জিন সম্পাদনায় নতুন সম্ভাবনা: একবারের চিকিৎসায় আজীবনের জন্য কমতে পারে কোলেস্টেরল
একটি জিন কেটে পরিবর্তন করেই একদিন হয়তো বিপজ্জনক মাত্রার উচ্চ কোলেস্টেরল স্থায়ীভাবে কমানো সম্ভব হবে— এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ শনিবার প্রকাশিত এক প্রাথমিক গবেষণা।
গবেষণাটি ছিল অত্যন্ত ছোট পরিসরে— মাত্র ১৫ জন গুরুতর কোলেস্টেরল সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর ওপর পরিচালিত। উদ্দেশ্য ছিল নতুন এক ওষুধের নিরাপত্তা যাচাই, যা প্রয়োগ করা হয় 'ক্রিসপার-ক্যাস৯' প্রযুক্তির মাধ্যমে— এক ধরনের জৈব 'কাঁচি' যা নির্দিষ্ট জিন কেটে বা পরিবর্তন করে তাকে বন্ধ বা সক্রিয় করতে পারে।
প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, চিকিৎসার পর অংশগ্রহণকারীদের 'খারাপ' কোলেস্টেরল এলডিএল প্রায় ৫০% কমেছে। হৃদ্রোগের প্রধান ঝুঁকিকারক এই এলডিএল-ই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর শীর্ষ কারণ। একইসঙ্গে রক্তের অন্য এক চর্বি, ট্রাইগ্লিসারাইড, কমেছে গড়ে ৫৫%।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের সিনিয়র লেখক ডা. স্টিভেন নিসেন বলেন, 'আমরা চাই এটি হোক স্থায়ী সমাধান— যেখানে কম বয়সেই একবারের চিকিৎসায় আজীবন কমে যাবে এলডিএল ও ট্রাইগ্লিসারাইড। এটা যেন এক স্বপ্নপূরণ।'
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ডা. প্রদীপ নাটারাজন বলেন, বর্তমানে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার মাধ্যমে এলডিএল ৪০–৫০ মাত্রায় নামানো অত্যন্ত কঠিন। যদিও আধুনিক ওষুধ দিয়ে এই পর্যায়ে নামানো সম্ভব, তবে নতুন চিকিৎসাটি দীর্ঘমেয়াদে কতটা কার্যকর হয়, তা দেখতে হবে।
ডা. অ্যান মেরি নাভার বলেন, অনেকেই নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার ঝামেলায় পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে একবারের চিকিৎসায় দীর্ঘমেয়াদি ফল পাওয়া গেলে সেটি হবে বিপ্লবী অগ্রগতি। তার ভাষায়, '২০ বছর বয়সে যদি কারও কোলেস্টেরল বেশি থাকে, তার জন্য একবারের চিকিৎসায় ৬০ বছর ওষুধ না খেয়ে থাকা বিশাল সুবিধা।'
এই চিকিৎসার ধারণা এসেছে এক প্রাকৃতিক জিন মিউটেশন থেকে। এএনজিপিটিএল৩ নামে একটি জিন সাধারণত শরীরে এলডিএল ও ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যাদের এই জিন কাজ করে না— যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ২৫০ জনে প্রায় ১ জন— তাদের কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড আজীবন স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, এবং হৃদ্রোগের ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে।
নিসেন বলেন, 'এটি এক প্রাকৃতিক সুরক্ষা। এখন ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা সেই সুবিধা অন্যদের মধ্যেও আনতে পারি।'
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন মাত্রায় ওষুধটি দেওয়া হয় শিরায় ইনফিউশনের মাধ্যমে। সর্বোচ্চ মাত্রা গ্রহণকারীদের এলডিএল ও ট্রাইগ্লিসারাইড যথাক্রমে ৫০% ও ৫৫% পর্যন্ত কমে যায়। গবেষক ডা. লুক লাফিন বলেন, 'এখন পর্যন্ত এমন কোনো চিকিৎসা নেই যা একসঙ্গে এই দুই ধরনের চর্বি কমাতে পারে।'
তবে কিছুটা কমে গেছে 'ভালো' কোলেস্টেরল এইচডিএল। তবে প্রকৃত মিউটেশনধারীদের ক্ষেত্রেও এটি দেখা যায় এবং ক্ষতিকর নয় বলে জানিয়েছেন লাফিন।
গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন ওষুধটি শুধুমাত্র যকৃৎ বা লিভার কোষে জিন পরিবর্তন ঘটায়— শরীরের অন্য কোনো অংশে নয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তুলনামূলক কম বলেই মনে করছেন গবেষকরা।
প্রাথমিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল সামান্য, যেমন ইনফিউশন স্থানে হালকা জ্বালা। একজন অংশগ্রহণকারীর মেরুদণ্ডে ডিস্ক সমস্যার দেখা দেয়, আরেকজনের লিভার এনজাইম কিছুটা বেড়ে যায়, তবে দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যায়। একজন রোগীর মৃত্যু হলেও, গবেষকরা জানিয়েছেন এটি ওষুধের কারণে হয়নি; তিনি অত্যন্ত কম মাত্রা পেয়েছিলেন এবং আগে থেকেই গুরুতর হৃদ্রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
গবেষকরা জানিয়েছেন, মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) অংশগ্রহণকারীদের আগামী ১৫ বছর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখার নির্দেশ দিয়েছে, যেন দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি জানা যায়।
ডা. নিসেন জানান, দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দ্রুতই শুরু হবে এবং বছরের শেষ নাগাদ তৃতীয় ধাপেও যাওয়া হবে। তাঁর ভাষায়, 'এটি বিশাল এক চিকিৎসাগত চাহিদা— লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনো চিকিৎসাবঞ্চিত বা নিয়মিত ওষুধ নিচ্ছেন না।'
তবে ডা. নাভার সতর্ক করেছেন, এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়। অনেক ওষুধই শুরুতে আশাব্যঞ্জক মনে হলেও পরে নিরাপত্তা নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর পরামর্শ, 'যারা বর্তমানে কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ নিচ্ছেন, তারা অবশ্যই তা চালিয়ে যাবেন। যত দীর্ঘ সময় ধরে কোলেস্টেরল কম থাকে, হৃদ্রোগ প্রতিরোধ তত কার্যকর হয়।'
