ইউক্রেনের টাকা তলানিতে, ইউরোপের কাছেও নেই ভালো কোনো বিকল্প
ইউক্রেনকে যুদ্ধে পরবর্তী ধাপের লড়াইয়ে সাহায্য করার জন্য রাশিয়ার জব্দ বা স্থগিত করা সম্পদ ব্যবহার করে কিয়েভকে ঋণ দেওয়ার একটি পরিকল্পনা করেছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা। গত মাসখানেক ধরে তারা এটি নিয়ে গুরুত্ব-সহকারে কাজও করছেন। কিন্তু, এটি এখন স্পষ্ট যে এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে ইইউ-এর কাছে ভালো কোনো বিকল্প নেই।
আর বিকল্প যা আছে, সেটি আরও খারাপই হবে।
বেলজিয়ামে জব্দ রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে প্রায় ১৪০ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলার) অর্থায়নের এই ঋণ পরিকল্পনা করে, যা গত মাসে ইইউ -এর রাজনৈতিক বৈঠকে উত্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু, শেষ মুহূর্তের চমক হিসেবে বেলজিয়াম এটি আটকে দিয়েছে।
বেলজিয়ামের কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া যদি মামলা করে বা তাদের টাকা ফেরত চায়— তাহলে দেশটি ঝুঁকিতে পড়তে পারে। সেই ঝুঁকি কমানোর জন্য, তারা দাবি করছে যে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো গ্যারান্টির মাধ্যমে এই ঝুঁকি ভাগ করে নেওয়ার জন্য দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হোক। তবে এই সুপারিশটির বিরোধিতা করেছে স্লোভাকিয়া। তারা ইউরোপীয় কমিশনের ওপরও চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে তারা ইউক্রেনকে অর্থ প্রদানের জন্য অন্যান্য উপায় বিবেচনা করা হয়।
ইউরোপীয় কমিশন গত সোমবার ইউরোপের রাজধানীগুলোতে পাঠানো একটি চিঠিতে সেই বিকল্পগুলো উল্লেখ করেছে, যা দ্য নিউইয়র্ক টাইমস দেখেছে। এর মধ্যে একটি বিকল্প হলো–- ইউক্রেনের প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ ঋণ জারি করা। অন্যটি হবে প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র ইউক্রেনকে সরাসরি অনুদান দিতে পারে। কিন্তু উভয়টিতেই সমস্যা রয়েছে। যৌথ ঋণ ব্যয়বহুল হবে, যার সঙ্গে সুদের খরচ জড়িত থাকবে, এবং সরাসরি অনুদান ইতিমধ্যেই ঋণে জর্জরিত দেশগুলোর বাজেটকে চাপে ফেলবে।
এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে, ব্রাসেলসের নীতিনির্ধারক, কূটনীতিক এবং বাইরের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ থেকে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনাটি শেষপর্যন্ত কার্যকর হবে। এতে জটিলতা থাকলেও– অন্য বিকল্পগুলো এই মুহুর্তে এতটাই নিরাশজনক যে, এ পথেই এগোতে হবে।
ব্রাসেলসের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ব্রুগেল -এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ওয়াশিংটনের পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্স-এর নিকোলাস ভেরন বলেন, "যা স্পষ্ট তা হলো, প্ল্যান বি, প্ল্যান এ-এর চেয়ে কম ভালো। ইউক্রেনকে টাকা না দেওয়া কি একটি বিকল্প? উত্তর হলো 'না'।"
ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন গত সপ্তাহে বলেন যে, যদিও অন্য দুটি বিকল্প বিদ্যমান, তবে রাশিয়ার জব্দ সম্পদ ব্যবহার করে ঋণ দেওয়াটি "ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা এবং তার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।"
এদিকে রাশিয়ার ফ্রোজেন অ্যাসেট থেকে ঋণের পরিকল্পনাটি বেশকিছু সুবিধা দেবে। এতে ইইউ ইউক্রেনকে শূন্য সুদে ঋণ দিতে সক্ষম হবে, যা শুধুমাত্র রাশিয়া যদি কখনো কিয়েভকে ক্ষতিপূরণ দেয় তাহলেই ফেরত দিতে হবে। এছাড়া এই পদক্ষেপের মাধ্যমে রাশিয়াকে একটা বড় বার্তা দেওয়া হবে যে, ইউক্রেনের কাছে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তহবিল রয়েছে।
বিকল্পগুলো যে কেবল আর্থিকভাবে বেশি চাপ সৃষ্টি করবে তা-ই নয়, বরং সেগুলোর মাধ্যমে ইউক্রেনে সম্ভবত অনেক কম এবং ধাপে ধাপে অর্থ পৌঁছাবে।
রাজনৈতিক ঝুঁকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান— ইউরেশিয়া গ্রুপের ইউরোপ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজতবা রহমান বলেন, যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ওই বিকল্পগুলোর কোনো একটি ব্যবহার করতে হয়, তবে "এটি পুতিনের মনে এই ধারণাটিকে আরও শক্তিশালী করবে যে সময় তার পক্ষেই আছে।"
কিন্তু বেলজিয়াম যে ধরণের নিশ্চয়তা চাইছে, তা দিতে ইইউ-এর কিছু দেশ অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো সতর্ক করে বলেছেন, এই অর্থ যদি সামরিক ব্যয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়—তবে তার দেশ এমন ব্যবস্থার বিরোধিতা করবে।
রাশিয়া গত সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে আরেকটি সতর্কবার্তা জারি করে বলেছে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলে তারা বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। যদিও ইইউ কর্মকর্তারা স্পষ্ট করেছেন যে তারা সম্পদের বিপরীতে ঋণ দেওয়াকে সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ হিসেবে দেখছেন না, কিন্তু রাশিয়া এই পার্থক্য স্বীকার করে না।
এমনকি ইউরোপীয় কমিশনও সোমবার তাদের চিঠিতে স্বীকার করেছে যে, জব্দ করা সম্পদের বিপরীতে ঋণ দেওয়াকে রাশিয়ার সঞ্চয় 'বাজেয়াপ্ত' হিসেবে "ভুলভাবে ব্যাখ্যা" করার ঝুঁকি রয়েছে—যা ইউরোপে অর্থ রাখা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করতে পারে।
তবুও, কমিশন সতর্ক করে বলেছে যে "নিখুঁত বা সহজ সমাধানের খোঁজ করা উচিত নয়, কারণ বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই।"
এমতাবস্থায়, ইইউ সদস্যদের ঐকমত্যে পৌঁছানোর সময়ও হয়তো ফুরিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুমান করেছে যে, ২০২৬ ও ২০২৭ সালের জন্য ইউক্রেনের বাজেট ঘাটতি প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ডলার হবে।
ইইউ কর্মকর্তারা নিয়মিতই ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে মার্চ বা এপ্রিলের মধ্যে ইউক্রেনের নতুন অর্থের প্রয়োজন হবে। কিন্তু আগামী ১৮ ডিসেম্বর ইইউ -এর রাজনৈতিক নেতাদের পরবর্তী বৈঠকের মধ্যে তারা কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
ইউরোপীয় অর্থনীতি বিষয়ক কমিশনার ভালদিস ডোমব্রোভস্কিস পরামর্শ দিয়েছেন, যদি ঋণ দিতে খুব বেশি দেরি হয়, তবে বসন্তকালে তহবিলের ঘাটতি মেটাতে ইইউকে অন্য সমাধানের কথা ভাবতে হতে পারে। কমিশনের চিঠিতে এ সপ্তাহে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, সময়মতো ইউক্রেনে অর্থ পৌঁছানো নিশ্চিত করতে বিকল্পগুলোকে একসঙ্গে, অথবা সাময়িকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
