সুচিত্রা সেনের শাড়ি ও তুরাগ পাড়ের হারিয়ে যাওয়া শহরের গল্প

প্রদীপ কুমার দাসের (৪৮) দাদার বাবার নাম ছিল যুধিষ্ঠির কৈবর্তদাস। তার ছেলে কানাইলাল কৈবর্তদাসের তিন ছেলে—রাধাশ্যাম, নিতাই ও গৌর দাস। এ পরিবারেরই পরের প্রজন্মের একজন হলেন প্রদীপ। দীর্ঘকাল ধরে মৎস্য শিকার ও কৃষিকাজই তাদের পেশা।
সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ছিলেন তিনি। এ ওয়ার্ডের ১২০০ ভোটারের মধ্যে ৪০ শতাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী।
প্রদীপ দাসের জানামতে, তুরাগ নদের দ্বীপ বিরুলিয়ায় বসতি শুরু প্রায় আড়াইশ বছর আগে। বর্ষায় চারপাশ প্লাবিত থাকত, শুকনো মৌসুমে মাটির পথ উন্মোচিত হতো। নদীর তলা থেকে জমি উঁকি দিত আর প্রদীপের পূর্বপুরুষেরা সেখানে ধান চাষ করতেন।
বিরুলিয়ায় জেলে ও কৃষকের সংখ্যা কম ছিল না, তবে এখানকার পরিচিতি ছিল ভূস্বামীদের কারণে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এখানে ১৩ জন জমিদার ও বণিক তাদের প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেন।

নজির হিসেবে প্রদীপ দাস উল্লেখ করেন বিরুলিয়া হাই স্কুলের, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৪ সালে। তখনকার দিনে অনেক জেলাতেও ১০টি হাই স্কুল ছিল না, আর দেশের মোট জেলা ছিল মাত্র ১৭টি।
'মেইড ইন ইংল্যান্ড' লেখা ছিল
তুরাগ নদের তীরঘেঁষা সমৃদ্ধ পুরনো নগরী বিরুলিয়া। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আলিফ বাসে বিরুলিয়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে যেতে ভাড়া লাগে ২০ টাকা। আশুলিয়াগামী সড়ক থেকেই বিরুলিয়ার উঁচু টেকটি চোখে পড়ে।
সবচেয়ে নজর কাড়ে বিশাল বটগাছটি। প্রায় আধা বিঘা জায়গা জুড়ে এর ছায়া। প্রদীপ দাসের ধারণা, গাছটির বয়স প্রায় ২০০ বছর। এটি মূল ভূখণ্ড থেকে কিছুটা দূরে হলেও বিরুলিয়ার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।
এখানে গাছটি পূজিত হয়। একসময় প্রভাবশালী একজন সেখানে ইটভাটা গড়তে চেয়েছিলেন, তবে দৈবিক কারণে তা টিকতে পারেনি বলে জনমনে বিশ্বাস। প্রতি পহেলা বৈশাখে এখানে মেলা বসে।

জমিদার রজনীকান্ত ঘোষ তার বাড়ির বারান্দা থেকে এ বটগাছ দেখে চোখ জুড়াতেন। তার বাড়িটি ছিল তুরাগ নদীর একেবারে ধার ঘেঁষে।
রজনীকান্ত এ জমিদারি কিনেছিলেন সাভারের জমিদার নলিনীমোহন সাহার কাছ থেকে, যিনি বিরুলিয়ায় প্রথম বসতি স্থাপনকারী জমিদারদের একজন। বর্তমান ডেইরি ফার্ম ও মিলিটারি ফার্ম ছিল তার তালুকের অন্তর্ভুক্ত। নারায়ণগঞ্জ এবং পুরান ঢাকায়ও তার বাড়ি ছিল।
বিরুলিয়ায় তার প্রাসাদ কমপ্লেক্সে ছিল ছোট-বড় ১০টি ভবন। রজনীকান্তের ভাই রামচন্দ্রের নাতি শিবু ঘোষ জানান, তার দাদু বাড়িটি নলিনীমোহন সাহার কাছ থেকে কিনে নতুন করে নির্মাণ করেছিলেন।
'১৯১০ সালের দিকে বাড়িটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল ৬৪ হাজার টাকা। বাড়ির মার্বেল পাথর, লোহার শিক, করিন্থিয়ান কলাম, কড়ি-বর্গাসহ অনেক উপকরণ লন্ডন থেকে আনানো হয়েছিল। আমরা সেগুলোর গায়ে "মেইড ইন ইংল্যান্ড" খোদাই করা দেখেছি।'

রজনীকান্তের বাড়িটি এখন ধ্বংসের পথে। পলেস্তরা খসে পড়েছে, লাল ধূসর দেওয়ালে শুধুই অতীতের স্মৃতি। রজনীকান্তই প্রথম বটগাছটির গোড়া তিন ইঞ্চি ইট দিয়ে বাঁধাই করে দিয়েছিলেন।
তুরাগের উপহার বিরুলিয়া
তুরাগের এ জায়গাকেই কেন বণিক-জমিদাররা বসতির জন্য নির্বাচন করেছিলেন? জানতে চাইলে প্রদীপ দাস বললেন, 'এটা একটা সেন্টার পয়েন্ট। এখান থেকে ঢাকা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, সাভার—সব দিকের যোগাযোগ সহজ। তুরাগের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
সে কারণেই জমিদার বা বণিকেরা ব্যবসা-বাণিজ্য যেখানেই করতেন (নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, ভৈরববাজার, গোয়ালন্দ ঘাট, চাঁদপুর, আসাম বা ত্রিপুরা), শেষে এসে বিশ্রাম নিতেন এখানেই।'
বিরুলিয়ার বণিকেরা মূলত ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। পোদ্দারও (স্বর্ণ ব্যবসায়ী) ছিলেন অনেকে। আরও ছিলেন মুদি মাল বা ভূষি মালের কারবারিরা।

ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে ভাওয়াল রাজার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল বিরুলিয়া। পরে বিরুলিয়ার বণিকেরা কাশিমপুর, শ্রীপুর-বরমী, টঙ্গী, মধুপুর গড়ের জমিদারি কিনে নেন ভাওয়াল রাজাদের কাছ থেকেই। বিরুলিয়া তাদের জন্য ছিল সৌভাগ্যস্বরূপা।
নিতাইলাল সাহার ভাগ্যাকাশে সূর্য হেসে উঠলে সে বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়।
ঢাকেশ্বরীর শাড়ি
নিতাইলাল সাহার উল্লেখ অনেকেই করেছেন, বিস্তৃত করেছেন ইতিহাস গবেষক আপেল মাহমুদ। তিনি লিখেছেন, আদি ঢাকাইয়া নাট্যকার সাঈদ আহমেদ ব্রিটিশ আমলে বাহাদুর শাহ পার্কের এক ধারের একটি কাপড়ের দোকানের কথা বলেছেন, যার নাম ছিল 'ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়'।
এটি চালাতেন নিতাইলাল সাহা। এ দোকানটিই পরে কলকাতায় 'আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়' নামে খ্যাতি লাভ করে এবং দারুণ সুনাম অর্জন করে। এর খদ্দেরদের তালিকা কেবল দীর্ঘ নয়, তাকও লাগিয়ে দেয়।
সুচিত্রা সেন থেকে শুরু করে রেখা, শর্মিলা ঠাকুর, মাধুরী দীক্ষিত বা ঐশ্বরিয়া রাই—অনেকেই এখান থেকে শাড়ি কিনেছেন।

আপেল মাহমুদ জানাচ্ছেন, শুধু নায়িকারা নয়, এ দোকান থেকে শাড়ি কিনতে পছন্দ করতেন লেখিকা, রাজনৈতিক নেত্রী বা ফার্স্ট লেডিরাও। বলা হয়ে থাকে, সঞ্জয় লীলা বানসালির দেবদাস ছবির শাড়ি জোগান দেওয়া হয়েছিল আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় থেকে।
আর সেগুলো না-কি তারা তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন মিরপুর বেনারসি পল্লী থেকে।
কলকাতার গড়িয়াহাট জংশনে আদি ঢাকেশ্বরীর বড় দোকানটায়ও গিয়েছিলেন আপেল মাহমুদ। দোকানি তাপস সাহা তাকে বলেন, তুরাগ নদের বিরুলিয়া গ্রামে নিতাই সাহার বাড়ি ছিল।
নিতাই সাহা ধর্মভীরু ছিলেন। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নামানুসারে দোকানের নাম রেখেছিলেন। দেশভাগের পর অব্যাহত দাঙ্গায় সব ফেলে চলে আসেন তিনি, সঙ্গে নিয়ে আসেন শুধু বটবৃক্ষের একটি ছবি।
ওই বৃক্ষের সামনে বসে তিনি পূজা-অর্চনা করতেন। ছবিটি আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের ক্যাশ কাউন্টারের ওপরে ঝোলানো দেখা যায়।

তুরাগ ছিল কহর দরিয়া
জমিদার রজনীকান্তের নাতি শিবু ঘোষ বললেন, নিতাই বাবু চৌষট্টির দাঙ্গার পর কলকাতায় পাড়ি জমান। পরে একবার ফিরে এসে বটগাছের তলা আবার বাঁধাই করে দিয়েছিলেন।
'তখন আমার বাবা-জ্যাঠারা বলেছিলেন, "কী নিতাই, আমাদের অনুমতি নিলা না?" নিতাই বাবু খুব আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, "এখানেই আমার প্রাণ পড়ে থাকে গো, বাবুরা। আমি দেবতাকে সামান্য অর্ঘ্য নিবেদন করতেছি, আপনারা বিনীত অনুমতি দেন।"'
'ভক্তিতেই মুক্তি' কথাটিকে সার্থক করেছিলেন নিতাই সাহা, মনে করিয়ে দিলেন প্রদীপ দাস।
তুরাগ থানার মিরপুর বেড়িবাঁধ থেকে বিরুলিয়া যাওয়ার একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তাও রয়েছে। শুকনো মৌসুমে এ পথে ট্রলার দিয়ে শীর্ণা কহর দরিয়া পার হতে এখন মাত্র পাঁচ মিনিট লাগে। স্থানীয়দের কাছে তুরাগ নদ 'কহর দরিয়া' বা 'কষ্টের সাগর' নামে পরিচিত ছিল। টঙ্গী থেকে বিরুলিয়া পর্যন্ত বিশাল জলরাশি পার হতে এলাকাবাসীকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হতো। তাই এর নাম 'কহর দরিয়া'।

বিরুলিয়ার ঘাটে তখন কহর দরিয়ার বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ত। সেখানে বড় বড় জাহাজ আর বজরা ভিড়ত। সাহারা ঘাটে বসে নিলাম পরিচালনা করতেন।
তারক সাহার মঙ্গলালয়
সাহাদের মধ্যে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ছিলেন তারক চন্দ্র সাহা। আজও এলাকার মুরুব্বীরা তার নাম মনে করতে পারেন। তার ভাই গোপীবল্লভ সাহার প্রতাপও ছিল প্রবল। প্রদীপ দাসের ভাষ্যমতে, তারক সাহা ৪৫ বছর ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিই ইট বিছানো পাকা পথ এবং কহর দরিয়ার পারে সিমেন্ট বাঁধানো ঘাট নির্মাণ করেছিলেন।
বৃদ্ধ মতলব আলী জানাচ্ছেন, তারক সাহার বাড়িতে বড় বড় মশাল জ্বলতে দেখেছেন তিনি। ঝাড়বাতিও জ্বলত। তখন তিনি অনেক ছোট ছিলেন। বাড়িটির শান-শওকত এত বেশি ছিল যে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে পারতেন না।
তারক সাহার বাড়িটির নাম 'শ্রীসর্ব্বমঙ্গলালয়'। নীল চীনামাটির আখরে লেখা নামটি আজও বিলক্ষণ পড়া যায়।
বিরুলিয়ার অতীতের জৌলুস

বিরুলিয়ায় একসময় ১৬–১৭টি প্রাসাদোপম বাড়ি ছিল। আজও কিছু বাড়ির জৌলুসের টুকটাক চিহ্ন রয়ে গেছে, যা দেখে তার যৌবনকাল আন্দাজ করা যায়। তবে অধিকাংশ বাড়িবাড়িই ধ্বংসদৈত্যের গ্রাসে পড়ে ধুকছে।
বিরুলিয়ার সবচেয়ে দুঃসময় গেছে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময়। প্রদীপ দাস জানালেন, তখন ৪৫ দিন ধরে বিরুলিয়ায় আগুন জ্বলেছিল। বাড়ির বারান্দা, চৌকাঠ, আড়ার জায়গায় কালো কালো ছোপ পড়ে গেছে। অনেক জায়গা খসে খসে পড়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা যারা এখনো আছি, তারা স্মৃতির প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে থাকি আর হাপিত্যেশ করি। আমাদের জমিদারের নাতি-পুতিরা এখন অটোরিকশা চালায়, চা বিক্রি করে বা মুড়ি-মশলার সেলসম্যান।'
বিরুলিয়ার টেক থেকে একটু দূরে তিন মাথার একটি হিজল গাছ দেখা যায়। বটগাছটি আরেকটু দক্ষিণে। দিনমান তারা নিরবতায় জেগে থাকে, আর রাতে নিস্তব্ধতায় ডুবে যায়।
দেখতে দেখতে কেবলই মনে হচ্ছিল, কহর দরিয়ার ধাক্কা সামলে টিকে থাকা গাছগুলোর রজনী ঘোষ বা তারক সাহার কথা মনে আছে তো? তারা ভাবে কি, বজরার যে মাঝিরা কাজ সেরে দুদণ্ড জিরিয়ে নিত—কোথায় হারিয়ে গেছে তারা?
ভয় হয়, নগরায়নের ধাক্কায় গাছগুলোই না একদিন হারিয়ে যায়!
ছবি: সালেহ শফিক/টিবিএস