দুবাই এয়ারশো: পশ্চিমা জেট অর্ডারের পাশাপাশি চীনের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী বিমানের আত্মপ্রকাশ
দুবাই এয়ারশোতে এবার আলোচনার ঝড় উঠবে কয়েকটি বিষয় নিয়ে। বিমান ডেলিভারিতে দেরি হচ্ছে, চীন চাইছে এয়ারবাস ও বোয়িং -এর রাজত্ব শেষ করতে। এদিকে সারা বিশ্বে রাজনৈতিক উত্তেজনাও বাড়ছে।
এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উপসাগরীয় দেশগুলো সফর করেন। সেই সফরে বোয়িং কয়েক বিলিয়ন ডলারের অর্ডার পেয়েছিল। এর ফলে দুবাই এয়ারশোর আকর্ষণ অনেকটাই কমে যায়। কারণ, বড় ঘোষণাগুলো আগেই হয়ে গিয়েছিল।
তবে এবার এয়ারবাসের ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। এ বছর তারা বোয়িং-এর চেয়ে অর্ডার পাওয়ায় পিছিয়ে আছে। তাই এই শো-তে নতুন নতুন ঘোষণা দিয়ে তারা সেই ব্যবধান কমাতে চায়। তবে বোয়িং-ও বসে নেই। ১৭ থেকে ২১ নভেম্বরের এই অনুষ্ঠানের আগে তারাও কিছু নতুন চুক্তির কথা জানাবে।
অর্ডার জেতার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকবে কারা?
ভেতরের খবর হলো, কম খরচের বিমান সংস্থা ফ্লাইদুবাই এবার ইউরোপ থেকে বিমান কেনার কথা ভাবছে। তারা এয়ারবাস ও বোয়িং—উভয়ের থেকেই বিমান কিনতে পারে। এমনটা হলে, ফ্লাইদুবাইয়ের ওপর বোয়িং-এর দীর্ঘদিনের প্রভাব কমে যেতে পারে।
এ নিয়ে এয়ারবাস বা বোয়িং কেউই মুখ খোলেনি। ফ্লাইদুবাই-এর কাছ থেকেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিমান চলাচল পরামর্শক সংস্থা আইবিএ-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ স্টুয়ার্ট হ্যাচার মনে করেন, এবারের শো-তে প্রায় ৩০০টি বিমান কেনার অর্ডার আসতে পারে। এই সংখ্যা সেরা বছরগুলোর তুলনায় প্রায় অর্ধেক। এর মধ্যে এমিরেটস এয়ারলাইনস এয়ারবাস এ৩৫০-১০০০ জেট কেনার জন্য একটি বড় চুক্তি করতে পারে।
ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, গত শো-তে ইঞ্জিনের মান নিয়ে সমস্যা হওয়ায় এমিরেটস অর্ডার দেয়নি। এখন এয়ারবাস সেই সমস্যা মিটিয়ে অন্তত ৩০টি দূরপাল্লার জেট বিক্রির জন্য আলোচনা করছে। আবুধাবির ইতিহাদ এয়ারওয়েজও এক ডজনের বেশি এয়ারবাস বিমান কেনার অর্ডার দিতে পারে।
তবে অনুষ্ঠানের সব উত্তেজনার মাঝে একটি খারাপ খবরও আছে। বোয়িং-এর ৭৭৭এক্স মডেলটি ডেলিভারি দিতে আরও দেরি হবে। এই খবরটি সবাইকে হতাশ করেছে। অথচ ১২ বছর আগে এই বিমানটি উদ্বোধনের সময় ১০০ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার পেয়েছিল।
৪০০ আসনের এই জেটের প্রধান ক্রেতা হলো এমিরেটস। বিমানগুলোর নির্মাণ এমনিতেই সাত বছর পিছিয়ে আছে। অন্যদিকে, এয়ারবাস তাদের ছোট বিমানগুলোও সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারছে না।
স্টেজ উইং অ্যাডভাইজরি-র প্রতিষ্ঠাতা মারজান রিগি বলেন, 'বিমানের চাহিদা প্রচুর, কিন্তু কোম্পানিগুলো সময়মতো জোগান দিতে পারছে না। যদিও অর্থনীতির অন্য খাতগুলো ভালো করছে।'
নতুন বিমান না পাওয়ায় এমিরেটস ও অন্যান্য সংস্থাগুলো বিপদে পড়েছে। তারা বাধ্য হয়ে তাদের পুরোনো বিমানগুলোকেই আরও বেশি দিন চালাচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে মালবাহী বিমানের বাজারেও। পুরোনো যাত্রীবাহী বিমানকে মালবাহী বিমানে রূপান্তর করা কমে গেছে। ফলে নতুন মালবাহী বিমানের চাহিদা এখন অনেক বেশি। এয়ারবাস জানিয়েছে, তারা এয়ার চায়না কার্গোকে ছয়টি এ৩৫০ মালবাহী বিমান বিক্রি করেছে।
এবারের এয়ারশোটি আয়োজক সংস্থা এমিরেটস-এর ৪০তম বর্ষপূর্তিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সারা বিশ্বে কানেক্টিং ফ্লাইট চালুর মাধ্যমে এই এমিরেটসই উপসাগরীয় অঞ্চলকে বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
তবে কেউ কেউ ভাবছেন, তুরস্ক, ভারত এবং এখন সৌদি আরবের মতো দেশগুলো যেভাবে এগিয়ে আসছে, তাতে উপসাগরীয় এয়ারলাইনগুলোর দাপট কি কমে যাবে? অ্যারোডাইনামিক অ্যাডভাইজরি-র বিশ্লেষক রিচার্ড আবুলাফিয়া বলেন, 'আসলে সবাই একই ধরনের যাত্রী পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে।'
কিন্তু এখনও পর্যন্ত যাত্রীর চাহিদা কমেনি। এয়ারবাস-এর মধ্যপ্রাচ্যের প্রাক্তন পরিচালক হাবিব ফেকিহ বলেন, 'এমিরেটস যখন শুরু হয়েছিল, তখন সবাই বলেছিল গালফ এয়ার বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর বলা হলো, কাতার এয়ারওয়েজ এমিরেটস-এর পথ আটকে দেবে। ইতিহাদ-এর সময়ও একই কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এর কোনোটিই ঘটেনি, বরং সবাই উন্নতি করেছে।'
তিনি আরও বলেন, নতুন করে জেগে ওঠা এয়ার ইন্ডিয়া প্রচুর বিমান কিনছে। তারা হয়তো উপসাগরীয় অঞ্চলের কিছু যাত্রী নিজেদের দিকে টানতে পারবে, তবে এতে বেশ সময় লাগবে।
বহু বছর ধরে বিমানের বাজারে রাজত্ব করছে এয়ারবাস ও বোয়িং। কিন্তু তাদের সেই আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
কারণ চীনের কোম্যাক কোম্পানি তাদের সি৯১৯ বিমান নিয়ে হাজির হয়েছে। এশিয়ার বাইরে এই প্রথমবার বিমানটি প্রদর্শন করা হচ্ছে। এটি বোয়িং ৭৩৭ এবং এয়ারবাস এ৩২০নিও-এর মতো জনপ্রিয় বিমানের প্রতিযোগী। চীন এখন উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে, তাই তারা এখানে বিমান বিক্রির চেষ্টা করবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তা ছাড়পত্র পেতে এই বিমানটির বহু বছর লেগে যেতে পারে।
যুদ্ধবিমান নিয়েও ব্যাপক আগ্রহ
এই প্রদর্শনীটি শুধু যাত্রীবাহী বিমান নয়, অস্ত্র শিল্পের জন্যও একটি বড় মঞ্চ। যদিও এখানে খুব কমই সরাসরি কোনো অস্ত্রের চুক্তি ঘোষণা করা হয়।
ট্রাম্পের সফরের পর উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, সেই সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা। কারণ, পুরোনো চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল এই অঞ্চলে সামরিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী থাকে। কিন্তু এখন উপসাগরীয় দেশগুলোও আমেরিকার সেরা যুদ্ধবিমানগুলো পাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।
অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল সৌদি আরব এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কিনতে চায়। সেই আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে লকহিড মার্টিন এই অঞ্চলে আরও বেশি ব্যবসার সুযোগ পাবে। রয়টার্স জানিয়েছে, ৪৮টি এফ-৩৫ জেট সৌদি আরবকে বিক্রি করার একটি প্রস্তাব পেন্টাগনে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং কাতার এফ-৩৫ কেনার আগ্রহ দেখালেও কোনো চুক্তি হয়নি।
ক্যাপিটাল আলফা পার্টনার্স-এর বায়রন ক্যালান বলেন, 'যদি সৌদি আরবকে এফ-৩৫ কেনার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে কি ইউএই এবং এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর জন্যও সেই দরজা খুলে যাবে?'
এদিকে, রাশিয়াও পিছিয়ে নেই। তারা তাদের এসইউ-৫৭ই স্টিলথ যুদ্ধবিমান প্রথমবারের মতো দুবাইতে প্রদর্শন করবে, যাতে নতুন ক্রেতা আকর্ষণ করা যায়।
মার্কিন প্রতিরক্ষা স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি অ্যান্ডুরিল নামে একটি মার্কিন কোম্পানি আবুধাবির এজ -এর সঙ্গে মিলে ড্রোন তৈরি করার জন্য একটি চুক্তি করেছে।
