একাল ও সেকালের তুর্কি হামাম: শুধু গোসল নয়, এ এক অন্য জগৎ
হামামের উষ্ণ আলিঙ্গনে শরীরটা যেন গুটিয়ে থাকে, বাইরের সব শব্দ আবছা হয়ে আসে। মাথার ওপরের বিশাল গম্বুজের ছোট ছোট ছিদ্র, যাকে 'ওকুলি' বা 'চোখ' বলা হয়, সেখান থেকে নরম আলো এসে নিচের মার্বেলের ওপর আলোর নকশা এঁকে দেয়। পানির কুলকুল শব্দ আর টুপটাপ আওয়াজ ঘুমের দেশের আবছা সুরের মতো চেতনার কিনারে এসে ধাক্কা দেয়। তুর্কি গোসলখানা বা হামামের এই বাষ্পমাখা, প্রায় রহস্যময় পরিবেশে সময় যেন থমকে দাঁড়ায়।
হামামে যাওয়াটা বাড়ির বাথরুমে গোসল করার মতো নয়, এমনকি কোনো স্পা-এ থেরাপিস্টের সঙ্গে একা থাকার মতোও নয়।
তুর্কি হামামের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ আহমেত ইগদিরলিগিল বলেন, 'গোসলের সময় বা শাওয়ারের নিচে মানুষ একা থাকে, কিন্তু হামাম হলো একটি সামাজিক জায়গা।' তিনি আরও বলেন, 'ঐতিহাসিকভাবে, বিশেষ করে নারীদের জন্য, এটি ছিল বাড়ির বাইরে কোনো রকম অনুমতি ছাড়াই মেলামেশা করার এক অন্যতম জায়গা।'
অতীতে, ধনী পরিবারের নারীরা নিয়মিত হামামে যেতেন। কারও কারও তো বাড়িতেই ব্যক্তিগত হামাম থাকত। প্রত্যেক নারী নিজের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ব্যবহার করতেন, যেমন— 'হামাম তাসি' (গায়ে পানি ঢালার জন্য বিশেষ নকশা করা বাটি, যাতে কখনও কখনও মণিমুক্তোও বসানো থাকত)। এছাড়াও তারা সিল্ক বা লিনেন দিয়ে কাজ করা সাটিনের কাপড় এবং 'পেশতেমাল' বা তোয়ালে ব্যবহার করতেন।
পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নানা ধরনের নিয়মকানুন তৈরি হয়েছে। ইগদিরলিগিল বলেন, 'নামাজ থেকে শুরু করে বিয়ে বা সন্তানের জন্ম—প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব দেওয়া হতো।' আজও ছোট শহরের নারীরা তাদের গৃহিণীর ভূমিকা থেকে মুক্তি পেতে বা ছেলেদের জন্য পাত্রী খুঁজতে হামামে যান।
বাষ্প আর 'তারার জগৎ'
ইগদিরলিগিল ব্যাখ্যা করেন যে প্রত্যেক হামামে অন্তত তিনটি অংশ থাকে, যা স্নানের অভিজ্ঞতাকে আরও গভীর করে তোলে। প্রথমটি হলো প্রবেশদ্বার, যেখানে কাপড় বদলানোর ঘর এবং স্নানের পর বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা থাকে। একটি ছোট দরজা দিয়ে আধা-উষ্ণ একটি ঘরে প্রবেশ করতে হয়, যেখানে শৌচালয় এবং মার্বেলের বেসিন বা 'কুর্না' থাকে। প্রধান এবং সবচেয়ে বড় অংশটির মাঝখানে থাকে 'গোবেক তাশি' নামে একটি উঁচু মার্বেলের বেদি, আর দেওয়াল বরাবর আরও কুর্না। কিছু হামামে 'হালভেট' নামে ছোট ছোট বেশ গরম ঘরও থাকে।
ইগদিরলিগিল বলেন, 'এই গঠনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা অনেকটা হামামের গভীরে গিয়ে আবার ফিরে আসার এক সফরের মতো।' তিনি আরও বলেন, 'ভেতরের ঘর দুটির ওপরে সবসময় একটি গম্বুজ থাকে। গম্বুজের এই ছিদ্রগুলো রাতের আকাশের তারার মতো মনে হয়, যেন গোটা ব্রহ্মাণ্ডের দিকে তাকিয়ে আছি।'
এই অনুভূতিটা বিশেষভাবে পাওয়া যায় ১৭৪১ সালে নির্মিত জাগালোলু হামামে। এর ধবধবে সাদা মার্বেলের অন্দরসজ্জা দেখলে মনে হয় যেন মেঘের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছেন। ইগদিরলিগিলের ভাষায়, 'ভেতরের তাপ, আর্দ্রতা আর হৃদস্পন্দনের মতো মৃদু গুঞ্জন—সব মিলিয়ে মনে হয় যেন মায়ের গর্ভে ফিরে গেছেন।'
কীভাবে কাজ করে এই হামাম?
জেইরেক চিনিলি হামামের গেস্ট রিলেশনস ম্যানেজার এলিফ কার্তাল প্রায় ২০ বছর ধরে তুর্কি হামামে কাজ করছেন। তিনি বলেন, বেশিরভাগ হামামেই একই ধরনের পরিষেবা দেওয়া হয়, যেমন— 'কেসে' (বিশেষ এক ধরনের দস্তানা দিয়ে শরীর ঘষে পরিষ্কার করা) এবং 'কোপুক মাসাজ' (তুর্কি ফেনা মাসাজ)।
ইস্তানবুলের ২৩৭টি হামামের মধ্যে এখন মাত্র ৬০টি চালু আছে। ছোট হামামগুলোতে সাধারণত পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা দিনে বা আলাদা সময়ে স্নানের ব্যবস্থা থাকে। তবে জেইরেক চিনিলি হামামের মতো বড় ও ঐতিহাসিক হামামগুলোতে পুরুষ ও নারীদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা বিভাগ রয়েছে।
হামামে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখা ভালো। অভিজ্ঞ 'নাতির' (নারী পরিচর্যাকারিণী) এলিফ তামতারতার বলেন, 'হামামে আসার ঠিক আগে ওয়াক্সিং করবেন না এবং আগের দিন শরীরে কোনো তেল বা লোশন লাগাবেন না, কারণ এতে কেসে দস্তানাটি ত্বকের ওপর পিছলে যায় এবং ঠিকমতো কাজ করে না।' তিনি হালকা খাবার খেয়ে আসার এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন, কারণ গরমের মধ্যে অস্বস্তি হতে পারে।
সব হামামেই জামাকাপড় ও মূল্যবান জিনিসপত্র রাখার জন্য লকারের ব্যবস্থা থাকে। সেখানে অতিথিদের জন্য অন্তর্বাস দেওয়া হয়, তবে চাইলে কেউ নিজের সাঁতারের পোশাকও পরতে পারেন।
এক নতুন সতেজ অনুভূতি
অন্য কারো হাতে স্নান করার অনুভূতিটাই যেন এক পরম বিলাসিতা। এটি অনেককে ছোটবেলার স্নানের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়, যখন উষ্ণতা আর আদরে শরীরটা কেমন ঘুমে ঢুলে পড়ত।
পোশাক বদলে পেশতেমাল জড়িয়ে নেওয়ার পর অতিথির জন্য অপেক্ষা করেন তার 'নাতির' (নারীদের জন্য নারী পরিচর্যাকারী) বা 'তেল্লাক' (পুরুষদের জন্য পুরুষ পরিচর্যাকারী)। তিনি অতিথিকে হাত ধরে যত্ন করে হামামের একেবারে কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানে অতিথিকে প্রথমে উষ্ণ পানিে স্নান করিয়ে গোবেক তাশির ওপর শুইয়ে দেওয়া হয়। উত্তপ্ত মার্বেলের ওম আর বাষ্পমাখা মনোরম বাতাস স্নানার্থীকে এতটাই আরাম দেয় যে, ১৫ মিনিট পর হয়তো তাকে ডেকে তুলতে হতে পারে।
এরপর পরিচর্যাকারিণী একটি ছোট বাটি দিয়ে সারা শরীরে পানি ঢেলে ঘাম ধুইয়ে দেন। তারপর শুরু হয় 'কেসে'। এটি এক ধরনের খসখসে কাপড়ের দস্তানা, যা দিয়ে শরীর ঘষলে মরা চামড়া উঠে আসে। পরিচর্যাকারিণী যখন শরীর ঘষেন, তখন দেখা যায় শরীর থেকে সরু কালো সুতোর মতো ময়লা উঠে আসছে। এরপর লুফা দিয়ে সেই মরা কোষ পরিষ্কার করা হয়।
শরীর ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেলে শুরু হয় তুর্কি 'কোপুক মাসাজ'। পরিচর্যাকারিণী একটি নরম ভেজা কাপড়ে সাবান দিয়ে বিশাল ফেনা তৈরি করেন এবং সেই ফেনা সারা শরীরে আলতো করে বুলিয়ে মাসাজ শুরু করেন। বেশিরভাগ তুর্কি সাবান অলিভ অয়েল দিয়ে তৈরি, যা ত্বকের স্বাভাবিক তেল নষ্ট না করেই পরিষ্কার করে। কেসে এবং এই মাসাজের পর ত্বক হয়ে ওঠে কাশ্মীরি পশমের মতো নরম আর মসৃণ।
সব শেষে চুল ধুয়ে অতিথিকে আবার সেভাবেই ফিরিয়ে আনা হয়, যেভাবে তিনি ভেতরে গিয়েছিলেন। তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছিয়ে দেওয়ার পর তাকে শীতল ঘরে আরাম করতে দেওয়া হয়। হামাম থেকে হুট করে বেরিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। সেখানে আরাম করে বসে, চা পান করে শরীর-মন শান্ত হওয়ার পর পোশাক বদলানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
বাষ্পমাখা পানির এই আরামদায়ক অনুভূতি এক চিরন্তন আনন্দ। কিন্তু হামামে যাওয়া মানে শুধু পরিষ্কার হওয়া নয়।
তামতারতার বলেন, 'অতিথিরা এখানে এসে তাদের সব দুঃখ, কষ্ট ভুলে যান। আমরা মায়ের মমতায় তাদের সেবা করি। আমাদের কাছে তারা সন্তানের মতো। এখানে পানি, হামাম আর মানুষের শক্তি মিলেমিশে এক হয়ে যায়। আর যখন আপনার শক্তি আর অতিথির শক্তি এক হয়ে যায়, তখন সময় পানির স্রোতের মতো বয়ে যায়—আর এই পানিই হলো আরোগ্যের মূল উৎস।'
