ফিনিক্স: একটি প্রজন্মের পছন্দের বাহন ছিল যে সাইকেল

২০১৬ সালে অজিত চন্দ্র ভৌমিক নিজের প্রিয় বাইসাইকেলটি বিক্রি করে দেওয়ার মতো একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। কালো রঙের, ক্লাসিক মডেলের ফিনিক্স সাইকেলটি ৪০ বছর ধরে তার পরিবারের সঙ্গী হয়ে ছিল।
অজিতের বাবা ক্ষিতিশ চন্দ্র ভৌমিক ১৯৭৩ সালে তার বিয়ের উপহার হিসেবে এই বাইসাইকেলটি পেয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর দুই দশক ধরে অজিতই সাইকেলটি চালিয়েছেন।
সাইকেলটি বিক্রি করে দেওয়া অজিতের জন্য কোনো সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। "লক্ষ্মীপুর ফিশ মার্কেট রোডে যেদিন থেকে আমি আমার মুদি দোকান 'ভৌমিক স্টোর' চালু করি, সেদিন থেকে এই বাইসাইকেলটি আমার সঙ্গী", বলেন তিনি।
কিন্তু প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে যাওয়া-আসা করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন; সেইসঙ্গে অটো-রিকশা আরও সহজলভ্য হয়ে ওঠায় সাইকেলটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন অজিত। তাছাড়া, সাইকেল চালাতে গেলে নিয়মিত যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণেরও প্রয়োজন হয়, যার ফলে খরচ আরও বেড়ে যায়।
এভাবেই একদিন একজন খরিদ্দারের সন্ধান পান অজিত, যিনি দুই চাকার এই বাহনটি ৫০০ টাকায় কিনে নেন। আমি নিজে যখনই অজিতের দোকানে যেতাম, তখনই তার সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে এর বয়সের কথা ভেবে বিস্মিত হতাম। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ব্যবহারের ছাপ যেন সাইকেলটার সারা শরীরে।
অনেকের কাছেই ফিনিক্স সাইকেল মানে শৈশবের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছোটবেলায় যখন সাইকেল চালানো শিখতে গেলাম, আমার মনে আছে তখন আমি সাইকেলের দুপাশে পা দিয়ে সিটে বসতে পারতাম না। আমার বয়সী আরও অনেক বাচ্চাদের মতো আমিও ত্রিকোণ ফ্রেমের ওপর পা রেখে হাফস্ট্রোকে প্যাডেলের চেষ্টা করতাম।

তখনকার দিনে আমাদের মিনি বাইসাইকেল ছিল না, তাই দাদা-নানা বা চাচার বাইসাইকেল ধার নিয়ে নিজেদের মতো করে সেটা চালানোর চেষ্টা করতাম। আর এই সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে কতবার যে পড়ে গিয়েছি আর হাঁটুতে যে কত ব্যথা পেয়েছি তার হিসেব নেই! আমরা প্রায় সবাই একজন না একজন কাজিন বা বন্ধুকে চিনি, যার পায়ে ছোটবেলায় সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়ার বড় ক্ষতচিহ্ন রয়েছে।
বর্তমানে পেশায় প্রাইভেট কার-চালক তারেকুজ্জামান আকাশ বলেন, "আমি আমার বাবার ফিনিক্স সাইকেল চুরি করে চালাতাম। সাইকেল চালাতে গিয়ে অনেকবার পড়ে গিয়েছি। পরে মায়ের কাছ থেকে হাঁটু আর কনুইয়ের ব্যথার দাগ লুকাতেও অনেক লুকোচুরি খেলতে হয়েছে।"
যদিও বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই সাইকেলটিকে 'বাংলা সাইকেল' নামে চেনে; ফিনিক্স সাইকেলের উৎপত্তি আসলে চীনের সাংহাই থেকে। ১৮৯৭ সালে কিং রাজবংশের সম্রাট গুয়াংজু এর শাসনামলে সাংহাইয়ের ব্যবসায়ী ঝু তংশেং সাইকেল এবং যন্ত্রাংশ বিক্রির জন্য ৬০৪, নানজিং রোডে একটি বাইসাইকেলের দোকান খোলেন এবং এর মাধ্যমে চীনা বাইসাইকেল শিল্পে একটি নজির গড়ে তোলেন। সেই দোকান থেকেই ফিনিক্স বাইসাইকেলের উৎপত্তি।
ক্লাসিক ফিনিক্স মডেলের সাইকেলগুলো আজকাল খুবই বিরল। ঢাকার বংশালে রয়েছে সাইকেলের একশোর বেশি দোকান, এটিই দেশের সবচেয়ে বড় বাইসাইকেল মার্কেট। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো একটি দোকানের নাম সোনালি সাইকেল স্টোর। স্বাধীনতার সময় থেকে বাংলাদেশে ফিনিক্স সাইকেলের প্রধান বিক্রেতা ছিল এই দোকানটি। এখনও তারা এই বাইসাইকেল ১৭,৫০০ টাকায় বিক্রি করে।
"আমাদের দোকান ছিল এসব সাইকেলের প্রধান ডিস্ট্রিবিউটর। মেঘনা গ্রুপ এগুলো চীন থেকে আমদানি করতো এবং আমরা তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতাম," বলেন সোনালি সাইকেল স্টোরের পরিচালক শারাফত উল্লাহ শাহেদ।
ফিনিক্স বাইসাইকেল চীনের একটি বিশেষ-সহায়তাপ্রাপ্ত রপ্তানি পণ্য এবং অতীতে অনেক বিদেশি নেতাকে দেশটিতে সফরের সময় স্বাগত উপহার হিসেবে ফিনিক্স সাইকেল দেওয়া হয়েছে। উপহার দেওয়ার এই রীতি একসময় চীনের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায় এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে জনপ্রিয়তা পায়।
বংশালে ৪০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন মনু মিয়া। তিনি বলেন, "একসময় আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলে বিয়ের আলোচনার সময়ই কনেপক্ষ বরকে ফিনিক্স বাইসাইকেল এবং হাতঘড়ি দিবে বিয়েতে- এমনটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।"
এমনকি ২০০২ সালে 'দ্বি-চক্রযান' নামক একটি বাংলা নাটকেও এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়। নাটকে দেখানো হয়, কনের বাবাকে তার গবাদি পশু বিক্রি করতে হচ্ছে জামাতার জন্য ফিনিক্স বাইসাইকেল কিনতে। এছাড়া আরও অনেক টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে বিভিন্ন দৃশ্যে ফিনিক্স সাইকেলের ব্যবহার দেখানো হয়েছে।
"সেনাবাহিনীর কর্মী থেকে শুরু করে কৃষক, রানার, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ একসময় এই ফিনিক্স সাইকেল ব্যবহার করতো। ১৯৬৮ সালের দিকে নিলাম ও হ্যামিল্টন ব্র্যান্ডের সাইকেলগুলো ফিনিক্সের সাথে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ফিনিক্সের জনপ্রিয়তার ধারেকাছে যেতে ব্যর্থ হয় সেগুলো," বলেন মনু মিয়া। তরুণ বয়সেই বাবার সাইকেলের ব্যবসায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
মনু মিয়া এবং সোনালি সাইকেল-এর শাহেদ দুজনেই জানান, সত্তরের দশকে টাঙ্গাইলে ফিনিক্স সাইকেলের বড় বাজার ছিল। মনু মিয়া বলেন, "টাঙ্গাইল ছিল আমাদের সাইকেলের সবচেয়ে বড় বাজার। এই জেলাতে বিয়ের উপহার হিসেবে সাইকেল দেওয়া খুব জনপ্রিয় ছিল, এমনকি ফিনিক্স সাইকেল না পাওয়ায় বর বিয়ের আসর ছেড়ে উঠে গেছে এমন গল্পও শোনা যেত!"

মনু মিয়ার পরামর্শ শুনেই আমি টাঙ্গাইলে গিয়েছিলাম সেখানে ফিনিক্স সাইকেলের জনপ্রিয়তা বুঝতে। টাঙ্গাইলের নতুন বাস স্টপ থেকে নেমে ভিক্টোরিয়া রোডের দিকে এগোনোর সময় মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমি এখানে-সেখানে অন্তত ২০টি পুরনো ফিনিক্স সাইকেল দেখলাম। যদিও ভিক্টোরিয়া রোডের দুই পাশে অনেকগুলো সাইকেলের দোকান রয়েছে, কিন্তু কোনো দোকানেই এখন আর পুরনো ফিনিক্স সাইকেল নেই।
সাইকেল হ্যাভেন-এর মালিক ৬০ বছর বয়সী সুনীল চন্দ্র দাস এই জেলায় ফিনিক্স সাইকেল নিয়ে ক্রেজের চাক্ষুষ সাক্ষী। সুনীল প্রায় ৫০ বছর ধরে এখন সাইকেল মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন। খুব আগ্রহভরে ফিনিক্স সাইকেলের সোনালি যুগের স্মৃতিচারণ করলেন তিনি।
"একটা কাঠের বাক্সে পাঁচটা আলাদা টুকরা হয়ে আসতো এই সাইকেল। আমার মনে আছে, সেসময় যান্ত্রিক বিপণী ছিল শহরের সবচেয়ে বড় ডিলার। তিন ট্রাক ভর্তি করে ফিনিক্স সাইকেলের চালান এনেছিল তারা," বলেন সুনীল।
তিনি আরও যোগ করেন, "ওই সময় এই এলাকায় অনেক সাইকেলের দোকান গড়ে ওঠে এবং শুধুমাত্র ফিনিক্স সাইকেল বিক্রির উপরে চলতো তারা। এই সাইকেলের চাহিদা এখনো আছে, কিন্তু এখন শুধু মনি সাইকেল স্টোরে এটা পাওয়া যায়।"
শুক্রবার দিন হওয়ায় বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ ছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মনি সাইকেল স্টোরের মালিক বিপ্লব গুণ মনির সাথে আমার আলাপ হয়ে গেল। জানা গেল, তার দোকানটিই বাজারের সবচেয়ে বড় সাইকেলের দোকান।
যদিও বাবা পবিত্র গুণের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই ব্যবসার মালিকানা পেয়েছেন বিপ্লব, কিন্তু ফিনিক্স সাইকেল নিয়ে উন্মাদনা তিনিও নিজ চোখে দেখেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এক কথায় বলতে পারেন যে ফিনিক্স সাইকেল, যেটাকে স্থানীয় ভাষায় আমরা 'ফিনিক্স ২৮ সাইকেল' বলি, এটা এখন অপ্রচলিত। আমি যখন ছোট ছিলাম, এমনকি ২০ বছর আগেও এই সাইকেলের ব্যাপক চাহিদা ছিল।"
তিনি আরও জানান, এখানে যতগুলো দোকান আছে সবগুলো দোকানে দৈনিক ৫ থেকে ১০টি ফিনিক্স সাইকেল বিক্রি হতো। "কিন্তু এখন মাসে সর্বোচ্চ পাঁচটা বিক্রি হয়", বলেন তিনি। মনির বাবা সোনালি সাইকেল স্টোর থেকে সাইকেল কিনতেন, তারা অন্যান্য দোকানের চেয়ে একটু কম দামে সাইকেল দিত। বিপ্লব বলেন, "আমার মনে আছে, এই সাইকেলের দাম ছিল তখন ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টাকার মধ্যে।"
তবে আমি কৌতূহলবশত প্রশ্ন করলাম, যদি বিক্রিবাট্টা কমই হয়ে থাকে তাহলে কেন এখনও কিছু দোকানে ফিনিক্স সাইকেল রাখা হয়? মনি বলেন, "গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা এখনও ভাবেন যে ফিনিক্স সাইকেলই সর্বোচ্চ মানের, তাই তারা এই সাইকেল খোঁজেন। সেজন্যই আমরা অল্প পরিমাণে এই সাইকেল রাখি।"
টাঙ্গাইল শহরে একটি ইউনানি ওষুধের দোকান চালান দুলাল সাহা। তার কাছে থাকা সাইকেলটিই আমার দেখা সবচেয়ে পুরনো বাইসাইকেল। যদিও তার সাইকেলটি ফিনিক্সের নয়, ব্রিটিশ ব্র্যান্ড হারকিউলিসের। কিন্তু হারকিউলিস ব্র্যান্ডের সাইকেলের দাম গড়পরতা লোকের সাধ্যের বাইরে ছিল, তাই সেই জায়গা পূরণ করেছিল চীনের ফিনিক্স সাইকেল।
"৪২ বছর আগে আমি এই সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেলটা ৭০০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। সাইকেলের আগের মালিকও এটা প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি সময় ব্যবহার করেছিলেন (যদিও আমার একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল)। ওই ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন যে শুধুমাত্র তার সাইকেল দেখার জন্য লোকজন তার বাড়িতে এসে ভিড় করে।"

এদিকে ঘুরতে ঘুরতে দেখা পেয়ে গেলাম ২৩ বছর বয়সী সজীব কর্মকারের, যিনি একটি পুরনো ফিনিক্স সাইকেলে চড়ে যাচ্ছিলেন। সজীব বলেন, "আমার বাবা ২৫ বছর আগে ৬০০০ টাকা দিয়ে এই সাইকেল কিনেছিলেন। তাকে তার বিয়েতে একটা 'হিরো' সাইকেল দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে সেটা বিক্রি করে ফিনিক্স কেনেন।"
তবে দৈনন্দিন যাতায়াতের কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা সাইকেলে করে আলুর মৌসুমে আলুর বস্তা আনা-নেওয়ার কাজও করা হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি ও মার্চের দিকে মুন্সিগঞ্জ এবং রংপুর অঞ্চলে এই ফসল উঠানোর কাজ চলে। এই সাইকেলগুলো এতটাই মজবুত যে ভারি মালামালও বহন করা যায়। সাইকেলে কিছু পরিবর্তন এনে মাঠ থেকে একবারে চার বস্তা আলুও সাইকেলে করে মূল সড়ক বা স্টোরেজ পর্যন্ত নিয়ে আসা যায়।
মুন্সিগঞ্জের কৃষক শামসুল আলম বলেন, সাইকেলে করে বোঝা নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে নতুন একটা পেশার উদ্ভব হয়েছে। ফসল উঠানোর মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলা, যেমন- কুষ্টিয়া থেকে অনেক শ্রমিক এসে স্থানীয়দের সঙ্গে কাজ করেন। এমনই একজন শ্রমিক সাইম উদ্দিন বিশ্বাস জানান, ৫০-৬০ কেজির প্রতি বস্তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি ৩০ টাকা পান।
তিনি বলেন, "২০ বছর আগে যখন এই কাজ শুরু করেছিলাম তখন প্রতি বস্তা নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৫-২০ টাকা পেতাম। এই সাইকেলগুলো ধানক্ষেতের মতো জমির উপর দিয়েও চলতে পারে, যেখানে অন্যান্য বাহন চালাতে সমস্যা হয়।"
তবে সময়ের সাথে সাথে তরুণ প্রজন্মের কাছে ফিনিক্স সাইকেলের জনপ্রিয়তা ফিকে হয়ে এসেছে। আগে এই সাইকেলগুলো অধিক ব্যবহারযোগ্যতা ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে বানানো হলেও, তরুণরা বর্তমানে আরও আধুনিক ডিজাইনের সাইকেল চাইছেন।
তাছাড়া, বাংলাদেশের মেঘনা গ্রুপ নিজেরাই দেশের মধ্যে বাইসাইকেল উৎপাদন শুরু করেছে, ফলে ফিনিক্স সাইকেলের চাহিদা আরও কমে গিয়েছে।
মেঘনা গ্রুপের ডিরেক্টর অব অপারেশনস, লুৎফুল বারি বলেন, "আমরাই প্রথম ফিনিক্স সাইকেল আমদানি করেছি, বহু বছর যাবত বাজারে চলেছে এই সাইকেল। এখন আমরা নিজেরাই এর চেয়ে ভালো সাইকেল বানাই। আমরা এমন সাইকেলও বানাই যেগুলো দেখতে ফিনিক্স সাইকেলের মতোই।"
যেহেতু মেঘনা গ্রুপ আর ফিনিক্স সাইকেল আমদানি করে না, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান বাজারে থাকা সাইকেলগুলো কারা আমদানি করছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বংশালের সাইকেল মার্কেটের একজন বহুল পরিচিত দোকান সিরাজ সাইকেল-এ গেলাম। সোনালি স্টোর দাবি করেছিল তারা এদের থেকেই কেনে। সিরাজ সাইকেল-এর ম্যানেজার মঈন উদ্দিন বলেন, "আমরা আগে ফিনিক্স ক্লাসিক মডেলগুলো আনতাম। কিন্তু করোনা মহামারির প্রভাবে কোম্পানি এই সাইকেলগুলোর উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ নয়। মঈন উদ্দিন চুপিচুপি জানালেন, "দেশের ভেতরেই একটা নেটওয়ার্ক আছে, যারা এই সাইকেলগুলো দেশেই নকল করে বানায়। তারা লোকাল সাইকেলে ফিনিক্সের লেবেল লাগিয়ে ক্রেতাদের ধোঁকা দিচ্ছে।"
ইদানিং সাইকেল চালানোকে একটি বড় আমোদপ্রমোদমূলক কার্যক্রম হিসেবে দেখা হয়। অতীতে অনেকেই জন্যই যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিল বাইসাইকেল; আর বয়স্কদের দৈনন্দিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ ছিল ফিনিক্স সাইকেল।
তবে রাস্তাঘাটের উন্নতি হওয়ায় এবং মোটরচালিত যানবাহনের প্রবর্তনের ফলে ফিনিক্সের মতো ক্লাসিক সাইকেল আজ অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছে।
ফিনিক্স তাদের মেশিনগুলো আধুনিকীকরণ করার লক্ষ্যে কিছু পরিবর্তন এনেছিল, কিন্তু ভোক্তাদের পছন্দের পরিবর্তন এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের কারণে ফিনিক্স আর আগের সেই জনপ্রিয়তা ফিরে পায়নি।
সোনালি সাইকেল-এর শাহেদ বলেন, "ফিনিক্সের প্র্যাক্টিক্যাল ডিজাইনের বদলে আধুনিক বাইসাইকেলগুলোতে নান্দনিকতার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত, ফিনিক্স এই পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। এর ফলে ২০ বছর আগেও এদেশের বাজারে রাজত্ব করলেও, ফ্যাশনেবল বাইসাইকেলের উত্থানের সাথে সাথে তাদের জৌলুস ও জনপ্রিয়তা ম্লান হয়ে গেছে।"
ফিনিক্স-এর ইতিহাস
- ১৯৫৮ সালে তংচ্যাং বাইসাইকেল ফ্যাক্টরি অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে সাংহাই বাইসাইকেল ফ্যাক্টরি III চালু করে যা পরে ফিনিক্স-এ পরিণত হয়।
- ফিনিক্স ১৯৮৫ সালে চীনের শীর্ষ সাইকেল ব্র্যান্ড ছিল এবং তারা প্রথম চীনা সাইক্লিং দল প্রতিষ্ঠা করে।
- ১৯৯৩ সালে কোম্পানিটি পুনর্গঠন করে সাংহাই ফিনিক্স বাইসাইকেল কো. তে রূপ দেওয়া হয়।
- ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ফিনিক্স বিএমএক্স ও মাউন্টেইন সাইকেলের মতো পণ্য বাজারে এনে তরুণদের পছন্দ ও চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।
- ১৯৮০র দশকে ফিনিক্স আরেকটি কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় এবং ব্র্যান্ডের নামটি আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়।
- ফিনিক্স বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে পণ্য রপ্তানি করে এবং তাদের বার্ষিক আয় ৬০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।