২০৩৫ সালের মধ্যে নতুন পেট্রোল-ডিজেল চালিত গাড়ি বিক্রি বন্ধের পরিকল্পনা শিথিল করল ইইউ
ইউরোপীয় কমিশন ২০৩৫ সালের মধ্যে নতুন পেট্রোল এবং ডিজেল গাড়ি বিক্রি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনাটি শিথিল করেছে। খবর বিবিসির।
বিদ্যমান নিয়ম অনুসারে, ঐ তারিখ থেকে বিক্রি হওয়া নতুন গাড়িগুলো 'শূন্য কার্বন নির্গমনকারী' হতে হবে। তবে গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো, বিশেষ করে জার্মানির সংস্থাগুলো, এই বিধিনিষেধ শিথিলের জন্য ব্যাপক তদবির চালিয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল থেকে বিক্রি হওয়া ১০০ শতাংশ নতুন গাড়ির পরিবর্তে এখন ৯০ শতাংশকে 'শূন্য কার্বন নির্গমনকারী' হতে হবে।
ইউরোপীয় গাড়ি প্রস্তুতকারকদের সংগঠন এসিইএ-এর মতে, বর্তমানে বাজারে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা খুবই কম। নিয়ম পরিবর্তন না হলে প্রস্তুতকারকরা "কয়েক বিলিয়ন ইউরো" জরিমানার ঝুঁকিতে পড়তেন।
বাকি ১০ শতাংশ হতে পারে সাধারণ পেট্রোল বা ডিজেল চালিত গাড়ি। এর পাশাপাশি হাইব্রিড গাড়িও থাকতে পারবে।
গাড়ি নির্মাতারা তাদের যানবাহনে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তৈরি পরিবেশবান্ধব ইস্পাত ব্যবহার করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পেট্রোল ও ডিজেল গাড়ির কারণে হওয়া অতিরিক্ত দূষণ রোধে কমিশন বায়োফুয়েল এবং 'ই-ফুয়েল' ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এই বিশেষ জ্বালানিটি মূলত বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড সংগ্রহ করে তৈরি করা হয়।
এই পদক্ষেপের বিরোধীরা সতর্ক করেছেন যে, এটি বৈদ্যুতিক যানবাহনের দিকে যাত্রার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বিদেশি প্রতিযোগিতার মুখে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।
পরিবেশবান্ধব পরিবহন বিষয়ক গোষ্ঠী 'টিঅ্যান্ডই' সতর্ক করে বলেছে, যুক্তরাজ্যের উচিত হবে না ইউরোপীয় ইউনিয়নের পথ অনুসরণ করে তাদের 'জিরো এমিশন ভেহিকল ম্যান্ডেট'-এর অধীনে প্রচলিত গাড়ি বিক্রয় বন্ধ করার পরিকল্পনা শিথিল করা।
টিঅ্যান্ডই ইউকে-এর পরিচালক আনা ক্রাজিনস্কা বলেন, "যুক্তরাজ্যকে অবশ্যই নিজের অবস্থানে অটল থাকতে হবে। আমাদের জিরো এমিশন ম্যান্ডেট ইতোমধ্যেই দেশে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবন নিয়ে আসছে। বড় রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আমরা উদ্ভাবন ছাড়া টিকে থাকতে পারব না, আর বিশ্ববাজার অত্যন্ত দ্রুত বৈদ্যুতিক যানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।"
এই ঘোষণার আগে, এসিইএ-এর মহাপরিচালক সিগ্রিড ডি ভ্রিস বলেছিলেন, নির্মাতাদের জন্য নিয়মের 'নমনীয়তা' এখন 'অত্যন্ত জরুরি'।
তিনি বলেন, "২০৩০ সাল একদম সন্নিকটে, আর বাজার চাহিদা এতই কম যে নির্মাতাদের পক্ষে কয়েকশ কোটি ইউরোর জরিমানা এড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "চার্জিং পয়েন্ট তৈরি করা এবং বাজারকে সঠিক পথে আনতে কর সুবিধা ও ক্রয় প্রণোদনা চালু করতে সময় লাগবে। কর্মসংস্থান, উদ্ভাবন এবং বিনিয়োগ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নীতি-নির্ধারকদের অবশ্যই নির্মাতাদের কিছুটা স্বস্তির সুযোগ দিতে হবে।"
যুক্তরাজ্যের গাড়ি নির্মাতারা এর আগে সরকারের ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন পেট্রোল ও ডিজেল গাড়ি বিক্রির পরিকল্পিত নিষেধাজ্ঞার আগে চালকদের বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনতে উৎসাহিত করতে আরও ভালো প্রণোদনার দাবি জানিয়েছিল।
পরিবেশগত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারগুলো যখন মানুষকে পরিবেশবান্ধব গাড়ি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছে, তখন বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি তাদের প্রোডাকশন লাইন পরিবর্তন করছে এবং শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে।
ভলভো জানিয়েছে যে তারা "১০ বছরেরও কম সময়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ইলেকট্রিক ভেহিকল পোর্টফোলিও তৈরি করেছে" এবং হাইব্রিড গাড়িগুলোকে রূপান্তরের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে পুরোপুরি বৈদ্যুতিক যানের দিকে যেতে প্রস্তুত। সংস্থাটি যুক্তি দিয়েছে যে, তারা যদি পেট্রোল ও ডিজেল চালিত যানবাহন থেকে সরে আসতে পারে, তবে অন্য কোম্পানিগুলোরও তা পারা উচিত।
গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি (ভলভো) বলেছে, "সাময়িক লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতিগুলো শিথিল করা আগামী কয়েক বছরের জন্য ইউরোপের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।"
তারা আরও জানায়, "একটি সুসংগত ও উচ্চাভিলাষী নীতিমালা এবং সেই সাথে সরকারি অবকাঠামোতে বিনিয়োগই গ্রাহক, জলবায়ু এবং ইউরোপের শিল্প সক্ষমতার জন্য প্রকৃত সুফল বয়ে আনবে।"
তবে, জার্মান গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভক্সওয়াগেন নতুন কার্বন নির্গমন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের খসড়া প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে এবং একে "সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত" বলে অভিহিত করেছে।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, "ভবিষ্যতে ছোট বৈদ্যুতিক যানবাহনগুলো বিশেষ সহায়তা পাবে—এই বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। ২০৩০ সালের কার্বন নির্গমন লক্ষ্যমাত্রা যাত্রীবাহী গাড়ির জন্য আরও নমনীয় করা এবং হালকা বাণিজ্যিক যানবাহনের ক্ষেত্রে তা সমন্বয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
তারা আরও জানায়, "দূষণ পুষিয়ে দেওয়ার শর্তে দহন ইঞ্জিন চালিত যানবাহনের জন্য বাজার উন্মুক্ত রাখা একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ এবং এটি বর্তমান বাজার পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।"
থিংক ট্যাঙ্ক 'এনার্জি অ্যান্ড ক্লাইমেট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট'-এর পরিবহন প্রধান কলিন ওয়াকার বলেছেন, যুক্তরাজ্যের একটি স্থিতিশীল নীতিমালা থাকলে তা কোম্পানিগুলোকে চার্জিং অবকাঠামোতে বিনিয়োগের আত্মবিশ্বাস জোগাবে এবং বিনিয়োগকে ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, "সরকারি নীতির কারণেই সান্ডারল্যান্ডকে নিসানের প্রথম ইলেকট্রিক 'লিফ' তৈরির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। আজ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিসানের সর্বাধুনিক বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন শুরু হয়েছে, যা আগামী অনেক বছরের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করবে।"
অক্টোপাস ইলেকট্রিক ভেহিকলস-এর প্রধান নির্বাহী ফিওনা হাওয়ার্থ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ব্রাসেলসের (ইইউ) পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাজ্য যদি তার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেয়, তবে তা "বিনিয়োগকারী, নির্মাতা এবং সরবরাহকারী অংশীদারদের কাছে একটি নেতিবাচক বা ক্ষতিকারক বার্তা পাঠাবে।"
তিনি আরও বলেন, এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে "যুক্তরাজ্য তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে—এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে" এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় বিপুল বিনিয়োগ করেছে।
