খালি হাতেই হোয়াইট হাউস থেকে ফিরলেন জেলেনস্কি; শান্তি চুক্তির পরামর্শ ট্রাম্পের

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসের বৈঠককে ভলোদিমির জেলেনস্কি তার এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে 'পয়েন্টেড' বলে বর্ণনা করেন। তবে এই বৈঠকের আক্ষরিক বর্ণনা চুলচেরা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই। কারণ, এটা স্পষ্ট যে ইউক্রেন যা আশা করেছিল, বৈঠকটি তেমন হয়নি।
রাজনীতিতে 'এক সপ্তাহও অনেক দীর্ঘ সময়'—পুরোনো ব্রিটিশ প্রবাদটি যদি সত্য হয়, তাহলে জেলেনস্কি যেন এক নতুন রেকর্ড গড়লেন। একটি সংক্ষিপ্ত আটলান্টিক পাড়িই যেন এখন এক যুগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদলের মনোবল ছিল তুঙ্গে। ইউক্রেনের পার্লামেন্টের স্পিকার রুসলান স্টেফানচুকের কথায় কান পাতলে বোঝা যাবে, তিনি ছিলেন জেলেনস্কির প্রতি প্রচণ্ড অনুগত একজন রাজনীতিবিদ এবং দেশের কার্যত দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
রাষ্ট্রপতির বিমান উড্ডয়নের ঠিক আগে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্টেফানচুক এই সফরকে 'অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্ত' হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, এই বৈঠক বিশ্বের কাছে পরিষ্কার করে দেবে যে ট্রাম্প 'অবশেষে বুঝতে পেরেছেন পুতিন একজন মিথ্যাবাদী, তাকে বিশ্বাস করা যায় না এবং যুদ্ধ থামাতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি'।
তিনি আরও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ইউক্রেনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—ট্রাম্প আমেরিকান দূরপাল্লার টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে সম্মতি দেবেন কিনা—তার সমাধান প্রায় হয়ে গেছে।
কিন্তু জেলেনস্কির বিমান যখন আকাশে, তখনই ট্রাম্প-পুতিনের আড়াই ঘণ্টার ফোনালাপের খবর আসতে শুরু করে। এবং ওয়াশিংটনের রানওয়েতে বিমানের চাকা স্পর্শ করার আগেই ঘোষণা আসে যে, তাদের মধ্যে আরেকটি শীর্ষ সম্মেলন আসন্ন।
ইউক্রেনীয়রা বিমান থেকে নামলেন। তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল এক নিরুত্তাপ আমেরিকান অভ্যর্থনা। তবে তাদের সেই আশাবাদ যেন হারিয়ে যাওয়া মালপত্রের মতোই পথেই হারিয়ে যায়।
কয়েক সপ্তাহ আগেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর ধৈর্য হারাচ্ছিলেন বলে মনে হয়েছিল। সেসময় তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে পুতিন হয়তো তাকে ধোঁকা দিচ্ছেন, ইউক্রেনে তার লাগাতার হামলাকে তিনি 'পাগলামো' বলেছিলেন এবং পুতিনের ওপর 'খুবই ক্ষুব্ধ' হচ্ছিলেন।
কিন্তু শুক্রবারের বৈঠক নিশ্চিত করল যে ট্রাম্পের সেই হতাশা এখন আর নেই।
ট্রাম্প বলেন, 'আমার মনে হয়, পুতিন একটি চুক্তি করতে চান।' এরপর তিনি তার পুরোনো কিছু কথা আবার বলতে শুরু করেন, যেখানে এই সংঘাতকে মূলত দুই নেতার ব্যক্তিগত বিবাদ হিসেবে তুলে ধরা হয়। তিনি বলেন, 'তাদের মধ্যে অনেক তিক্ততা আছে।'
কঠিন অভিজ্ঞতা থেকে জেলেনস্কি শিখেছেন, হোয়াইট হাউসের ভেতরে ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ করাটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে, আবারও সেই চাপা উত্তেজনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ট্রাম্প, তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আর তার চেয়ারের পেছনে ভিড় করে ছিলেন 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' পন্থী গণমাধ্যমের প্রভাবশালী সদস্যরা।
যেমনটা আশা করা হয়েছিল, জেলেনস্কি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আয়োজক ট্রাম্পের শান্তিদূত হিসেবে দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ওয়াশিংটনে এখন তোষামোদই কূটনীতির মুদ্রা।
তবে জেলেনস্কি এটাও স্পষ্ট করে দেন যে রাশিয়া সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে, ট্রাম্পের এই আপাত বিশ্বাসে তিনি অংশীদার নন। তিনি বলেন, 'আমরা বুঝি যে পুতিন প্রস্তুত নন।'
তবে ফলাফল যেন আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। দিন শেষে ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেন, যুদ্ধকে কেবল বিদ্যমান যুদ্ধরেখা বরাবরই 'স্থির' করে দেওয়া উচিত এবং উভয় পক্ষেরই 'পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত'।
ইউক্রেন এবং তার মিত্রদের কাছে এই সংঘাত কোনো ব্যক্তিগত বিবাদ নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষায় ভোগা একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের দ্বারা একটি ইউরোপীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে চালানো আগ্রাসী যুদ্ধ। ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র চায় পুতিনকে সত্যিকারের আলোচনায় বসতে চাপ দেওয়ার জন্য।
একই সঙ্গে তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চায়, যাতে ভবিষ্যতে যেকোনো শান্তিচুক্তি মেনে চলতে তাকে বাধ্য করা যায়।
কিন্তু জেলেনস্কি এসবের কোনোটাই না পেয়েই হোয়াইট হাউস ছাড়েন।