রিজার্ভ সংকট, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকারের দুর্বল নীতিও দায়ী: অর্থনীতিবিদরা

কোভিড পরবর্তীতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত (সাপ্লাই চেইন ডিসরাপশন) হওয়ায় বিশ্ববাজারে পণ্য মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দেশে রিজার্ভ সংকটসহ দেখা দিয়েছে সকল ধরনের পণ্যে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি। বৈশ্বিক দায় ছাড়াও সরকারের বেশকিছু নীতিগত দুর্বলতা দেশের এই রিজার্ভ সংকট ও খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
দেশের রিজার্ভ সংকটের অন্যতম কারণ হলো, দীর্ঘদিন ডলার রেটকে আটকে রাখা এবং হঠাৎ করেই ২৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়া। একইসঙ্গে, আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং, বিভিন্ন উপায়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার এবং বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স না এনে হুন্ডির ব্যবহার বেড়ে যাওয়াও দেশে রিজার্ভ সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তারা।
শনিবার (৮ এপ্রিল) ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইডিআরও) কর্তৃক আয়োজিত 'রিজার্ভ ক্রাইসিস অ্যান্ড ফুড প্রাইস হাইক: আ ওয়ে ফরওয়ার্ড, বাংলাদেশ পার্সপেক্টভ' শীর্ষক সেমিনারে বক্তরা এসব কথা বলেন।
সেমিনারে প্যানেলিস্ট হিসবে যুক্ত হয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "আমাদের দেশের বৈদেশিক বিনিময় হারকে গত ১২ বছর ধরে আটকে রাখতে দেখেছি। যার কারণে আমরা আর্টিফিশিয়ালি পার ক্যাপিটা ইনকামকে (মাথাপিছু আয়) বাড়িয়ে দেখাতে পেরেছি, যদিও এটি সাসটেইনেবল ছিল না।"
"হঠাৎ করে কয়েকমাসের বৈশ্বিক চাপে ডলার রেট ২৫ শতাংশ বাড়ানো হলো, যার কারণে সরকারি ও বেসরকারিভাবে চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। সরকারের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পৌনে ২ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া, বেসিরকারি কোম্পানিগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ রয়েছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার। ডলার রেট বাড়ার কারণে এখন তাদের অতিরিক্ত ৭৫ হাজার কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
আরও উল্লেখ করেন, "আমাদের রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে, এটি উদ্বেগের বিষয়; তবে আমরা এখনও ক্রাইসিস পয়েন্টে আসিনি।"
বাংলাদেশের খাদ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, "বর্তমানে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন ডলার। সামনে আকু পেমেন্ট হলে আরও দেড় বিলিয়ন ডলার কমবে।" আকু (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন-এসিইউ) হলো আঞ্চলিক আমদানিতে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ব্যবহৃত পেমেন্ট গেটওয়ে, এর মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হয়। প্রতি দুই মাস অন্তর এর বিল পরিশোধ করা হয়।
তিনি বলেন, আইএমএফ পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পরামর্শ হলো জুন পর্যন্ত যেন রিজার্ভের পরিমাণ না কমে। এরই লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। আগামী জুনের মধ্যে বাজেট সাপোর্ট হিসেবে দেড় বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা আসবে, যা কিছুটা হলেও দেশের রিজার্ভকে স্বাভাবিক রাখবে।
"তবে আমাদের যেকোনো উপায়ে রিজার্ভ বাড়াতে হবে," যোগ করেন তিনি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. সুরেশ বাবু। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট সাপ্লাই চেইন ব্যাঘাত এবং এরপরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের উৎসে প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম বেড়েছে। এছাড়া, যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও সারের দাম বেড়েছে এবং শ্রমের মজুরি বৃদ্ধিও পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। এর পাশপাশি কিছু অঞ্চলে খরার কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে পণ্যের।
এদিকে, রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকেই বাংলাদেশ বেশিরভাগ খাদ্যশস্য, জ্বালানি এবং সার আমদানি করে থাকে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আরো বলেন, বাংলাদেশকে বেশি দামে এসব পণ্য কিনতে হচ্ছে, ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ কে এম মোখতারুল ওয়াদুদ বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা হলো দেশটির সবচেয়ে বেশি খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়।
ব্যাপক আমদানি এবং সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়ায় স্থানীয় মুদ্রার দাম ব্যাপকভাবে কমেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডলারের তুলনায় টাকার বেশি অবমূল্যায়ন হলে রিজার্ভ সংকট দেখা দেয়।
দীর্ঘদিন ধরে ডলারের দাম প্রায় অপরিবর্তিত থাকার কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোঃ এজাজুল ইসলাম বলেন, "কোভিডের আগে আমাদের দেশে ডলারের দাম প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। এর পেছনে কারণ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের তদবির, সরকারের নীতিমালা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি-এসব কারণেই ডলারের মূল্য কম ছিল।"
তবে কোভিডের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। "সে সময়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল। এটি না করলে, ডলার রেট প্রতি মার্কিন ডলার ৭০ টাকায় নেমে যেত।"
"কিন্তু কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে চাহিদা বাড়ার কারণে আমদানিও বেড়েছে। ফলস্বরূপ, ২০২২ অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি হয়েছে সর্বোচ্চ," বলেন তিনি।
সেমিনারে দ্য ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার আহসান হাবীব অর্থপাচারকে রিজার্ভ সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
বহু বছর ধরে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করা হলেও গত বছর সরকার স্বীকার করেছে, অর্থ দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে এবং কর পরিশোধ করে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে।
"আমাদের যে কোনো উপায়ে বৈদেশিক বাণিজ্যে ওভার এবং আন্ডার-ইনভয়েসিং বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে, হুন্ডির ব্যবহার বন্ধ করে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে," যোগ করেন তিনি।