ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের উদ্যোগ: বাংলাদেশের জন্যও কি নতুন আশার সঞ্চার করছে?

আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের তিন বছরে পা রাখবে, এরমধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নতুন প্রচেষ্টাও শুরু হয়েছে – এবার যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুদ্ধ বন্ধে তিনি যে চুক্তিতে মধ্যস্ততা করছেন— তা শুধু কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য, এটি হতে পারে অতি-জরুরি অর্থনৈতিক লাইফলাইন।
এই যুদ্ধ শুরুর আগে— গতিশীল ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি, এক দশক ধরে হয়েছিল স্থিতিশীল, উচ্চ প্রবৃদ্ধি। এমনকী করোনা মহামারির ধাক্কাও সহ্য করতে পেরেছিল।
এরপরেই আসে ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত, যা শুরু হওয়ার সপ্তাহ কয়েকের মধ্যেই— দেশের অর্থনৈতিক সহনশীলতাও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়।
ডলারের বিপরীতে টাকার মানে ব্যাপক অবমুল্যায়ন ঘটে, মাত্র এক বছরের মধ্যেই এক ডলারের দাম ৮৫-৮৬ টাকা থেকে ১২০ টাকার উপরে চলে যায়। মূল্যস্ফীতির হার ৬ থেকে প্রায় ৯ শতাংশে পৌঁছায় যুদ্ধ শুরুর ছয় মাসের মধ্যে— এরপর যা দুই অঙ্ক স্পর্শ করে। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম ৪২.৫ শতাংশ থেকে ৫১.৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে, যা জীবনযাত্রার ব্যয়কেও বাড়ায়। তেল ও গ্যাস আমদানি মূল্যে অনেকটা বাড়ায়, তা কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামর্থ্যও হ্রাস পায়। ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সেটি নেমে আসে প্রায় ২০ বিলিয়নে।
জ্বালানি ছাড়াও সার, গম ও পোলট্রি ফিডের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যেরও আমদানি মূল্য চড়া হয়। বিশ্ববাজারে ভুট্টার একটি প্রধান সরবরাহকারী ইউক্রেন, কিন্তু যুদ্ধের জেরে ভুট্টা রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় – পোলট্রি ফিডের দাম বেড়ে যায় – ডিম ও মুরগির দামেও তার প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য আমিষের সস্তা এ দুটি উৎসও তখন বেশ দামি হয়ে ওঠে। আমিষের চাহিদাপূরণে দেশের মানুষের সীমিত যে সামর্থ্য— সেটি এবার আরও কমে আসে।
বৈশ্বিক পণ্য ও কাঁচামাল সরবরাহের শৃঙ্খলকেও গভীরভাবে ব্যাহত করেছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ, যার ফলে কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, এতে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের জোগানে টান পড়ে, বেড়ে যায় জাহাজ ভাড়া আর নিত্যপণ্যের দামও।
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিশ্ববাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম কমেছে, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধ বন্ধ হলে স্বস্তির জায়গাটা আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপ। যুদ্ধের পর থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে ইউরোপীয় অর্থনীতিগুলো। এতে ভোক্তাদের ক্রয় সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
রাশিয়ায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির তথ্য যুদ্ধে আমাদের ক্ষতির মাত্রাটা তুলে ধরে। যুদ্ধের আগে দেশটিতে রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পথে ছিল, কিন্তু গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেটি নেমে এসেছে মাত্র ৩৬৯ মিলিয়ন (প্রায় ৩৭ কোটি) ডলারে, এমনকী চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১৪৮ মিলিয়ন (প্রায় ১৫ কোটি) ডলারে নেমেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানির সাথে তুলনা করলে, যা মাত্র এক-চতুর্থাংশ।
যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কারণে— রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশের অর্থ পরিশোধের প্রক্রিয়াও জটিলতার মধ্যে পড়ে। এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষোভ এড়াতে রাশিয়া থেকে সস্তায় জ্বালানি তেলও কিনতে পারেনি বাংলাদেশ।
তাই ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, শান্তি চুক্তি হলে তা বন্ধ হওয়া বাজারগুলোকে ফের প্রবেশের সুযোগ দেবে বাংলাদেশকে, নব উদ্যমে শুরু হবে বাণিজ্য, টাকার দর স্থিতিশীল হবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি ফিরে আসবে।
তবে আশাবাদের সঙ্গেসঙ্গে কিছু শঙ্কার জায়গা রয়েছেন বলেও সতর্ক করেছেন তাঁরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, (যুদ্ধের ইতি টানতে) একটি সমাধানে যদি পৌঁছানো যায়— তাহলে রাশিয়ায় রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ সুবিধা নিতে পারবে, দেশটি থেকে আমদানিও সহজ হবে, বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলোও দূর হবে। 'রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেমেন্ট সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জেরও সমাধান হবে, আরও দক্ষ একটি সাপ্লাই চেইন তৈরি হলে আমদানি পণ্যের দামও কমবে'- টিবিএসকে বলেন তিনি।
তবে এই অর্থনীতিবিদ উল্লেখ করেন যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একযোগে উদ্যোগ নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, এসব আলোচনা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউক্রেনকে বাদ দেওয়া হচ্ছে।
'একারণে অন্যান্য পক্ষগুলো কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে, বা কোন ধরনের পদক্ষেপ তারা নেবে– সেটি অনিশ্চিত। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে বা তারা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে রাজি না হলে— ইইউ মার্কেটে আমরাও প্রত্যাশিত সুবিধা পাব না' - যোগ করেন মোয়াজ্জেম।
সরবরাহ শৃঙ্খল বাধামুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা
ইউক্রেন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। শিপিং খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সমুদ্রপথে ওয়ার রিস্ক সারচার্জ আরোপ করে শিপিং কোম্পানিগুলো। এর ফলে বেড়ে যায় জাহাজের ভাড়া। এই বাড়তি ভাড়া যোগ হয় পণ্য মূল্যে।
এই সংঘাতের জেরে জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞার ঘটনাও ঘটে। ফলে সমুদ্রপথে অবাধ পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। এর প্রভাব এখনো রয়েছে। রাশিয়ান বেশ কয়েকটি জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে জাহাজ ও কনটেইনার সংকটে – ফ্রেইট চার্জও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
যুদ্ধ শুরু হলে ২০২২ সালের ২ মার্চ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে মিসাইল হামলার শিকার হয় বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ 'বাংলার সমৃদ্ধি'। ওই হামলায় মারা যান ওই জাহাজের থার্ড অফিসার হাদিসুর রহমান। পরবর্তীতে জাহাজের বাকি ২৮ জন নাবিককে জীবিত ফিরিয়ে আনে বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, এ যুদ্ধের জেরে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে পণ্য পারিবহন বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়ে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানি করতে না পারায়— বিকল্প দেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। এতে বেড়েছে জাহাজ ভাড়া এবং পণ্যের দাম। যুদ্ধ বন্ধ হলে জাহাজ ভাড়াও কমে আসবে। স্থিতিশীল হবে সাপ্লাই চেইন।
ডেলটা এগ্রোর চেয়ারম্যান আমিরুল হক বলেন, খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি জ্বালানি তেল পরিবহনে জটিলতায় পড়তে হয়, আমদানির খরচ তাতে অনেক বেড়ে যায়। ক্রুড অয়েলের (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) দাম ব্যারেল প্রতি ৭০ ডলার থেকে ১২০ ডলার পর্যন্ত উন্নীত হয়। এলপিজি এর দামও অনেক বাড়ে। পরিবহণ খরচও প্রায় দ্বিগুণ হয়। যুদ্ধ বন্ধ হলে এখানে স্বস্তি ফিরবে। দাম কমবে, সাপ্লাই চেইন স্মুথ হবে।
কমতে পারে খাদ্যপণ্যের দাম
২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হয়েছে বিশ্বের খাদ্যপণ্যের বাজার। কারণ বাংলাদেশের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ এবং বিশ্বের ২৮ শতাংশ গমের যোগান দেয় ইউক্রেন ও রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ৩৬০ ডলার টন প্রতি গমের দাম বেড়ে ৫২২ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। যদিও গমের দাম কমে এখন ২৫৪ ডলারে নেমে এসেছে।
দেশের ভোগ্যপণ্যের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের ডিরেক্টর অব অপারেশন তারিক আহমেদ বলেন, দাম কমার সঙ্গে সাপ্লাই চেইন সহজ হওয়াটা সবচেয়ে বড় আর্শীবাদ। 'এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পুরো সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে পড়ে। ফ্রেইট চার্জ বেড়ে তিন-চার গুণ হয়ে যায়। ডলার মার্কেটে ক্রাইসিস তৈরি হয়। ফলে ব্যবসার ব্যয় কয়েকগুণ বাড়ে। যুদ্ধ বন্ধ হলে এসব ক্ষেত্রে স্বস্তি পাওয়া যাবে।'
গমের পাশাপাশি পাম অয়েল, সয়াবিন অয়েলসহ সব ভোজ্যতেলের বাজারেও স্বস্তি ফিরবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট এ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ডলার সংকট তৈরি হলে— ব্যাংকগুলো এলসি দিতে পারেনি। এলসি মার্জিন ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। অনেকেই শতভাগ এলসি মার্জিন দিয়েও পণ্য আমদানি করতে পারেনি। একে একে ব্যবসা গুটিয়ে নেয় ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তা, আমদানিকারকররা। পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও— এলসি সমস্যা এখনো কাটেনি। তবে যুদ্ধ বন্ধ হলে পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে বলে আমরা আশা করছি।
গম, ভোজ্যতেল ছাড়াও যুদ্ধ শেষ হলে মসুর ডাল, ভুট্টা, রাসায়নিকের আমদানি খরচও কমবে বলে মনে করছেন ডেলটা এগ্রোর চেয়ারম্যান আমিরুল হক। তবে এর জন্য বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো বাড়াতে হবে জানিয়েছেন তিনি।
সুখবর আসতে পারে পোশাক রপ্তানিতেও
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভুক্তভোগীদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের শীর্ষ গন্তব্য ইউরোপ। মোট রপ্তানি আয়ের ৫০ শতাংশের বেশি আসে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে। তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই মন্দার কবলে পড়ে এই মার্কেট। কোনো কোনো দেশে মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশও ছাড়িয়েছে। ফলে ২০২৪ সালের ১১ মাসে ইউরোপে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ১.৮৯ শতাংশ। এর আগে সবশেষ ২০১৩ সালে এটি ১ শতাংশের কম হয়েছিল।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধ বন্ধ হলে ইউরোপের মুল্যস্ফীতি কমে যাবে। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়ে যেতে পারে।
গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন- বিজিএমইএ'র সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশ পোশাকখাত সহ সকল ক্ষেত্রে বিপর্যয়ে পড়ে। যুদ্ধ বন্ধ হলে ডলার সংকট কাটবে। আমদানিকারকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী, পণ্য আমদানি করতে পারবে। আমরা নির্বিঘ্নভাবে ও সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে পারব। ইউরোপের বাজারে চাহিদাও বাড়বে।
এছাড়া রাশিয়ার বাজারেও বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা আবার প্রবেশের সুযোগ পাবেন বলে মনে করছেন রাকিবুল আলম চৌধুরী।