এক বছরে পা দিল ভারতের প্রথম জিনগতভাবে পরিবর্তিত ভেড়া ‘তারমিম’, কেমন আছে সে
ভারতের প্রথম জিন-এডিটেড [সম্পাদিত] বা জিনের বিন্যাস পরিবর্তন করা ভেড়া 'তারমিম'-এর বয়স এক বছর পূর্ণ হয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, ভেড়াটি বর্তমানে সম্পূর্ণ সুস্থ আছে এবং স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠছে।
ভারতশাসিত কাশ্মীরে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ভেড়াটির জন্ম হয়। এর নাম রাখা হয় তারমিম; আরবি ভাষায় যার অর্থ পরিবর্তন বা সম্পাদনা।
শ্রীনগরের শের-ই-কাশ্মীর কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ এনক্লোজারে তারমিমকে রাখা হয়েছে। সেখানে তার সঙ্গে রয়েছে তার যমজ বোনও, তবে সেটি জিনগতভাবে অপরিবর্তিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বিবিসিকে জানান, এটি তৈরিতে তারা 'ক্রিসপার' প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। এটি এমন একটি জৈবিক সিস্টেম যা ডিএনএ পরিবর্তন করতে সক্ষম। সহজ কথায়, বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তিকে কাঁচির মতো ব্যবহার করে জিনের দুর্বল বা রোগাক্রান্ত অংশ কেটে ফেলতে পারেন।
গবেষক ড. সুহেল মাগরে বলেন, 'আমরা গর্ভবতী ভেড়া থেকে বেশ কিছু ভ্রূণ সংগ্রহ করি এবং একটি নির্দিষ্ট জিন—যা মায়োস্ট্যাটিন জিন নামে পরিচিত—এডিট করি। এই জিনটি পেশি বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।'
তিনি জানান, ভ্রূণ বা নিষিক্ত ডিম্বাণুগুলোকে ল্যাবে ২-৩ দিন নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রাখার পর একটি মা ভেড়ার (ফস্টার রিসিপিয়েন্ট) গর্ভে স্থাপন করা হয়। এরপর প্রকৃতির নিয়মে ১৫০ দিন পর ভেড়ার বাচ্চা দুটির জন্ম হয়।
মায়োস্ট্যাটিন জিনটি সরিয়ে ফেলার মাধ্যমে ভেড়ার পেশি বা মাংস বৃদ্ধি করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য এবং তাতে তারা সফল হয়েছেন।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক ও ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক রিয়াজ শাহ জানান, তারমিমের শারীরিক ও জৈব-রাসায়নিক সব সূচক স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, 'প্রত্যাশা অনুযায়ী তারমিমের পেশির বৃদ্ধি তার জিন অপরিবর্তিত যমজ বোনের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি আরও বাড়বে বলে আশা করছি।'
ভেড়াটিকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে এবং এর স্বাস্থ্য ও টিকে থাকার ক্ষমতা মূল্যায়নে গবেষণা চলছে।
আট সদস্যের একটি গবেষক দল দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই প্রকল্পে কাজ করেছে। অধ্যাপক শাহ জানান, শুরুতে বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হতে হয়েছে। তারা সাতটি আইভিএফ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন। এর মধ্যে পাঁচটি জীবিত জন্ম এবং দুটি গর্ভপাত হয়। তবে জিন-এডিট সফল হয়েছে মাত্র একটিতে—তারমিমের ক্ষেত্রে।
গবেষকরা এই সফলতায় বেশ উচ্ছ্বসিত। তারা বলছেন, কাশ্মীর উপত্যকায় বছরে প্রায় ৬০ হাজার টন খাসির মাংসের চাহিদা থাকলেও উৎপাদন হয় এর অর্ধেক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নাজির আহমেদ গানাই বলেন, 'জমির পরিমাণ কমছে, পানির স্তর নিচে নামছে এবং জনসংখ্যা বাড়ছে। আমাদের রাজ্যে খাসির মাংসের ঘাটতি রয়েছে। জিন-এডিটিং প্রযুক্তির মাধ্যমে ভেড়ার শরীরের ওজন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এটি টেকসই খাদ্য উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী হবে, কারণ কম পশু পালন করেই বেশি মাংস পাওয়া যাবে।'
সরকার যদি বড় পরিসরে এই প্রযুক্তির ব্যবহারের অনুমতি দেয়, তবে ভেড়ার পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীর খামার তৈরিতেও এটি ব্যবহার করা যাবে বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে আবিষ্কৃত এই জিন-এডিটিং প্রযুক্তি চিকিৎসা গবেষণায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর জন্য ২০২০ সালে এর উদ্ভাবকরা নোবেল পুরস্কারও পান। তবে জেনেটিক মডিফিকেশন (জিএম) বা জিএমও-র সঙ্গে মিল থাকায় এটি নিয়ে নৈতিক বিতর্কও রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য জোর দিয়ে বলছেন, জিন-এডিটিং এবং জিএম সম্পূর্ণ আলাদা। জিন-এডিটিংয়ে প্রাণী বা উদ্ভিদের নিজস্ব জিনের মধ্যেই পরিবর্তন আনা হয়, বাইরে থেকে কোনো জিন প্রবেশ করানো হয় না। আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো ইতিমধ্যে জিন-এডিটেড কিছু প্রাণীকে 'প্রাকৃতিক' হিসেবে গণ্য করে খাওয়ার অনুমতি দিয়েছে।
ভারতে তারমিমকে প্রাকৃতিক হিসেবে গণ্য করা হবে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে অধ্যাপক গানাই আশাবাদী, বিজ্ঞানের হাত ধরেই ভারত যেমন ষাটের দশকে উচ্চ ফলনশীল শস্যের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, তেমনি জিন-এডিটেড প্রাণীর মাধ্যমে মাংস শিল্পেও তারা একই সাফল্য পাবে।
