রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী গৃহস্থালি জ্বালানি ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটকে তীব্র করে তুলেছে। এতে সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে, গৃহস্থালি পর্যায়ে ঘর উষ্ণ রাখা, রান্নাবান্না ও পরিবহনের ব্যয়। অন্যান্য পণ্য ও পরিষেবার ব্যয়ও বেড়েছে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রজুড়ে। দ্য কনভারসেশন অবলম্বনে
সর্বস্তরের পরিবারগুলো এর ভুক্তভোগী হলেও, আয়ের উৎস এবং কীভাবে তারা অর্থ ব্যয় করেন– তার ওপর ভিত্তি করে প্রভাবে তারতম্য রয়েছে। এক্ষেত্রে আরো ভূমিকা রাখছে, পরিবারগুলোর ভোগ্যপণ্যগুলো কোথায় ও কীভাবে উৎপাদিত হচ্ছে– সেই বিষয়টিও।
তাই সবচেয়ে প্রভাবিত পরিবারগুলোকে লক্ষ্যে রেখে জ্বালানি সহায়তা দেওয়া জরুরি কর্তৃপক্ষের। সেজন্য আগে জানা দরকার, কারা বেশি চাপে রয়েছে এবং তার মাত্রা কতটুকু।
বিষয়গুলো অনুসন্ধানে একটি গবেষণা করেছেন একদল আন্তর্জাতিক গবেষক। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে নেচার এনার্জি জার্নালে।
প্রভাব নিরুপণে, ১১৬টি দেশের জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের মডেল তৈরি করা হয়। এর আওতায় আছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮৭.৪ শতাংশ। তবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর।
গার্হস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধির অসম চাপ
এক বছর আগে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিভিন্ন প্রকার জ্বালানির দাম তীব্রভাবে বেড়েছে, তবে জ্বালানির ধরন ভেদে দর উল্লম্ফনে তারতম্য ছিল। নিচের গ্রাফটিতে মূল্য ওঠানামার চিত্র নির্দেশ করছে;

বিশ্বব্যাপী গার্হস্থ্য পর্যায়ে এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব নিরূপণে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করেন গবেষকরা। এর ভিত্তিতে তারা জানাচ্ছেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখাতে গার্হস্থ্য ব্যয় অন্তত ৬৩ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১৩ শতাংশ (যা দ্বিগুণেরও বেশি) বেড়েছে। জ্বালানির পেছনে বাড়তি খরচের কারণে বৈশ্বিক গৃহস্থালি পর্যায়ে খরচ বেড়েছে ২.৭ থেকে ৪.৮ শতাংশ পর্যন্ত।
বিশাল এই পরিবর্তনের হাত ধরে এসেছে একই মাত্রার অর্থনৈতিক অভিঘাত; ফলে শুধুমাত্র ২০২২ সাল পূর্ববর্তী জীবনমান বজায় রাখতেই, পরিবারগুলোর জন্য আরো ৫ শতাংশ অতিরিক্ত আয় প্রয়োজন এমন চিত্র উঠে এসেছে।
আকস্মিকভাবে এই অভিঘাতের শিকার বিশ্ববাসী, সে তুলনায় রাতারাতি আয়বৃদ্ধি ঘটেনি মানুষের। তবে ব্যয় বেড়েছে মূলত জ্বালানির পরোক্ষ ভোগের কারণে। পরোক্ষ ভোগ বলতে বোঝানো হচ্ছে, আমরা যেসব পণ্য বা সেবা গ্রহণ করি- সেগুলো উৎপাদনে জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে। যেমন বৈশ্বিক কৃষিখাত ব্যাপকভাবে জ্বালানি ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। ফসলের উৎপাদন থেকে ফলন এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প– সর্বত্র রয়েছে জ্বালানির চাহিদা। খাদ্য পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমেও জ্বালানি লাগে। আর তাতে ধাপে ধাপে বাড়ে ব্যয়, যা শেষস্তরের ভোক্তার কাঁধে চাপে (যদি না সরকারি ভর্তুকি/প্রণোদনা তা কিছুটা লাঘব করে)।
উৎপাদন চক্রের মাধ্যমে যুক্ত বিশ্ব অর্থনীতি। কৃষিপণ্য ও উপকরণের আমদানি-রপ্তানিও এর বাইরে নয়। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো ভোক্তা যদি আমদানি করা গরুর মাংস খান, সেটার দাম হয়তো নির্ভর করছে রাশিয়া বা জার্মানিতে উৎপাদিত সারের ওপর– যা দিয়ে ব্রাজিলে গোখাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে। জ্বালানির দাম বাড়লে এসব উপকরণের দামও প্রভাবিত হয়। তার সাথে যোগ হয়, জ্বালানি পুড়িয়ে পরিবহনের খরচ। এ ধরনের বহু বিষয় সম্পর্কিত থাকায়, গবেষণাটিকে সুনির্দিষ্ট নয় বরং সার্বিক বিচারে করা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।
পণ্য বা সেবা ভোগ বাবদ সম্পন্ন পরিবারগুলোর জ্বালানির পেছনে পরোক্ষ ব্যয় বেশি। সে তুলনায়, অপেক্ষাকৃত অস্বচ্ছল পরিবারগুলো দৈনন্দিন চাহিদা মেটায় জরুরি খাদ্য সংগ্রহসহ অন্যকাজে সরাসরি জ্বালানি ব্যবহার করে। তবে যেসব পরিবার প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও সেবার ওপর নির্ভরশীল– জ্বালানির খরচ বাড়ায় তাদেরই বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর অস্বচ্ছল মানুষের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য নির্ভরতা বেশি, উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও কমবেশি এই ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। আর এ ধরনের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প উচ্চমাত্রায় জ্বালানি ব্যবহার করে।

অনেক দরিদ্র দেশ দামি হয়ে ওঠা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল নয়। কিন্তু তাদের পরোক্ষ নির্ভরশীলতা রয়েছে। একারণে, আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের কয়েকটি দেশে গৃহস্থালি পর্যায়ের জ্বালানি খরচ বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে তিনগুণ বেড়েছে। যেমন রুয়ান্ডায় তা বেড়েছে ১১ শতাংশ। অথচ, ২০১৮ সালে দেশটিতে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত মোট জ্বালানির ৯৯.৬ শতাংশই ছিল স্থানীয় উৎসের- যেমন রান্নার কাজে সেখানে কাঠ ও গোবরের ব্যবহারই বেশি। কিন্তু, খাদ্যের জন্য দেশটির আমদানি নির্ভরতা থাকায় জ্বালানির পেছনে পরোক্ষ ব্যয়ের এই বিশাল উল্লম্ফন হয়েছে। বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বৃদ্ধিই এর পেছনে ভূমিকা রাখে।
জ্বালানি সংকটে বেড়েছে দারিদ্র্য
জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলোর জ্বালানি দারিদ্র্য বেড়েছে, বিশেষত শীতের মৌসুমে। এ ধরনের দারিদ্র্যের শিকার মানুষ হিম ঠাণ্ডার মধ্যে ঘর উষ্ণ রাখার জ্বালানির অভাবে ভোগে; বিদ্যুতের অভাবে গরমকালে ঘর ঠাণ্ডা রাখতে পারে না বা গৃহস্থালি কোনো যন্ত্র চালাতে পারে না। রাতে আলো জ্বালানোও তাদের বরাতে বিরল।
বিশ্ববাজারে জ্বালানির চড়া দাম জালানি-দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের সংখ্যা বাড়াবে। কারণ তাদের মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশই খরচ হচ্ছে জ্বালানির পেছনে। বিশ্বব্যাপী ন্যূনতম ১৬ কোটি ৬০ লাখ থেকে ৫২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ (বৈশ্বিক জনসংখ্যার ২.৪ থেকে ৭.৯ শতাংশ) এ পরিমাণ ব্যয় করে।
এছাড়া, জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধির চাপে আরো ৭ কোটি ৮০ লাখ থেকে ১৪ কোটি ১০ লাখ মানুষ বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত চরম দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যেতে পারে।

হেলায় হারানো সুযোগ
দরিদ্রদের জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়ে নীতিনির্ধারকরা যত্নশীল থাকলে- তা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এত গুরুতর হতো না। যেমন সাম্প্রতিক সময়ের করোনা মহামারির সময়েই জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানির নির্ভরতা কমিয়ে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে সরে যাওয়ার এক বড় সুযোগ এসেছিল। আমদানির পেছনে প্রতিবছর দেশগুলো যে বিপুল ব্যয় করে, তা কাজে লাগিয়েই স্থানীয়ভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অবকাঠামো তৈরি করতে পারতো। কিন্তু, তা না করে উল্টো জীবাশ্ম জ্বালানির অবকাঠামোর পেছনেই সরকারি অর্থের বিনিয়োগ করেছে।
যেমন জ্বালানি সংকটে জার্মানি কয়লা উৎপাদন বাড়াচ্ছে। কয়লা শিল্পের নতুন অবকাঠামো গড়ছে যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত এবং পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশ। বিভিন্ন দেশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির টার্মিনালও তৈরি করছে। এসব জ্বালানি দূষণকারী এবং একইসঙ্গে যথেষ্টও নয়। প্রচলিত জ্বালানির পেছনে ছুটে আমরা অতি-ব্যয়বহুল অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করছি বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে সত্যিকার গুরুত্বের সাথে নিলে বিশ্বের নীতিনির্ধারকরা এমন কাজ করতে পারতেন না।