ছাগলের দুধপানে বেঁচে আছে এতিম হাতি: কেনিয়ায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিচিত্র কায়দা
প্রচণ্ড রোদ, ধুলোয় ধূসর এক প্রাঙ্গণ। চারপাশ বুকসমান উঁচু খুঁটি দিয়ে ঘেরা। কয়েকটা খুঁটির ওপর ছাগলের দুধভর্তি প্লাস্টিকের জগ সাজানো। প্রতিটি জগে কয়েক লিটার দুধ। জগের মুখে লাগানো লাল রঙের নিপল, যা একজন মানুষের আঙুলের সমান বড়।
হঠাৎ প্রাঙ্গণের ওপাশ থেকে ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসতে দেখা গেল একটি হাতি শাবককে। মাথা দুলিয়ে, শুঁড় পেঁচিয়ে আর বিশাল কান দুটো ঝাপটাতে ঝাপটাতে সেটি এগিয়ে আসছে। গাছের গুঁড়ির মতো পা দিয়ে যত জোরে সম্ভব দৌড়াচ্ছে সে। তার পেছনে এল আরও একটি। দেখতে দেখতে যেন হাতির ঢল নামল! একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছে, কমলা রঙের ধুলো ওড়াচ্ছে। যেন ২ হাজার পাউন্ড ওজনের একদল 'শিশু'র আনন্দের মেলা বসেছে।
কেনিয়ার 'রিতেতি এলিফ্যান্ট স্যাংচুয়ারি'র এতিম হাতির শাবকদের তখন দুপুরের খাওয়ার সময়। হাতির পরিচর্যাকারীরা বা কিপাররা ক্ষুধার্ত ছানাগুলোর মুখে পরম মমতায় জগের দুধ ঢেলে দিচ্ছিলেন। খাওয়ানোর সময় তারা গলা ছেড়ে গাইছেন ঐতিহ্যবাহী গান। গানে গানে হাতিদের 'লক্ষ্মী বাচ্চা' বলে প্রশংসা করা হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একেকটি জগ সাবাড়! কোনো কোনো ধুরন্ধর ছানা তো আবার নিজেই শুঁড় দিয়ে জগ জড়িয়ে ধরে এক চুমুকেই দুপুরের খাবার শেষ করে ফেলছে।
কেনিয়ায় দুই সপ্তাহের সফরের তখন প্রায় মাঝামাঝি সময়। এই ভ্রমণে যেমন বন্যপ্রাণী দেখার রোমাঞ্চ ছিল, তেমনি তাদের রক্ষায় কাজ করা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগও ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, পর্যটন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কীভাবে সেখানকার আদিবাসী মানুষের জীবন বদলে দিচ্ছে, তা দেখা যাবে একেবারে কাছ থেকে।
অর্থনীতির চাকা যখন হাতির হাতে
সামবুরু আদিবাসীরা পরিচালনা করে এই অভিনব অভয়ারণ্য। গ্রামবাসী যখন কোনো বাচ্চা হাতিকে তার পরিবার থেকে আলাদা হতে দেখে, তখন তারা সেটিকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে। শুরুতে বড় সমস্যা ছিল—এই এতিম শাবকদের কী খাওয়ানো হবে? বাজারে পাওয়া ফর্মুলা বা গুঁড়ো দুধ বেশ দামি, আবার পুষ্টির দিক থেকেও খুব একটা জুতসই নয়। এর এক জাদুকরি সমাধান মিলল কেনিয়ার গ্রামজুড়ে চরে বেড়ানো ছাগলের পালে। রিতেতির বন্যপ্রাণী সেবকরা জানালেন, ছাগলের দুধ হাতির দুধের দারুণ বিকল্প।
এখন ১ হাজার ২০০-এর বেশি সামবুরু নারী প্রতিদিন রিতেতিতে প্রায় ৭০০ লিটার (১৮৫ গ্যালন) ছাগলের দুধ বিক্রি করেন। এই আয়ে তারা নিজেদের জন্য ভালো পোশাক ও খাবার কিনতে পারছেন। প্রথা ভেঙে তারা খুঁজে পেয়েছেন আর্থিক স্বাধীনতা। টাকা-পয়সার জন্য এখন আর স্বামীদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না।
রিতেতিতে প্রায় ১০০ জন সামবুরু মানুষ কাজ করেন। গর্ব করে তারা বলেন, এটিই আফ্রিকার একমাত্র হাতি অভয়ারণ্য যা পুরোপুরি আদিবাসীদের দ্বারা পরিচালিত।
রিতেতির একজন হাতি পরিচর্যাকারী ডরোথি লোয়াকুতুক। এই সামবুরু নারী অভয়ারণ্যটির মুখপাত্র হিসেবেও কাজ করেন। তিনি বলেন, 'আমরা জোর দিয়েই বলতে পারি, হাতি আমাদের পুরো অর্থনীতির মূল ভিত্তি।'
ভ্রমণের কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত
আমাদের এই সফরের আয়োজক ছিল 'আপলিফ্ট ট্রাভেল'। কেনিয়ার স্থানীয় সম্প্রদায়ের সহায়তার উদ্দেশ্যেই এটি প্রতিষ্ঠিত, যারা বিশেষ করে নারী ও শিশুদের উন্নয়নে কাজ করে। মিশিগানের ভ্রমণ লেখক কিম স্নাইডার ও মানবহিতৈষী তানজা উইটরক মিলে এই গ্রুপটি তৈরি করেছেন। তারা দেখেছিলেন, পর্যটকদের সামান্য অর্থও কীভাবে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।
স্নাইডার বলেন, 'ভ্রমণের নেশা আর মানুষের উপকারের ইচ্ছা—এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই আমি এই উদ্যোগ নিয়েছি।'
সোয়াহিলি ভাষায় 'সাফারি' শব্দের অর্থ 'ভ্রমণ'। এখানকার সড়কপথে চলাচলের প্রায় পুরোটাই এই নামের যোগ্য। ১০০ মাইল (১৬০ কিলোমিটার) রাস্তা পাড়ি দিতেই প্রায় সারা দিন লেগে যেতে পারে। দুই লেনের রাস্তায় ধীরগতির লরির ভিড়। আবার গ্রামের ভেতরের রাস্তায় ছোটখাটো খানাখন্দ বা পিয়ানোর মতো বিশাল গর্ত। এসব রাস্তায় সাত সিটের শক্তিশালী টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারগুলোকে প্রতি মোড়ে মোড়ে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়।
বন্যপ্রাণী এলাকায় আমরা খুব একটা গাড়ি থেকে নামিনি। শুধু বিষুবরেখায় ছবি তুলতে আর তানজানিয়া সীমান্তে উঁকি দিতেই যা একটু নামা।
সফরের শুরুতে আম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্কে আমাদের প্রথম ড্রাইভ ছিল। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমরা হাতি, সিংহ, জিরাফ ও জেব্রা দেখে ফেললাম। এমনকি আফ্রিকার 'বিগ ফাইভ' বা বড় পাঁচ প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে লাজুক চিতাবাঘেরও একঝলক দেখা মিলল। আম্বোসেলিতেই আমাদের দেখা হলো 'টিম লায়নেস'-এর সদস্যদের সঙ্গে। এটি নারীদের নিয়ে গঠিত বন্যপ্রাণী রেঞ্জারদের একটি দল, যারা চোরাশিকার প্রতিরোধে কাজ করে। মাসাই সম্প্রদায়ের মধ্যে ওরাই প্রথম নারী, যারা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে চাকরি করছেন।
নাইরোবির 'শেলড্রিক ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট'-কে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো হাতির এতিমখানা বলা হয়। এখানে প্রতিটি বাচ্চা হাতির জন্য রয়েছে রাজকীয় ব্যবস্থা—আলাদা থাকার ঘর। পরিচর্যাকারীরা বাচ্চাদের সঙ্গেই ঘুমান। মানুষ ও হাতি—দুজনের জন্যই সেখানে আছে আলাদা তোশকের ব্যবস্থা।
'ওল পেজেটা কনজারভেন্সি'-তে আমি আফ্রিকার অন্যতম বিখ্যাত এক বন্যপ্রাণীকে গাজর খাওয়ানোর বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম। তার নাম নাজিন, বয়স ৩৬। পৃথিবীতে টিকে থাকা মাত্র দুটি নর্দার্ন হোয়াইট রাইনো বা সাদা গন্ডারের মধ্যে সে একটি। নাজিন তার ২৫ বছর বয়সী মেয়ে ফাতুর সঙ্গে থাকে। বিশাল তৃণভূমিতে ২৪ ঘণ্টা সশস্ত্র পাহারায় রাখা হয় তাদের। ২০১৪ সালে এই প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডার 'সুদান' মারা যায়। এখন বিজ্ঞানীরা সুদানের শুক্রাণু আর এক সাউদার্ন হোয়াইট রাইনোকে মা (সারোগেট) হিসেবে ব্যবহার করে এই প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
২০১৭ সালের পর থেকে চোরাশিকারিদের হাতে এই কনজারভেন্সির একটি গন্ডারও মারা পড়েনি। তবে বর্তমানে কেনিয়ার বন্যপ্রাণীর জন্য বড় বিপদ হলো প্রাণী ও মানুষের সংঘাত। হাতিরা ফসলের ক্ষেত মাড়িয়ে দেয়, সিংহ আর চিতা গবাদিপশু শিকার করে। আবার মাঝেমধ্যে মাংসের জন্য জিরাফ বা অন্য বন্যপ্রাণী শিকার করে মানুষ।
শেলড্রিকের প্রধান পরিচর্যাকারী এডুইন লুসিচি জানালেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্থানীয় আদিবাসীরা অনেক সময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন।
তবে 'জাপান বি' নামের একটি মাসাই গ্রামে চিত্রটা ভিন্ন। এক পর্যটক জাপানের প্রশংসা করায় গ্রামবাসী শখ করে এই নাম রেখেছিলেন। গ্রামের প্রধান আমাদেরকে ৩৩টি মৌচাকের একটি শৃঙ্খল দেখালেন। এগুলো সিংহ ও হাতিকে দূরে রাখতে ব্যবহার করা হয়। ছোট এই পতঙ্গের গুঞ্জন আর হুলের ভয়ে বিশাল বন্যপ্রাণীরাও সতর্ক থাকে।
বুনো পরিবেশে বিলাসী রাত
কেনিয়ার বন্যপ্রাণী রিজার্ভগুলোতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল সেরেনা হোটেলসে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এদের বিলাসবহুল রিসোর্ট ও হোটেল রয়েছে। ঘর বা কেবিনগুলোতে সাফারির আমেজ। কয়েক জায়গায় কেবিনগুলো দেখতে তাঁবুর মতো—ওপরে ক্যানভাসের ছাদ, কিন্তু নিচে পাকা মেঝে। সেখানে বিদ্যুৎ ও গরম পানির ঝরনা থেকে শুরু করে সকাল-রাতের বুফে খাবার, সবই ছিল।
তবে সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল মাসাই অঞ্চলের 'কিলেলিওনি মারা গেটওয়ে হাউস'-এ থাকার অভিজ্ঞতা। এটি একটি খোলামেলা ও আরামদায়ক বাড়ি। ঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর পাঁচটি অতিথি কক্ষ ও দুটি কটেজ। মনে হচ্ছিল কোনো মাসাই বন্ধু আমাদের তার গ্রামের বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছেন। খোলা আকাশের নিচে লম্বা টেবিলে বসে আমরা মাংস ও সবজির স্টু খেলাম। এই সরাইখানার মালিক ইয়ান্তি 'সিলভিয়া' লেরিওনকা। তিনি এখান থেকে যা আয় করেন, তা দিয়ে একটি গ্রামের খরচ জোগান, যেখানে নির্যাতিত ও বিধবা নারীরা আশ্রয় পান।
কেনিয়ায় আমাদের শেষ রাতে জানানো হলো, আমরা যদি প্রত্যেকে ২০ ডলার করে দিই, তবে সিলভিয়ার গ্রামের নারীদের জন্য একটি গরু কেনা যাবে। দুর্ভাগ্যবশত, সেদিন গরুর দাম ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে আমাদের জমানো ২৪০ ডলারে শেষমেশ একটি এঁড়ে বাছুর কেনা সম্ভব হয়েছিল। এই ছোট উপহারটুকুই ছিল আমাদের ভ্রমণের এক বড় প্রাপ্তি।
খরচাপাতি
আপলিফ্ট ট্রাভেলের সাফারিগুলোর সময় ও রুট ভিন্ন ভিন্ন হয়, তাই খরচও কমবেশি হতে পারে। সাধারণত ১৪ দিনের একটি ট্রিপে আবাসন, খাওয়া, যাতায়াত ও গাইডসহ জনপ্রতি খরচ হতে পারে প্রায় ৯ হাজার ডলার (এক রুমে দুজন ভিত্তিতে)।আর ২০২৫ সালের মে মাসে শিকাগো থেকে লন্ডন হয়ে নাইরোবি যাওয়ার বিমান ভাড়া ছিল ১ হাজার ৪২৬ ডলার।
