রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যথায় চিৎকার করে, কিছু করতে পারি না: গাজার চিকিৎসক

প্রয়োজনীয় ওষুধ ও বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে ইতোমধ্যেই সংকটে থাকা গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, তারা অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই রোগীদের চিকিৎসা করছেন, অবস্থা না থাকায় দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্তরা হাসপাতালে এলেও তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর যতটুকুও বা চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে, সেটিও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। খবর বিবিসির।
এক চিকিৎসক বললেন, 'পেইনকিলার (ব্যথানাশক) নেই। রোগীরা ব্যথায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিৎকার করছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, গাজার এই স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বর্ণনার মতো 'কোনো ভাষা নেই'।
সংস্থাটি জানিয়েছে, রবিবার থেকে গাজার ২৩টি হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ১২টি হাসপাতাল আংশিকভাবে চালু রয়েছে এবং একটি কোনো রকমে চালু রয়েছে। ইসরায়েলি বিমান হামলা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর ঘাটতি ইতোমধ্যেই সংকটে থাকা গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলেছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ বলছে, হামাস 'সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য কৌশলের সঙ্গে হাসপাতাল ও চিকিৎসা পরিষেবাগুলো ব্যবহার করছে।'
এক বিবৃতিতে এটি জানায়, আইডিএফ ''হাসপাতালে 'হামলা' করেনি, তারা কেবল সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় প্রবেশ করেছে… হামাসের অবকাঠামো ও সরঞ্জামগুলো নিষ্ক্রিয় ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে।''
বিবৃতিতে গাজায় মানবিক সহায়তা ও চিকিৎসা সামগ্রী প্রবেশের অনুমতি চালু রেখেছে বলে দাবি করা হয়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ মানবিক সহায়তা পরিচালনাকারী সংগঠনগুলো বলছে, গাজায় সহায়তা প্রবেশে ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞার মতো ঘটনা ঘটছে।
হাসপাতালে রোগীর চাপ
স্বাস্থ্যকর্মীদের মতে, গাজার বেশিরভাগ হাসপাতালেই রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। সংকট রয়েছে চিকিৎসা সরঞ্জামেরও। এমনও তথ্য রয়েছে যে দক্ষিণ গাজার কিছু কিছু হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়েও ৩০০ শতাংশ বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ব্যাপক রোগীর চাপ সামাল দিতে গাজায় খোলা মাঠে ৩০৫ শয্যার চারটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে।
রবিবার সংস্থাটি জানায়, ইসরায়েলি অভিযানের জেরে সর্বশেষ চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ হওয়া হাসপাতালটি হলো দক্ষিণ গাজার নাসের হসপিটাল। এদিন আইডিএফও জানায়, তারা হাসপাতালে অস্ত্রের পাশাপাশি জিম্মিদের নাম ও ছবিসহ ওষুধ পেয়েছে এবং সেখানে লুকিয়ে থাকা 'কয়েক শ সন্ত্রাসী'কে আটক করেছে। হামাস তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য হাসপাতালগুলো ব্যবহার করে গাজার সবচেয়ে দুর্বল নাগরিকদের গুরুতর বিপদে ফেলেছে।'
আশেপাশের হাসপাতালগুলোর কর্মীরা বলছেন, নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলি অভিযানের কারণে এখন তাদের হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়েছে।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসের গাজা ইউরোপিয়ান হসপিটালের পরিচালক ইউসুফ আল-আক্কাদ সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতিকে 'যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সবচেয়ে খারাপ' বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, 'এই হাসপাতালে রোগীদের চিকিত্সার জন্য পর্যাপ্ত শয্যা নেই। তাই চিকিৎসাকর্মীরা লোহার ফ্রেম এবং কাঠের ওপরই চাদর বিছিয়ে রোগী রাখার ব্যবস্থা করছে। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বহু রোগীকে কেবল হাসপাতালের মেঝেতেই রাখা হচ্ছিল।'
উপত্যকাজুড়ে অন্যান্য হাসপাতালের চিকিৎসকরাও একই কথা জানান।
রাফা'স মার্টার মোহাম্মাদ ইউসুফ আল-নাজ্জার হসপিটালের পরিচালক ডা. মারওয়ান আল-হামস বলেন, 'হৃদরোগ সংক্রান্ত রোগীদেরও আমাদের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।'

চিকিৎসা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সরবরাহ
গাজার চিকিৎসকরা বলছেন, তারা খুবই সীমিত চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
এক চিকিৎসক বিবিসিকে বলেন, 'আমরা এক বিন্দু অক্সিজেনও খুঁজে পাচ্ছি না।'
ডা. ইউসুফ আল-আক্কাদ বলেন, 'চেতনানাশক ওষুধ, আইসিইউ-এর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহ, অ্যান্টিবায়োটিক এবং সবশেষে ব্যথানাশক (পেইনকিলার) ওষুধ কোনোটিই পাওয়া যাচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'মারাত্মকভাবে আগুনে পোড়া বহু রোগী রয়েছে…তাদের জন্য উপযোগী কোনো ব্যথানাশক ওষুধই আমাদের কাছে নেই।'
এক চিকিৎসক নিশ্চিত করেন যে অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে।
ডব্লিউএইচওর একটি দল জানিয়েছে, তারা সম্প্রতি ইউরোপীয় গাজা হাসপাতালে একটি সাত বছর বয়সী মেয়েকে দেখেছেন। মেয়েটির শরীরের ৭৫ শতাংশই পুড়ে গেছে। কিন্তু সরবরাহের সংকটের কারণে তাকে ব্যথা উপশমের কোনো ওষুধ দেওয়া যায়নি।
উত্তর গাজার আল-আওদা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. মোহাম্মদ সালহা জানান, গাধা ও ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে রোগীদের হাসপাতালে আনা হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে চিকিৎসকরা হেডটর্চের আলোয় অস্ত্রোপচার করেছেন।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যকর্মীরা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, গাজায় প্রায় ২০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে। তবে তাদের বেশিরভাগই কর্মস্থলে আসছেন না। কারণ তাদের নিজেদেরই পরিবারের লড়াই করতে হচ্ছে।
ডা. আল-আক্কাদ জানান, আশে-পাশের এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত কিছু লোক সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছে। এ কারণে তার হাসপাতালে স্টাফ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা বেড়েছে। তবে হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী এবং তারা যে ধরনের আঘাত নিয়ে হাসপাতালে আসছেন, তা সামাল দেওয়ার জন্য এই জনবল যথেষ্ট নয়।
তিনি বলেন, 'বোমা হামলার পর রক্তাক্ত অবস্থায় আহতদের হাসপাতালে আনা হচ্ছে। একই ব্যক্তির মস্তিষ্কে আঘাত, ভাঙা পাঁজর, ভাঙ্গা অঙ্গ… আপনি যেমন আঘাতই কল্পনা করেন, তেমন আঘাতই এখানে দেখতে পাবেন।'
একই ব্যক্তি যত ধরনের আঘাত নিয়ে হাসপাতালে আসছেন, তাতে একজনকে সামাল দিতেই পাঁচজন বা তার বেশি চিকিৎসক দরকার বলেও জানান এই চিকিৎসক।
এদিকে রোগীদের সামাল দিতে গিয়ে বহু চিকিৎসক নিজেদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তাদের একজন ডা. সালহা। তিনি বলছিলেন, 'আমি তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে আমার পরিবার থেকে দূরে রয়েছি। আমি তাদের সাক্ষাৎ পেতে আগ্রহী।'
পরিবার থেকে দূরে থাকায় কষ্ট হলেও এই চিকিৎসকের এটাই সান্ত্বনা যে তিনি এখানে শিশু, নারী ও বয়স্কদের চিকিৎসায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।
দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্তদের জন্য নেই রুম
চিকিত্সকরা বিবিসিকে জানান, গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য জটিলতায় আক্রান্ত রোগীদের 'অনেক বড় মূল্য দিতে হচ্ছে'।
ডা. আক্কাদ বলেন, 'সত্যি বলতে তাদের রাখার জন্য আমাদের কাছে কোনো বিছানা নেই। এমনকি তাদের ফলো আপ করার মতো সম্ভাবনাও আমাদের নেই।'
তিনি বলেন, 'যে রোগী সপ্তাহে চারবার ডায়ালাইসিস করত, সে এখন সপ্তাহে একবার করছে। যদি সপ্তাহে ১৬ ঘণ্টা করত, এখন সেটি মাত্র এক ঘণ্টা করছে।'
এদিকে চিকিৎসা সহায়তা ছাড়াই কিছু নারী তাঁবুতে সন্তান প্রসব করছেন। প্রসূতি পরিষেবা প্রদানকারী হাসপাতালগুলোও ধুঁকছে।
ডা. সালহা বলেন, 'কোনো বিভাগে কেউ মারা যাচ্ছে, অন্য বিভাগে কোনো শিশুর জন্ম হচ্ছে। এই নবজাতকদের জন্য কোনো দুধ নেই। হাসপাতাল থেকে প্রতিটি শিশুর জন্য এক কৌটা করে দুধ দেওয়া হচ্ছে।'

এছাড়াও গাজার বহু মানুষ ঘনবসতি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশর কারণে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন।
দক্ষিণ গাজার রাফায় বাস্তুচ্যুত ৫৪ বছর বয়সী আবু খলিল বলেন, 'অসুখ আছে। কিন্তু আমরা কোনো প্রতিকার খুঁজে পাচ্ছি না।'
তিনি বলেন, 'আমাদের সেই ভোরে বের হয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে (চিকিৎসার জন্য)। আপনি আপনার সামনে অন্তত ১০০ মানুষ পাবেন। আপনি চিকিৎসা না পেয়ে খালি হাতেই ফিরবেন।'
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক