ফের দোষী সাব্যস্ত মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক
মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় তহবিল 'ওয়ানএমডিবি' কেলেঙ্কারির দ্বিতীয় প্রধান মামলাতেও দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) বিকেলে আদালত তাকে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অর্থ পাচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে। বিলিয়ন ডলারের এই কেলেঙ্কারিটি 'ওয়ানএমডিবি' স্ক্যান্ডাল হিসেবে পরিচিত।
৭২ বছর বয়সী নাজিবের বিরুদ্ধে দেশটির রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম সম্পদ তহবিল '১মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ' (ওয়ানএমডিবি) থেকে প্রায় ২৩০ কোটি মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা প্রায় ৫৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ ছিল।
শুক্রবার বিকেলে বিচারক নাজিব রাজাককে ক্ষমতার অপব্যবহারের চারটি এবং অর্থ পাচারের ২১টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেন। তবে তার সাজার রায় এখনো ঘোষণা করা হয়নি, এটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ওয়ানএমডিবি সংক্রান্ত আগের একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ইতিমধ্যেই কয়েক বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। শুক্রবারের এই রায় এসেছে দীর্ঘ সাত বছরের আইনি প্রক্রিয়া শেষে, যেখানে ৭৬ জন সাক্ষীকে কাঠগড়ায় ডাকা হয়েছিল।
মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রাজায়ায় এই রায় ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সাল থেকে কারাবন্দী এই নেতার জন্য একই সপ্তাহে এটি দ্বিতীয় বড় ধাক্কা। এর আগে গত সোমবার, সাজার বাকি অংশ গৃহবন্দি থেকে কাটানোর জন্য নাজিবের করা আবেদন আদালত খারিজ করে দেয়।
তবে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর এখনো একদল অনুগত সমর্থক রয়েছেন। তারা দাবি করেন, নাজিব অন্যায্য রায়ের শিকার। শুক্রবারও নাজিবের সমর্থনে আদালতের বাইরে ডজনখানেক মানুষ জড়ো হয়ে তার মুক্তির দাবি জানান।
এক দশক আগে ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এলে তা বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়েছিল। এতে মালয়েশিয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তি থেকে শুরু করে গোল্ডম্যান স্যাকস এবং হলিউডের নামও জড়িয়েছিল। তদন্তকারীদের প্রাক্কলন অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় এই তহবিল থেকে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি ডলার ব্যক্তিগত পকেটে সরানো হয়েছিল, যার মধ্যে নাজিবও ছিলেন।
নাজিবের আইনজীবীরা দাবি করেছিলেন, তাকে তার উপদেষ্টারা বিভ্রান্ত করেছিলেন, বিশেষ করে অর্থায়নকারী ঝো লো, যিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও এখনো পলাতক রয়েছেন কিন্তু তার এই যুক্তি মালয়েশিয়ার আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এর আগে ২০২০ সালেও আদালত নাজিবকে অর্থ আত্মসাতের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছিল।
ওই বছর (২০২০), ওয়ানএমডিবি-র সাবেক ইউনিট 'এসআরসি ইন্টারন্যাশনাল' থেকে ৪২ মিলিয়ন রিঙ্গিত বা ১০ মিলিয়ন ডলার নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের দায়ে নাজিবকে ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ পাচার এবং বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তবে গত বছর তার সাজার মেয়াদ অর্ধেক কমানো হয়।
সর্বশেষ এই মামলাটি আরও বড় অংকের অর্থের সাথে সম্পর্কিত, যা ২০১৩ সালে তার ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল। নাজিব বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন এই অর্থ প্রয়াত সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর পক্ষ থেকে অনুদান হিসেবে এসেছে কিন্তু শুক্রবার বিচারক সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।
আলাদাভাবে, নাজিবের স্ত্রী রোসমাহ মনসুরকেও ২০২২ সালে ঘুষ নেওয়ার দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে আপিল বিচারাধীন থাকায় তিনি বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন।
এই কেলেঙ্কারি মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ২০১৮ সালে এটি নাজিবের 'বারিসান ন্যাশনাল' জোটের ঐতিহাসিক নির্বাচনী পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই জোটটি ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশ শাসন করে আসছিল।
এখন সাম্প্রতিক রায়গুলো মালয়েশিয়ার বর্তমান শাসক জোটের মধ্যে ফাটল স্পষ্ট করেছে, যে জোটে নাজিবের দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সোমবার নাজিবের গৃহবন্দিত্বের আবেদন বিফল হওয়ায় তার মিত্ররা হতাশ হলেও একই জোটের মধ্যকার সমালোচকরা একে স্বাগত জানিয়েছেন।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম সব পক্ষের রাজনীতিবিদদের আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সাবেক মালয়েশিয়ান আইনপ্রণেতা টনি পুয়া এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এই রায় দেশের নেতাদের কাছে একটি বার্তা পাঠাবে যে, 'প্রধানমন্ত্রীর মতো দেশের এক নম্বর ব্যক্তি হলেও দুর্নীতির জন্য ধরা পড়তে পারেন।'
তবে মালয়েশিয়ার 'সেন্টার টু কমব্যাট করাপশন অ্যান্ড ক্র্রোনিজম'-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সিনথিয়া গ্যাব্রিয়েল যুক্তি দেন, ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির পর বহু বছর পার হলেও দুর্নীতি দমনে দেশটি খুব সামান্যই অগ্রগতি করেছে।
তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটা শক্তিশালী করা হয়নি যাতে মালয়েশিয়ানরা নিশ্চিত হতে পারে যে, 'যাদের তারা ক্ষমতায় বসাচ্ছে, তারা নিজেদের পকেটের পরিবর্তে জনগণের স্বার্থে কাজ করবে।'
তিনি আরও যোগ করেন, 'বড় ধরনের দুর্নীতি ভিন্ন ভিন্ন রূপে অব্যাহত রয়েছে। আমরা জানি না আরেকটি ওয়ানএমডিবি ঘটবে কি না অথবা হয়তো ইতিমধ্যে ঘটেও গেছে।'
