মিথ্যা মামলার জাল: শিক্ষক থেকে রিকশাচালক, ১০ বছর পর রেহাই

৬ হাজার টাকা চুরির অভিযোগ ১০ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক। দীর্ঘদিন চুরির এই গ্লানি বহনের পর অবশেষে প্রমাণ হলো, তিনি নির্দোষ। বরং ৩০ সেপ্টেম্বর মামলা খারিজের সময় আদালত বাদী, ডাক্তার, তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থাও নিয়েছেন।
নিরাপরাধ সত্ত্বেও চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া ওই শিক্ষকের বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায়। রাজাখালী ফজুন্নেছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী এই শিক্ষককে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়ে পরিবার ও মামলার খরচ বহন করতে রিকশা চালাতে হয়েছে।
২০১০ সালে আবু বকর সিদ্দিকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে পেকুয়া থানায় এজাহার দায়ের করেন একই উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মুদাচ্ছের মুরাদ। এজহারে তিনি চুরির সঙ্গে মারধরের অভিযোগও করেন।
মামলার পর ২০১০ সালের অক্টোবর আবু বকর সিদ্দিককে সরকারি চাকরি হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর কক্সাবাজারের চকরিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক রাজীব কুমার দেব ওই মামলার রায় প্রদান করেন। রায়ে শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিকসহ সকল অভিযুক্তকে খালাস দেওয়া হয়।
১৩ পৃষ্ঠার ইংরেজি রায়ে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, 'মহান পেশায় যুক্ত একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মাত্র ৬ হাজার টাকার চুরির অভিযোগ আইনের চোখে ও মানবিক বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। শুধুমাত্র প্রতিশোধপরায়ন হয়ে একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসানো হয়েছে। একজন শিক্ষকের জীবন থেকে যৌবনের ১০ বছর চলে গেছে। যিনি শিক্ষকতার মহান পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন জাতিকে শিক্ষিত করার জন্য, আদালত এক্ষেত্রে সবাইকে খালাস করে ক্ষান্ত হননি; বরং অভিযোগকারীসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।'
মামলার আদেশে বাদীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে মেডিকেল সার্টিফিকেট সরবরাহের কারণে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সাবেক আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. সাইফুল ইসলামকে ২০০ টাকা জরিমানার দণ্ড, অনাদায়ে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এছাড়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পেকুয়া থানার সাবেক এসআই মো. আব্দুল কাদিরকে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় অবহেলা ও গাফিলতির কারণে কেন তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না- এই মর্মে কারণ দর্শানো হয়।
চকরিয়া আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট শহিদুল্লাহ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, মামলার রায়ে শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিকের নামে কক্সবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার কর্তৃক ইস্যুকৃত বরখাস্তের অফিস আদেশ প্রত্যাহারপূর্বক বকেয়া বেতন ও সকল বঞ্চিত সুবিধাসহ চাকরি ফিরিয়ে দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, '২০০৮ সালে পেকুয়া উপজেলার নাপিতখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুদাচ্ছের মুরাদসহ আমরা কক্সবাজার প্রাইমারি টিসার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণে ছিলাম। প্রশিক্ষণে থাকাকালে শিক্ষকদের মধ্যে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ওই ম্যাচে বিরোধের জের ধরে আমিসহ আরও কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে তার বৈরিতা হয়। বিষয়টি তখন সমাধানও করেছিল পিটিআই কর্তৃপক্ষ। এরপর ২০১০ সালে মুদাচ্ছের মুরাদ তার একটি পারিবারিক মামলায় আমাকে বিনা কারণে আসামি করেন, যার ক্ষত আমি প্রায় এক যুগ ধরে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম।'
তিনি আরও বলেন, 'মিথ্যা মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। প্রায় ১২ লাখ টাকা ধার-দেনায় জর্জরিত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে এক পর্যায়ে কক্সবাজার জেলা শহরে আমাকে রিকশা চালাতে হয়। পরবর্তীকালে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সেই পেশাও ছেড়ে আসতে হয়েছে।'