কয়েক ঘণ্টা পর আমাদের জাহাজ দক্ষিণ আটলান্টিকের সেন্ট হেলেনায় পৌঁছাবে। এই বন্দর থেকে খাবার পানি আর শুকনো খাবার সংগ্রহ করে জাহাজ ভাসবে ভারতের ঠিকানায়। আহ্! কি যে আনন্দ! দীর্ঘ যাত্রায় একটা নতুন বন্দরের দেখা পাব! তারপর ভারত! এই নামেই গায়ে কেমন শিহরণ জাগে! না জানি দেশটা কেমন? হাতে অফুরন্ত সময়! এই সময়ে কী করা যায়? জাহাজের ডেকে উঠলে কেমন হয়? আকাশের গায়ে অসংখ্য তারা, ঠিক যেন ফুলের মতো ফুটে আছে; যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে। আহা! কি অসম্ভব সুন্দর! জাহাজের খোলা ডেক আর ওই বিশাল আকাশের নিচে ইচ্ছেমতো নাচতে মন চাইছে। কিন্তু কে নাচবে আমার সঙ্গে? কেউ কি আছে?'
অ্যানি উইলসন ছিলেন সৌভাগ্যবতী যাত্রী; তিনি সুপরিসর কেবিন পেয়েছেন। সঙ্গে জাহাজের ধনাঢ্য যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত সেবা। কিন্তু বিপরীত ঘটনাও আছে। অর্থকড়ির প্রভাব থাকা সত্ত্বেও অনেক বড়লোককে বাধ্য হয়ে সাধারণ কেবিনে, সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে ভ্রমণ করতে হয়েছে; সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনাও পাওয়া যায়। কেবিনে বসে অ্যানি উইলসনের মতো চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সমুদ্রে গাঙচিলের ওড়াউড়ি দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাদের।
মাঝখানের গোলাবারুদ রাখার মজুত ঘিরে জাহাজের কেবিনগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে বানানো হতো। ফলে খুব সহজেই দু'ধারে অনিচ্ছায় হোক আর স্বেচ্ছায়— অভিজাত শ্রেণি আর নিম্নশ্রেণির কেবিন– এ রকম একটা ভাগ হয়ে গিয়েছিল। গোলাবারুদের এক পাশে সাধারণ সৈনিক এবং যাত্রীদের কেবিন আর অন্য পাশে উচ্চপদস্থ বড় সরাকারি কর্মকর্তা এবং ধনী ব্যাবসায়ীদের কেবিন। বলার অপেক্ষা রাখে না, উচ্চবিত্তদের কেবিন ছিল আকারে বড় এবং ভেতরের দেয়ালে ঝুলত মনোরম নানা রকম চিত্র।
১৮০৫ সালে মিসেস শ্রিউড তড়িঘড়ি করে ভারতগামী জাহাজে উঠেন। বেশ দাম দিয়েই টিকেট কেটেছেন তিনি। কিন্তু তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে সাধারণ যাত্রীদের অংশের কেবিন। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে জাহাজের অভিযোগ বাক্সে অভিযোগপত্র ফেলেন; তাতে তিনি লিখেন:
মিস্টার শ্রিউড তাড়াহুড়া করে জাহাজের টিকিট কেটেছিলেন। চড়া মূল্যে কেনা টিকিটে জাহাজে চড়ে দেখেন, তাকে এক ছুতারের সঙ্গে কেবিন ভাগাভাগি করে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
'আমার কোনো উপায় না থাকায় এই ছুতারের সঙ্গে এক কেবিনে থাকতে হলো। আমার জানামতে, কোনো বিলেতি নারী এমন দুঃসহ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেননি, যেমন আমি করেছি। কেবিনটা ছিল জাহাজের ঠিক মাঝ বরাবর। এর একটা ভালো দিক ছিল, জাহাজটি দুলছিল কম। কিন্তু কেবিনটি এতই ছোট ছিল যে, সেখানে দুজন মানুষের একত্রে ঘুমানোটা কঠিন ছিল।'
(Partick Wheeler, 'Ribbons among the Rajahs: A history of British women in India before the Raj' Publisher Pen & Sword, 2017)

মিসেস শ্রিউড অভিযোগ করলেও তা গ্রাহ্য করার কোনো দায় ছিল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। কারণ, যাত্রীকে জাহাজে ভ্রমণের আগেই একটি চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করতে হতো: তাতে নানা শর্তের সঙ্গে এ রকম কিছু শর্তও জুড়ে দেওয়া ছিল যে, কেবিনের ভেতরের দেয়ালের যাবতীয় শিল্পকর্ম বা কেবিনের যে কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতির জন্যে যাত্রী দায়ী থাকবেন। একজন যাত্রী দেড় থেকে দুই টনের বেশি মালপত্র বহন করতে পারবেন না। টনের হিসেবে একজন যাত্রীর জন্য এটা পর্যাপ্ত শোনালেও ভারত থেকে বিলেতে ফেরত কোনো যাত্রীর জন্যে যথেষ্ট ছিল না।
মালপত্র পরিবহনে কড়াকড়ি আরোপে কি ধরনের মাল পরিবহন করা যাবে, জাহাজ কর্তৃপক্ষ তার তালিকাও নির্দিষ্ট করে দেয়। তালিকাটি ছিল এ রকম:
'ব্যক্তিগত ব্যবহার্য কাপড়, প্রসাধনী, বালিশ, বিছানা, কম্বল, বালিশের কভার, চিজ, হালকা খাবার, রাতের পোশাক, জুতা, সকালের পোশাক, বিকেলের পোশাক, সিল্কের গাউন, হাত-মোজা, চামড়ার ব্যাগ, মাফলার, টুপি, পাগড়ি, হ্যাট, চুল বাঁধার রিবন, তোয়ালে, সোফা, কেবিনেট, চেয়ার, টেবিল, কাঁচি, দাড়ি কাটার সরঞ্জাম, পকেট বুক, বই, কার্পেট, টেবিল ল্যাম্প, পিয়ানো, লেখার টেবিল, টুথ ব্রাশ, পানির বোতল, সাবান, ছোট আয়না, এক পাউন্ড মোম, এক বাক্স বিস্কিট, এক বোতল রাসবেরি ভিনেগার, রাসবেরি জ্যাম, পাউরুটি, জেলি, চকলেট, একডজন ব্রিস্টল পানির বোতল, কালো চামড়ার ট্রাংক এবং এক বাক্স দাঁতের মাজন।'
তবে মালামাল পরিবহন নিয়েও নানা ঘটনা রয়েছে। মিসেস শ্রিউডই জানাচ্ছেন:
'সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে উঠতে গিয়ে দেখি, আমার চেয়েও অনেক দুঃখির দল রয়েছে। নিয়ম ছিল প্রতিটা কোম্পানি (জাহাজ কতৃপক্ষ) দশজন নারীকে চাকর হিসেবে নিয়োগ দেবে এবং জাহাজের যাত্রীদল তাদেরকে পছন্দ করে সঙ্গে নিয়ে যাবে। আমি খুবই ভাগ্যবতী ছিলাম, চাকর হিসেবে মিস এন্ড্রুর পুরাতন চাকর লুক পার্কারের স্ত্রী বেটিকে পেয়েছি। যদিও সে আমার সঙ্গে খুব অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছিল, তবে পরবর্তীকালে দেখা গেল, বেটি চাকর হিসেবে যোগ দিয়ে আমার সঙ্গে ভারত যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু বাকি অনেক নারী জাহাজে চড়তে না পেরে মনের দুঃখে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। আমি কেবিনে বসে বসে পুরো প্রক্রিয়াটি দেখছিলাম। দেখছিলাম, প্রচুর দরিদ্র নারী কেঁদে-কেটে একাকার হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। জাহাজ থেকে বসে এই দৃশ্য দেখা ছাড়া তখন আমার কি-ই-বা করার ছিল!'
এ ধরনের আরও কিছু উদাহারণ দেওয়া যেতে পারে। মেরি ডোহারটি ও তার স্বামী মেজর ডোহারটি— দুজনেই জাহাজে উঠেছিলেন ভারতের উদ্দেশে। সেটি ১৮১৯ সালের কথা। মেরি ডোহারটি স্বামীর সঙ্গে ভারতে যেতে রাজি ছিলেন না। কারণ মেরি ডোহারটির দুটো সন্তান ছিল। প্রথম সন্তান হেনরির বয়স ছিল মাত্র এক বছর নয় মাস, আর দ্বিতীয় সন্তান চার্লসের বয়স আট মাস। এই ছোট বাচ্চাদের নিয়ে মেরি ভারত যেতে কোনোভাবেই রাজি ছিলেন না। তার ইচ্ছা ছিল, যেতে হলে বাচ্চা দুটোকে তাদের খালার কাছে রেখে যাবেন। কিন্তু স্বামী মেজর ডোহারটি জোর করেই বাচ্চাসহ তাকে জাহাজে তুলে আনলেন। একইভাবে এই দৃশ্যগুলো ছিল হৃদয়বিদারক। কেউ কেউ বন্দরে এসে স্বামী-সন্তানকে বিদায় দিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন।

সেই সময়ে ঔপনিবেশিক ভারতে বিলেতি নারীদের কদর ছিল কেমন?
১৯৯৫ সালে মারাঠি ভাষার লেখক ও সাহিত্যিক কিরন নাগরকারের উপন্যাস 'রাবন অ্যান্ড এডি'তে ঔপনিবেশিক ভারতের বিলেতি নারীদের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি উপন্যাসে চরিত্রের প্রয়োজনে উল্লেখ করেছেন,
'পৃথিবীতে দু রকম জাতির মানুষ রয়েছে। প্রথমটি হলো, যারা ইংরেজি ভাষা জানেন; আর দ্বিতীয়টি হলো, যারা জানেন না। ইংরেজি একটি মন্ত্র, এক মহামন্ত্র। এটি একটি উন্মুক্ত সাগর। এটা শুধু নতুন দরজা উন্মুক্ত করে না; বরং নতুন বিশ্বকে উন্মুক্ত করে— যেখানে আপনি একটি বিশ্ব থেকে আরেক বিশ্ব অতিক্রম করতে পারবেন। যদি ইংরেজি জানা থাকে, আপনি কোনো বিলেতি মেয়েকে নাচের জন্যে আমন্ত্রণ জানাতে পারবেন। ইংরেজি জানা থাকলে কোনো ইংলিশ রমণীর ঠোঁটে চুমুও খেতে পারবেন।'
ভারত দেশটা কেমন? সেদেশের মানুষেরা সত্যি কি সভ্য? তার কী খায়? কেমন তাদের জীবনযাপন? ভারতে পৌঁছানোর আগেই বিলেতি নারীদের মনে এ ধরনের শংকা উঁকিঝুকি দিতে শুরু করে। একজন বিলেতি নারী যেভাবেই ভারতে পৌঁছান না কেন, ভারতের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া খুব একটা সুবিধের হয়নি। ভারতের আবহাওয়া গরম, আর সেইসঙ্গে দেশটির নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি, ভিন্ন খাবার-দাবার।
ভারতীয়দের পোশাক, সামাজিক রীতিনীতি, শব্দ, রাস্তাঘাটে মানুষের হৈচৈ, বাড়িঘর— এগুলো একেবারে ভিন্ন রকমের অনুভূতি দিয়েছে সদ্য আগত বিলেতি নারীকে। ভারতের রূপ বিলেতের চিরচেনা পরিবেশের চেয়ে সম্পূর্ণই আলাদা।

১৯৩০ সালে পামেলা হিকসন নামের এক বিলেতি নারী ভারতের মাটিতে পা ফেলে প্রচুর রঙ ঝলমলে পোশাক দেখে ভাবেন, এখানকার মানুষ রঙ চেনে না। তার প্রতিক্রিয়া ছিল এ রকম:
'শাড়ি পরিহিত একদল ভারতীয় নারীকে দেখলে মনে হবে, তারা বুঝি রঙকানা। কারণ, তাদের শাড়িগুলো কমলা, লাল, হলুদ, পিঙ্গল, নীল— সব কটা রঙের বিচিত্র সমাহার, যা কাপড়টির উজ্জ্বলতায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।'
এ ধরনের সমালোচনার পাশাপশি প্রশংসাও রয়েছে; যেমন মিসেস গুথরি, ১৮৭০ সালে ভারত ভ্রমণ করতে এসে মুম্বাইয়ে এক উচ্চবিত্ত ভারতীয় নারীর পরিধেয় দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি তার দিনলিপিতে লিখেন,
'পরনে সাটিনের স্কার্ট আর তার ওপর সবুজ এব্রয়ডারি করা অসাধারণ পোশাক, চিকচিক করা পেছনের চুলে শোভা পাচ্ছে ফুল এবং সেইসঙ্গে গায়ে জড়ানো রয়েছে অনেক দামি সোনার অলংকার।'
(ওমেন অব দি রাজ: দি মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস অব দি বৃটিশ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া: মারগারেট ম্যাককমিলান, র্যানডম হাউস ট্রেড, ২০০৫।)
অন্যদিকে, ভারতের রাস্তাঘাটের অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল— তা বলা চলে না। আঠার শতক কিংবা উনিশ শতকের ভারতের রাস্তাঘাট এবং মানুষ নিয়েও বিস্ময় কাজ করেছে বিলেতিদের। রোসামুন্ড লরেন্স নামে এক ব্যক্তি বিলেত থেকে ভারতে এসেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। তিনি মুম্বাইয়ের একটি ব্যস্ত রাস্তার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে:
'আমার জীবনে আমি এত বেশি বাদামি বর্ণের মুখ একত্রে কখনো হাঁটতে দেখিনি। তাদের পরনে ময়লা সাদা কাপড়, সেনাদের পরিহিত উর্দিগুলো মোটামুটি পরিষ্কার। রাস্তায় ভিক্ষুক আর নেড়ি কুকুরের দল যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তার পাশে রয়েছে বিভিন্ন রকমে গাছগাছালি; আর সেই গাছপালা থেকে কানে আসছে মিষ্টি কোকিলের ডাক।'

বিলেতি নারীদের চোখে ভারত ছিল পুরো কল্পনায় দেখা একটি দেশ। তবে কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে ফারাক ছিল যথেষ্ট। ফলে তারা এখানে এসে ভারতকে আবিষ্কার করেছেন নানা মাত্রায়। এমিলি ম্যাটকালফে ১৮৪৭ সালে ভারত এসেছিলেন, এখানে অবস্থানরত তার বাবাকে দেখতে। তার বর্ণনায়, 'গাছগুলো কত সুন্দর, কত সুন্দর সুন্দর ফুল, দেখলে মনে হবে যেন সাক্ষাৎ এক স্বর্গ।'
কিন্তু বিপরীত প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। ১৮৯০ সালে অ্যানি উইলসন ভারতে এসেছিলেন তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে। সরকারি চাকুরে ছিলেন স্বামী। অ্যানির অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। তিনি ভারতে এসে নিজেকে নিঃসঙ্গ এবং একাকী ভাবতে শুরু করেন। বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে সেই আভাসও পাওয়া যায়: 'আমি শপথ করে বলছি, অতিমাত্রায় জনতার ভিড়-ভাট্টা আমাকে প্রতিনিয়তই ভীতু করে তুলছে।'
উনিশ শতকের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, কলকাতায় ইউরোপিয়ানদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার, মুম্বাইয়ে ১২ হাজার আর মাদ্রাজে ৬ হাজার। কর্মক্ষেত্রে বিলেতিরা শহর বেছে নিলেও অনেকের ভাগ্যে 'মফস্বলে'র মতো পিছিয়ে থাকা শহরগুলোতেও চাকরি করতে হয়েছে। যারা ধর্ম প্রচারে ব্রত ছিলেন, পোস্টমাস্টার, শিক্ষক, সেবিকা— এ ধরনের পেশার অনেক ইংরেজই শহরতলিতে নিজেদের জীবন কাটাতে বাধ্য ছিলেন। সেসব জায়গায় আরাম-আয়েশের আশায় আসা বিলেতি নারীদের জীবনযাপন ছিল আরও শোচনীয়।

১৯১১ সাল নাগাদ কলকাতাই ভারতর্ষের প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় সব ইউরোপিয়ানদের চোখ থাকত এই শহরের দিকে। ফলে, কলকাতায় বিলেতিদের ভিড় বেশি ছিল। অন্য জায়গায় স্বামীর পোস্টিং হওয়া স্ত্রীর দিন কীভাবে কাটত, তার একটা উদাহরণ পাওয়া যাবে অ্যানি উইলসনের কথাতে: তার স্বামী ১৯০০ সালে পাঞ্জাবের জেলা কমিশনার ছিলেন। বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে অ্যানি জানান, তিনি প্রায় সারাক্ষণই বাড়ির প্রবেশ পথের দিকে চেয়ে থাকতেন, স্বদেশীয় কারও দেখা পাওয়ার আশায়।
বিলেতি নারীদের অনেকেই চেষ্টা করেছেন স্থানীয়দের সঙ্গে মেশার; কিন্তু ভারতীয়দের প্রতি অবিশ্বাস দূর করতে পারেননি তারা মন থেকে। ভারতীয়দেরকে সব সময়ই সন্দেহের চোখে দেখা হতো। সে কারণে নিজ বাড়ির আঙিনাই ছিল তাদের একমাত্র রাজত্ব। এখানেই তাদের দিন কাটত— কবে বিলেত থেকে চিঠি আসবে, সেই আশায়। আর কখনো কখনো তারা কেউ ঘরে বসে পিয়ানো বাজাতেন, কেউ বই পড়েই সময় কাটিয়ে দিতেন।
বিলেতি নারীর ঘরবাড়ি
ইংল্যান্ড থেকে বিলেতি নারীরা ভারতে এসেছিলেন ভাগ্য ফেরাতে। কাজেই, তাদের আগমণ মূলত ইংল্যান্ডের দরিদ্র পরিবার থেকে। ভারতে এসেই তারা সবাই হয়ে যেতেন মেমসাহেব। তারা এখানে ডাকবাংলো ধরনের বিশাল বাড়িতে থাকতেন। যথেষ্ট আয়েশের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা থাকত। বাসার কাজের জন্য ভারতীয় নারী-পুরুষ সদা নিয়োজিত। পাখা টানার জন্যে থাকত ভারতীয় চাকর। তবে বিপুল আরাম-আয়েশের পরও অনেক বিলেতি নারীকে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। দুয়েকজন বাদে, তাদের বেশিরভাগেরই ভারতীয়দের প্রতি প্রসন্নতা ছিল না। আচার-ব্যবহার-কেতা নিয়ে ছিল অভিযোগ।
ওয়ালেস ডানলপ নামের এক বিলাতি নারী আক্ষেপ করে বলছেন, "চাকরগুলো শোবার কক্ষে কোনো রকম শব্দ না করেই ঢুকে পড়ে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, কিছু কালো চোখ যেন আমাকে অনুসরণ করছে। বাড়িগুলোতে 'প্রাইভেসি' বলতে কিছুই নেই।"
এডিথ কুটহেল নামে এক ব্রিটিশ নারীর বয়ানে পাওয়া যায়, তার বাড়িতে নারী-পুরুষের জন্য পৃথক বসার ব্যবস্থা ছিল। বাঁশের তৈরি লম্বা চেয়ার পুরুষদের জন্য; ওই চেয়ারের হাতল এবং পা রাখার জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। বেতের ছোট চেয়ার, কাঁচের খাঁজ কাটা চেয়ার এবং মেহগনি কাঁঠের নরম গদি বসানো চেয়ার ছিল নারীদের জন্য। সেখানে বসে বিলাতি নারীরা বৈকালিক চা পান এবং পরস্পর গল্পগুজব করে সময় কাটাতেন।
বাথরুম নিয়ে বিলেতি নারীদের আলাদা দুর্বলতা সব সময়ই ছিল। বিশেষ করে, বাথরুমগুলো অবশ্যই মূল শোবার ঘরের সঙ্গে যুক্ত থাকত।

ইথেল সেভি নামে এক বিলেতি নারী ভারতে এসেছিলেন উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। তার স্বামীর পোস্টিং বরাবর মফস্বলে হওয়ায়, তার ভারতজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিভিন্ন মফস্বল শহর ঘুরে ঘুরে। অন্য বিলেতি নারীদের মতো তিনি আয়েশি জীবনযাপন করতে পারেননি। এই নিয়ে তার সীমাহীন দুঃখ ছিল। সবচেয়ে বেশি খেদ ছিল শৌচাগার নিয়ে। তার বর্ণনায়:
'আমাদের গোসলখানার চৌবাচ্চাটার উচ্চতা দুই ফুটের মতো। সেটায় সব সময় পানি ভরে রাখা হতো। সেই চৌবাচ্চায় গোসলের জন্য ছিল টিনের একটি মগ। সেই টিনের মগ দিয়ে চৌবাচ্চা থেকে পানি গায়ে ঢেলে গোসলের ব্যবস্থা ছিল। গোসলের ময়লা পানি নিষ্কাশনের জন্যে বাথরুম থেকে ছোট বাগানের মাঝ বরাবার ছিল ছোট্ট একটি চিকন খালের মতো। সেখান দিয়ে পানির ধারা বাগানে ছড়িয়ে পড়ত। চৌবাচ্চার পাশেই ছিল কাঠের কমোড। সেই কমোডের ডান পাশে কাঠের বাক্সে থাকত থানডারবক্স। থানডারবক্সে টিসু পেপার মজুত থাকত। অনেক সময় থানডারবক্সে পর্যাপ্ত টিসু মজুত থাকত না। তখনই হতো বিপদ। সেই দুঃসময়ে টিসুর বিকল্প হিসেবে টিনের মগের পানি ছাড়া আর কোনো গতি থাকত না।'
ভারতের মাটিতে কয়েকজন স্মরনীয় বিলাতি নারীদের কথা
ঔপনিবেশিক ভারতে এমন ক'জন বিলেতি নারীর নাম আমরা জানি, যারা শুধুমাত্র নিজেদের ভারতীয় বলেই পরিচয় দিতেন না, উপরন্তু তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেইসঙ্গে তারা বিলেতি সমাজের কঠোর সমালোচকও ছিলেন। এই বিলেতি নারীরা ভারতকে নিজের দেশ মনে করেছিলেন এবং মৃত্যূর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ভারতীয় হয়ে থাকার চেষ্টা করেছেন।
১৮৬৭ সালে আয়ারল্যান্ডের ছোট একটি গ্রামে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের জন্ম। বাবা স্যামুয়েল রিচার্ড নোবেল ছিলেন পাদ্রী। তিনি বিশ্বাস করতেন, খোদার সৃষ্টির সেবা করাই মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ ইবাদত। বিশ্বাসের এই মন্ত্র তিনি কন্যা মার্গারেটকে রপ্ত করাতে পেরেছিলেন।
মার্গারেট পড়াশোনা করেছেন লন্ডনের হেলিফেক্স কলেজে এবং পরবর্তীকালে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু তার মনে শান্তি ছিল না। তিনি এক সময় মানবতা, শান্তি এবং নির্যাতিত মানুষকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে লন্ডনের শিক্ষিত সমাজে মার্গারেট একজন সমাজবাদী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।

১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দ লন্ডনে এলেন ধর্ম এবং মানবতা নিয়ে এক বক্তৃতায় অংশ নিতে। বক্তৃতার দিন দর্শকসারিতে মার্গারেটও ছিলেন। স্বামী বিবেকান্দের ভাষণে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন, স্বামীর সঙ্গে ভারতে চলে যাবেন এবং জীবনের বাকি সময়টা মানবতার জন্যে উৎসর্গ করবেন। তার ভাষায়, 'স্বামী যদি লন্ডন না আসতেন, তাহলে আমার গোটা জীবনটাই অসমাপ্ত থেকে যেত। আমি সব সময় বিশ্বাস করতাম, ভালো কিছু একটা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার বিশ্বাস ছিল, ভালো কিছু আমাকে ডাকবে এবং আমি সেখানে জড়িত হব।'
১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের ইচ্ছা অনুযায়ী মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল তার সব আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব লন্ডনে ফেলে কলকাতায় চলে আসেন। ভারতে আসার পর তার নতুন নাম স্বামীজি দিলেন 'সিস্টার নিবেদিতা'। তিনি কলকাতায় এসে বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করলেন এবং স্বামীজির দীক্ষায় নিজেকে তৈরি করলেন।
সিস্টার নিবেদিতা আজীবন মানবতার জন্যে, ভারতের নিপীড়িত মানুষের জন্যে এবং মানব কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯১১ সালে এই নারীর মৃত্যু ঘটে।
বিলেতি নারী অ্যানি বেসান্ত যখন লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছিলেন, তখন তার সঙ্গে গান্ধির পরিচয় হয়। তারপর ইংল্যান্ডে নানা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করে ১৮৯৩ সালে তিনি লন্ডন থেকে ভারতের মাদ্রাজে পাড়ি জমান।
ভারতে এসেই অ্যানি খোদ ইংরেজ প্রশাসনের কড়া সমালোচনায় নেমে পড়েনএবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যান। ব্রিটেনের প্রতি প্রকাশ্যে সমালোচনার কারণে অ্যানি বেসান্ত ১৯১৭ সালে গ্রেপ্তার হন।

জেল থেকে বের হওয়ার পর অ্যানি বেসান্তকে কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচন করা হয়। তিনি কংগ্রেসের ইতিহাসে প্রথম নারী সভাপতি। ভারতের স্বাধীনতার জন্যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আজীবন নিয়োজিত ছিলেন তিনি। ১৯৩৩ সালে মাদ্রাজে নিজ বাড়িতে তার মৃত্যু হয়।
উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকেই মিশনারির কাজে প্রচুর বিলেতি নারী ভারতে আসতে শুরু করেন। তাদের অনেকেই আর বিলেত ফিরে যায়নি। তাদের মহত্বের কাহিনি আরেক লেখায় উঠে আসবে।
- গ্রন্থ সহযোগিতা
- ১) Partick Wheeler, 'Ribbons among the Rajahs: A history of British women in India before the Raj' Publisher Pen & Sword, 2017
- ২) মরাগারেট ম্যাকমিলান, ওমেন অব দি রাজ: দি মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস এন্ড ডটারস অব দি বৃটিশ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া। রেনডম হাউস ট্রেড, ২০০৭)
- ৩) আদনান সৈয়দ, ঔপনিবেশিক ভারতে বিলাতি নারীরা, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা ২০১৬