গাজা গণহত্যা: আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনির বিরুদ্ধে সম্পৃক্ততার অভিযোগ

ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি জানিয়েছেন, গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের পক্ষে রোমের সমর্থনের কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) দায়ের করা একটি অভিযোগে তাকে 'গণহত্যায় সহযোগিতার" অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মেলোনি এই মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল আরএআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। আন্তর্জাতিক আদালত থেকে এ বিষ্যে এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চয়তা না আসায় এই পরিস্থিতি নিয়ে এটিই তার প্রথম জনসমক্ষে মন্তব্য।
মেলোনি বলেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী গিদো ক্রোসেতো এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানিকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্ত বলতে তিনি এমন একটি পরিস্থিতি বোঝান, যখন আদালতকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্ভাব্য কোনো অপরাধ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়। অভিযোগটি ঠিক কী ছিল, সে সম্পর্কে মেলোনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।
১ অক্টোবর দায়ের করা অভিযোগে প্রায় ৫০ জন স্বাক্ষর করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আইনের অধ্যাপক, উকিল এবং কয়েকজন জনসাধারণের পরিচিত ব্যক্তি। এ অভিযোগে মেলোনি এবং অন্যদের বিরুদ্ধে ইরায়েলের কাছে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা এএফপি।
ইতালির নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা আদালতের মামলার লেখকরা লিখেছেন, 'ইসরায়েলি সরকারকে সমর্থন, বিশেষ করে প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে, ইতালির সরকার চলমান গণহত্যা এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অত্যন্ত গুরুতর যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগী হয়েছে।'
এএফপি আরও জানিয়েছে, মেলোনির নাম উল্লেখ করে অভিযোগের পিছনে থাকা ফিলিস্তিনি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ আদালতকে মেলোনির বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করার সম্ভাবনা মূল্যায়ন করার আহ্বান জানিয়েছে।
গত মাসে জাতিসংঘের স্বাধীন অনুসন্ধানী দলের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ গণহত্যার সমতুল্য; যার সাথে মানবাধিকার, গণহত্যা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের পূর্বের মতামতের মিল রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইতোমধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে খাদ্য সরবরাহে বাধা, হত্যা এবং নিপীড়ন।
তবে, নেতানিয়াহু বা গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়নি।
আইসিসি হামাস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। কিন্তু এরপর তারা ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন।
টেলিভিশনে মেলোনি বলেন, 'আমি মনে করি, এমন ধরনের অভিযোগের আর কোনো উদাহরণ নেই বিশ্বে বা ইতিহাসে।'
ইতালি থেকে ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি
স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইসরায়েলের কাছে 'প্রধান সামরিক অস্ত্র' রপ্তানি করেছে মাত্র তিনটি দেশ, যার মধ্যে একটি ছিল ইতালি। যদিও বড় ধরনের অস্ত্র, যেমন বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাংক ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রায় ৯৯ শতাংশই রপ্তানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি।
এসআইপিআরআই জানিয়েছে, এই সময়ে ইতালি ইসরায়েলের জন্য 'লাইট' (হালকা) হেলিকপ্টার ও নৌযানে ব্যবহৃত গুলি সরবরাহ করেছে। এছাড়া, এটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন প্রোগ্রামের আওতায় এফ-৩৫ ফাইটার জেটের কিছু অংশ উৎপাদনেও জড়িত। এসআইপিআরআই-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ইসরায়েল এফ-৩৫ ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন করতে পারে এমন আশঙ্কার কারণে বিমান বা এর অংশ ইসরায়েলের কাছে রপ্তানি নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে।'
ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গিদো ক্রোসেতো বলেছেন, ইতালি কেবল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করছে। এসব অস্ত্র গাজার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না, সে ব্যাপারে ইতালি নিশ্চিততা চেয়েছে। এর আগে উপ-প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি দাবি করেছিলেন, ইতালি অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করেছে।
এই অভিযোগের মধ্যে মেলোনির স্বীকারোক্তি এসেছে সেই সময়, যখন সাম্প্রতিক সপ্তাহে ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধে সহিংসতার প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ দেশটির রাস্তায় নেমেছেন।
ইতালির প্রধান শ্রম ইউনিয়নগুলো এই বিক্ষোভে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। দেশটির বন্দরের শ্রমিকরা হুমকি দিয়েছেন, তারা ধর্মীয় ও মানবিক সহায়তা সরবরাহকারী সামুদ্রিক নৌবহরকে ইসরায়েল আটকালে ধর্মঘট করবে।
আগের বিক্ষোভের পর, মেলোনির সরকার আন্তর্জাতিক নৌবহরের সঙ্গে ইতালির নৌবাহিনী পাঠায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি বাহিনী নৌবহর আটক করার আগে ইতালির নৌবাহিনী ফিরে আসে। এই ঘটনায় প্রায় ৫০০ আন্তর্জাতিক কর্মীকে আটক করা হয়।
ফ্লোটিলার আয়োজকদের মতে, মঙ্গলবার পর্যন্ত ছয় ক্রু সদস্য ইসরায়েলি কারাগারে রয়েছেন।