‘জোরহান’, ‘মানদানি’, ‘মানদামি’: কেন জোহরান মামদানির নাম উচ্চারণে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মার্কিন রাজনীতিকরা?
'মি. মানদানি'
'মি. মানদামি'
'জোরহান মানদামি'
'জোহরান মানদামি'
এগুলো নিউইয়র্ক সিটি মেয়র পদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী জোহরান মামদানির নামের কিছু বহুল প্রচলিত 'সংস্করণ'!
গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হওয়া মেয়র নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ত্রিমুখী বিতর্কে এক অপ্রত্যাশিত বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে: প্রবীণ রাজনীতিকদের কাছে একজন প্রার্থীর নাম উচ্চারণ করাটাই যেন সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে, জোহরান মামদানির নাম বারবার বিকৃত করে উচ্চারণ করার অভিযোগ ওঠে, এমনকি তা নিয়ে তীব্র বিতর্কও দেখা যায়।
বিতর্কের এক ঘণ্টারও বেশি সময় পরও সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু এম কুমো একবারও এই দৌড়ে এগিয়ে থাকা প্রার্থীর নামটি উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি তাকে কেবল 'অ্যাসেম্বলিম্যান' এবং সাবেক মেয়র বিল ডি ব্লাসিওর একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে আখ্যায়িত করে দায়িত্ব সারেন। নির্বাচনী প্রচারে বারবার ভুলভাবে উচ্চারণ করার পর, এক ধরনের 'আত্মসংযম' দেখিয়ে বিতর্কেও তিনি সেই নামটি বলা থেকে বিরত থাকেন। তার উচ্চারণ এতটাই ভুল ছিল যে, গত জুন ডেমোক্রেটিক প্রাইমারি বিতর্কে অ্যাসেম্বলিম্যান জোহরান মামদানি নিজেই তাকে সসম্মানে উচ্চারণগত ভুল ধরিয়ে দেন।
তবে শুধু কুমোই নন, নানা কারণে মামদানির প্রথম ও শেষ নামটি উচ্চারণের ক্ষেত্রে বেশ অদ্ভুত এবং এমনকি সৃজনশীল ভাষাগত বিভ্রাটের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া গত সপ্তাহে সাধারণ নির্বাচনের প্রথম বিতর্কে তার নাম বলতে হিমশিম খেয়েছিলেন, তাকে 'জোর-হান' বলে ডেকেছিলেন। এমনকি নিউইয়র্কে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং মামদানির একজন প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী লেটিটিয়া জেমসও এই মাসে ওয়াশিংটন হাইটসে একটি বড় নির্বাচনী জনসভায় তার নাম ভুলভাবে উচ্চারণ করেন, মঞ্চে আসার সময় তাকে উৎসাহের সাথে 'মানদামি' বলে চিৎকার করে স্বাগত জানান!
মামদানির জন্য, তার নাম বিকৃত করা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ম্যানহাটনে একজন অভিবাসী হিসেবে বেড়ে ওঠার সময় তার নামের ভুল উচ্চারণ ছিল একটি সাধারণ ঘটনা। তিনি বলেন, 'এটা প্রায়ই ঘটতো। তবে সত্যি বলতে, যারা চেষ্টা করে এবং ভুল করে, তাদের প্রতি আমার কোনো বিরক্তি নেই। চেষ্টা করাটাই আমার কাছে সব।'
শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়ার দৌড়ে থাকা মামদানি অবশ্য মনে করেন, কুমোর মতো কিছু ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তার নাম ভুল উচ্চারণ করছেন অথবা সঠিকভাবে বলার চেষ্টা করেন না। তিনি বলেন, 'যারা আমার নাম ভুল উচ্চারণ করার জন্য অতিরিক্ত চেষ্টা করেন, সেটা কোনো ভুল নয়, সেটা একধরণের বার্তা।'
সাবেক মেয়র ডি ব্লাসিও মামদানির আরেকজন সহযোগী, যিনি স্বীকার করেছেন যে তিনিও তার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন। ডি ব্লাসিও বলেন, 'আমি মনে করি আমি এখন কাছাকাছি আছি, তবে আমার বেশ কিছুদিন লেগেছে!' তিনি যোগ করেন, 'আমার মনে হয় আমেরিকান ইংরেজির কানে, এই নামের গঠনটা কিছুটা অপ্রত্যাশিত। এর ছন্দটা সঠিকভাবে ধরতে কিছু অনুশীলন লাগে।'
স্লিওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান যে তিনি ভালো করার চেষ্টা করছেন: 'সময় লাগবে। এটা ইচ্ছাকৃত নয়।' স্লিওয়া, যার শেষ নামও অনেকে ভুল উচ্চারণ করে থাকেন, তিনি বলেন যে তিনি মামদানির কষ্ট বোঝেন। তিনি বলেন, 'গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলস প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৪৬ বছরের মধ্যে প্রায় ৩৩ বছর আমার নাম ক্রমাগত ভুল উচ্চারণ করা হয়েছে। আমি এতে অবশ্য আপত্তি করি না।'
তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মামদানির নাম বলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়তো এতোটাও উদারভাবে দেখা যেতে পারে না, কারণ ট্রাম্প বারবার এই প্রার্থীর ওপর কথায় আক্রমণ করে তাকে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছেন। তার প্রেস সেক্রেটারি, ক্যারোলিন লিভিট, তার প্রথম এবং শেষ নামের অংশগুলিকে একত্রিত করে আরও অদ্ভুত উচ্চারণ ব্যবহার করেছিলেন।
তবে কিছু ভুল উচ্চারণ ইচ্ছাকৃত হলেও, বেশ কয়েকজন ভাষাতত্ত্ববিদ দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন যে, মামদানির প্রথম এবং শেষ উভয় নামেই এমন অক্ষর বিন্যাস এবং স্বরধ্বনি রয়েছে যা ইংরেজিতে সাধারণত দেখা যায় না। তাই অনেকের পক্ষে এটি উচ্চারণ করতে হিমশিম খাওয়াটা আশ্চর্যজনকও কিছু নয়।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক জিলিয়ান গ্যালাগার জানান, ইংরেজিতে 'মড' এর চেয়ে 'নড' ক্রমযুক্ত শত শত শব্দ বেশি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই ধরনের ব্যঞ্জনবর্ণের গুচ্ছ ভুল উচ্চারণের কারণ হতে পারে। একটি প্রক্রিয়া, যা অ্যাসিমিলেশন নামে পরিচিত, তাতে মামদানির শেষ নামের দ্বিতীয় 'ম' অক্ষরটি 'ন'-এ পরিবর্তিত হয়ে 'মানদানি'র মতো শোনাতে পারে। অন্য একটি প্রক্রিয়া, যা সাবস্টিটিউশন নামে পরিচিত, তাতে বক্তারা মামদানির 'ন' অক্ষরটিকে অন্য একটি 'ম' দিয়ে প্রতিস্থাপন করে ফেলেন।
এই ধরনের কথার প্যাটার্ন এড়িয়ে চলা কঠিন হতে পারে। এনওয়াইইউ সোসিওলিঙ্গুইস্টিক্স ল্যাবের সহ-পরিচালক অধ্যাপক লরেল ম্যাকেনজি বলেন, 'মামদানিতে 'ম' এর পাশে 'দ' আছে, যা ইংরেজিভাষীদের জন্য কঠিন। আমাদের জিহ্বা এই নির্দিষ্ট ক্রমের ধ্বনি তৈরি করতে অভ্যস্ত নয়।'
প্রায়শই, "জোহরান" কে তীক্ষ্ণ "জোহর-অ্যান" (Zohr-ANNE) হিসেবে উচ্চারণ করা হয়। সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্কের গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের সহযোগী গবেষণা অধ্যাপক সুজান ভ্যান ডের ফিস্ট বলেন, এই ভুল উচ্চারণ ঘটে আমেরিকানাইজড ইংরেজিতে স্বরধ্বনি ভিন্নভাবে উচ্চারিত হওয়ার কারণে।
মামদানি জানান, একবার নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি ম্যানহাটনের একটি মসজিদে জুমার নামাজে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি উপস্থিত মুসল্লিদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন কিনা যে, কেউ তাদের নাম ধারাবাহিকভাবে ভুল উচ্চারণ করেছে। কক্ষের বেশিরভাগ মানুষই হাত তুলেছিলেন।
তিনি বলেন, 'অগণিত অভিবাসী এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। যখন কেউ কারো নাম নিয়ে উপহাস করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করে, তখন এর মানে হলো কেউ যেন বলতে চায় যে, এই ব্যক্তি এখানে থাকার যোগ্য না।'
মামদানি বলেন, তিনি তার নাম নিয়ে গর্বিত। তার মা তার প্রথম নামটি বেছে নিয়েছিলেন, যার অর্থ 'আকাশের প্রথম তারা'। তার বাবা তার মাঝের নাম 'কোয়ামে' বেছে নিয়েছিলেন ঘানার প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, সেই কোয়ামে নক্রুমার সম্মানে।
