ইউরোপের সীমান্তে বাধ্যতামূলক বায়োমেট্রিক সিস্টেম চালু; অ-ইইউ নাগরিকদের ওপর যেভাবে প্রভাব ফেলবে

১২ অক্টোবর থেকে ইউরোপ ভ্রমণে নতুন নিয়ম কার্যকর হয়েছে। শেনজেন অঞ্চলের ২৯টি দেশে ভ্রমণকারী সব অ-ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ব্রিটিশসহ) নাগরিকদের সীমান্তে ডিজিটাল এন্ট্রি অ্যান্ড এক্সিট সিস্টেম (ইইএস) বা বায়োমেট্রিক এর আওতায় নিবন্ধন করতে হবে।
এন্ট্রি/এক্সিট সিস্টেম (ইইএস) নামের এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ভ্রমণকারীদের সীমান্তে পাসপোর্ট স্ক্যান করে আঙুলের ছাপ ও ছবি দিতে হবে।
শেনজেন অঞ্চলে সাধারণত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ অন্তর্ভুক্ত, তবে আয়ারল্যান্ড ও সাইপ্রাস বাদ। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থাকা চারটি দেশ— আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ও লিচটেনস্টেইনও শেনজেন অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত।
ইইএস চালুর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সীমান্ত ব্যবস্থাপনা আধুনিক করতে চাইছে। এর লক্ষ্য অবৈধ অভিবাসন ঠেকানো, পরিচয় জালিয়াতি রোধ করা এবং ভিসা ছাড়া ভ্রমণকারীরা ১৮০ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯০ দিনের নিয়ম মানছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) স্বরাষ্ট্র এবং অভিবাসন বিষয়ক কমিশনার ম্যাগনাস ব্রুনার এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'এন্ট্রি/এক্সিট সিস্টেম আমাদের নতুন ইউরোপীয় অভিবাসন ও আশ্রয় নীতির (অ্যাসাইলাম) ডিজিটাল ভিত্তি।'
ছয় মাস সময়
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের নাগরিকদের প্রথমবার শেনজেন অঞ্চলে প্রবেশের সময় ব্যক্তিগত তথ্য নিবন্ধন করতে হবে। শেনজেন এলাকার অন্তর্ভুক্ত সব ইইউ দেশ (আয়ারল্যান্ড ও সাইপ্রাস ছাড়া) এবং আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ও লিচটেনস্টাইনও এই ব্যবস্থার আওতায় থাকবে। তবে পরবর্তী ভ্রমণে শুধু মুখের বায়োমেট্রিক যাচাই করলেই হবে।
এই নতুন ব্যবস্থা পুরোপুরি কার্যকর হবে ২০২৬ সালের ১০ এপ্রিল থেকে। তখন পাসপোর্টে সিল দেওয়ার পরিবর্তে থাকবে ইলেকট্রনিক রেকর্ড।
ব্রুনার বলেন, 'যে কোনো তৃতীয় দেশের নাগরিক যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের সীমান্তে প্রবেশ করবেন তখন তার পরিচয় যাচাই, নিরাপত্তা তল্লাশি ও তথ্য ইউরোপীয় ডাটাবেজে নিবন্ধন করা হবে।'
সার্বিয়া ও প্রতিবেশী ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশ ক্রোয়েশিয়ার মধ্যবর্তী বাজাকোভো সীমান্তে রোববার শত শত মানুষ, যাদের অধিকাংশই সার্বিয়ান, গাড়িতে করে প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করেন। এরপর সীমান্ত বুথে গিয়ে আঙুলের ছাপ ও চেহারা স্ক্যানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন তারা।
সার্বিয়ার দালিবর ভ্রানিচ বলেন, 'পাঁচটি লেন খোলা ছিল। লাইনে আমাদের প্রায় ২০ মিনিট লেগেছে, আর বুথে প্রত্যেকজনের প্রায় দুই মিনিট করে সময় লেগেছে।'
ব্রিটিশ যাত্রীরা যারা ডোভার বন্দর, ফোকস্টোনের ইউরোটানেল টার্মিনাল বা লন্ডনের সেন্ট প্যানক্রাস ইন্টারন্যাশনাল স্টেশনের ইউরোস্টার টার্মিনাল ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি যুক্তরাজ্য ছাড়ার আগেই সীমান্তে সম্পন্ন হচ্ছে।
ডোভার ও ইউরোটানেল টার্মিনালে রোববার থেকে শুধু পণ্যবাহী ট্রাক ও কোচের ক্ষেত্রে ইইএস পরীক্ষা শুরু হয়েছে। যাত্রীবাহী গাড়ির পরীক্ষা নভেম্বর থেকে ডোভারে চালু হবে, আর বছরের শেষ নাগাদ ইউরোটানেলেও কার্যকর হবে। সেন্ট প্যানক্রাসের ইউরোস্টারে রোববার থেকে ধীরে ধীরে কিছু ব্যবসায়িক যাত্রীর জন্য নতুন প্রক্রিয়াটি চালু করা হয়েছে।
ব্রিটেনের সীমান্ত নিরাপত্তা ও আশ্রয়বিষয়ক মন্ত্রী অ্যালেক্স নরিস বলেন, 'যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের লক্ষ্য এক— সীমান্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এই আধুনিকায়ন ব্যবস্থা আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা দেবে এবং অবৈধ অভিবাসন রোধে সাহায্য করবে।'
যা ঘটবে
যে কেউ প্রথমবারের মতো শেনজেন এলাকায় প্রবেশ করলে তাকে সীমান্তে পাসপোর্ট স্ক্যান করতে হবে, আঙুলের ছাপ দিতে হবে এবং চেহারার ছবি তুলতে হবে।
দেশ ছাড়ার সময় ভ্রমণকারীর তথ্য ইইএস ডাটাবেসে যাচাই করা হবে— তিনি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে অবস্থান করেছেন কি না, সেটি নিশ্চিত করতে এবং প্রস্থানের রেকর্ড রাখার জন্য।
এরপরের যাত্রাগুলোর ক্ষেত্রে শুধু মুখের বায়োমেট্রিক যাচাই করলেই হবে।
১২ বছরের কম বয়সী শিশুদেরও ইইএস-এ নিবন্ধন করতে হবে, তবে শুধু তাদের ছবি তোলা হবে। ইইএস ব্যবস্থার জন্য কোনো ফি দিতে হবে না।
কোথায় হবে এই পরীক্ষা?
শেনজেন এলাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, রেল টার্মিনাল ও স্থলসীমান্তে প্রবেশের সময় এই পরীক্ষা হবে।
তবে যুক্তরাজ্যের ডোভার বন্দর, ফোকস্টোনের ইউরোটানেল টার্মিনাল এবং লন্ডনের সেন্ট প্যানক্রাসে অবস্থিত ইউরোস্টার টার্মিনালে যাত্রীরা যুক্তরাজ্য ছাড়ার সময় ইইএস নিবন্ধন সম্পন্ন করবেন। এটি তত্ত্বাবধান করবেন ফরাসি সীমান্ত কর্মকর্তারা। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আবার নিবন্ধনের প্রয়োজন হবে না— শুধু ফেরার সময় করতে হবে।
ইইএস চালু হলে কি সীমান্তে দেরি হবে?
ইইএস ধীরে ধীরে চালু করা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আশা করছে, এতে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটবে না।
যদি প্রক্রিয়া খুব বেশি সময় নেয়, তাহলে সীমান্ত কর্মকর্তারা অল্প সময়ের জন্য পরীক্ষা স্থগিত করতে পারবেন।
ডোভার বন্দর ও ফোকস্টোনের ইউরোটানেল টার্মিনালে ১২ অক্টোবর থেকে শুধু পণ্যবাহী ট্রাক ও কোচে ইইএস পরীক্ষা শুরু হয়েছে। যাত্রীবাহী গাড়ির পরীক্ষা নভেম্বর থেকে ডোভারে এবং বছরের শেষে ইউরোটানেলে চালু হবে। ইউরোস্টারও ধীরে ধীরে নতুন ব্যবস্থা চালু করছে।
ব্রিটিশ সরকার ভ্রমণকারীদের পরামর্শ দিয়েছে, যাত্রার জন্য কিছুটা অতিরিক্ত সময় হাতে রাখতে। যুক্তরাজ্যের রোড হাউলেজ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ব্যস্ত সময়ে অপেক্ষার সময় কিছুটা বাড়তে পারে।
সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে ২০২৬ সালের ইস্টার ছুটিতে ও পরের গ্রীষ্মে, যখন অনেক পরিবার প্রথমবারের মতো ইইএস চালুর পর ইউরোপ ভ্রমণ করবে।
আরও পরিবর্তন আসছে ২০২৬ সালে
ইইএস-এর পর ২০২৬ সালের শেষ দিকে চালু হবে আরেকটি নতুন ব্যবস্থা—ইউরোপীয় ট্রাভেল ইনফরমেশন অ্যান্ড অথরাইজেশন সিস্টেম (ইটিয়াস)।
শেনজেন এলাকার বাইরের নাগরিকদের তখন ভ্রমণের আগে ইটিয়াস অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে হবে। এতে ব্যক্তিগত তথ্য, ভ্রমণের বিস্তারিত এবং ২০ ইউরো ফি দিতে হবে।
এই অনুমোদন তিন বছরের জন্য বৈধ থাকবে, বা পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত—যেটি আগে হবে।