ভারতে হিন্দু মন্দিরের প্রথাকে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ দাবি করে অপপ্রচার

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে ভারতের গণমাধ্যমে। দেশটির সামাজিক মাধ্যমে এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে বাংলাদেশে উচ্ছৃঙ্খল মুসলিম জনতার একটি প্রতিমা ভাঙচুরের দৃশ্য সেটি।
তবে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে বাংলাদেশের লাগোয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি গ্রামে। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের প্রথাগত একটি আচার অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে দেবী কালীর মূর্তিটিকে খণ্ড-বিখণ্ড করছিলেন। একে প্রতিমা নিরঞ্জন বলা হয়। আয়োজকদের একজন এ তথ্য জানিয়েছেন বার্তাসংস্থা এএফপিকে।
এদিকে গত ২ ডিসেম্বর ফেসবুকে সেই ভিডিও শেয়ার করে হিন্দিতে লেখা হয়েছে, 'গতকাল বাংলাদেশে মুসলমানরা কালীবাড়িতে (কালী মন্দিরে) আক্রমণ করে মা কালী ও আর সব দেব-দেবীর মুর্তি ভাঙচুর করেছে। মন্দিরের ভেতরে থাকা সব ভক্তকে এসময় হত্যা করা হয়। এতে গুরুতর আহত হয়েছেন আরও ২০ জন হিন্দু। অথচ, বাংলাদেশে হিন্দুদের হত্যার বিষয়ে পুরো বিশ্ব নীরব।'
ফেসবুকের যে ব্যবহারকারী ভিডিওটি এভাবে শেয়ার করেন তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা ১ লাখ ১১ হাজারেরও বেশি।
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার। হিন্দু সম্প্রদায় তাঁর দল আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক বলে একটা ধারণা প্রচলিত আছে। হাসিনার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ক্ষুদ্ধ জনতার হামলার ঘটনা ঘটে। তারমধ্যে কয়েকজন হিন্দুও ছিলেন। তবে রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া ব্যক্তিরা সেভাবে বিদ্বেষের শিকার হননি। কিন্তু, ভারতের গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশে হিন্দুদের গণহত্যা ও ব্যাপক নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। দেশটির বিভিন্ন রাজনীতিবিদও এবিষয়ে নানান সময়ে মন্তব্য করেছেন।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রক্ষ্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে চিন্ময়কে হাজির করার সময় তার সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ওইদিন চিন্ময় সমর্থকরা সাইফুল ইসলাম নামের একজন আইনজীবীকেও হত্যা করে।
এসব প্রেক্ষাপটে, ভারতে আরও জোরেশোরে হিন্দু নির্যাতনের প্রচার চালানো হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম 'এক্স' ও ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এই ভিডিও।
তবে ভিডিওতে যে দৃশ্য দেখা গেছে, তেমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি। এছাড়া, ওই পোস্টের দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশের কোনো হিন্দু মন্দিরে গণহত্যার মতো ঘটনাও জানা যায়নি বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমটি তুলে ধরেছে।
পশ্চিমবঙ্গের ওই মন্দিরের প্রথা
ভিডিওটির কি ফ্রেম ও কি ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করে দেখা গেছে, ভিডিওটি ভারতে ধারণ করা, বাংলাদেশের নয় যেমনটা পোস্টে দাবি করা হয়েছে।
ওই আচারের ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ধারণ করা আরেকটু বেশি সময়ের একটি ভিডিও গত ২৭ নভেম্বর ফেসবুকে শেয়ার করা হয়।
https://www.facebook.com/watch/?v=1560732901496639
ভিডিও'র ক্যাপশনে বাংলায় লেখা ছিল, 'সুলতানপুর কিরণময়ী পাঠাগারের ১২ বছর পর মা কালীর পর প্রতিমা নিরঞ্জন'। পশ্চিমবঙ্গের সুলতানপুর নামের এই গ্রামটি বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া।
ফেসবুকে অপপ্রচারে ব্যবহার করা ভিডিও'র (বামে) সাথে দীর্ঘসময়ের ওই ভিডিওটির (ডানে)স্ক্রিনশট তুলনা করে নিচে দেখানো হলো–

মূল ভিডিওতে সুলতানপুর গ্রামকে জিওট্যাগ করা হয়, যার সাথে মিলিয়ে ঘটনাস্থল যে ওই গ্রাম-ই সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে এএফপি।
প্রতিমা নিরঞ্জনের আয়োজক সংগঠন সুলতানপুর কিরণময়ী পাঠাগারের একজন সদস্য দেবাশীষ মন্ডল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে এই ভিডিও প্রচারের দাবিকে অস্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, 'কালী প্রতিমাকে অনেক টুকরো করে ভেঙে তারপর জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। এটা আমাদের প্রতিষ্ঠিত একটি আচার, যা ১২ বছর পর পর করা হয়। অনেক মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। এর সাম্প্রদায়িক কোনো উদ্দেশ্য নেই। '
এছাড়া, গত ২১ অক্টোবর বাংলা সংবাদপত্র দৈনিক স্টেটসম্যানে ওই আয়োজনের সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকার ছাপা ছবির সাথেও ভিডিওতে দেখানো ওই কালী মূর্তি ও পটভূমির মিল রয়েছে।