বিশ্বের বিস্ময়খ্যাত ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের এখনকার গল্প সম্পূর্ণই ভিন্ন
একসময় ইরাকের ব্যাবিলন শহর ছিল মেসোপটেমিয়া সভ্যতার এক উজ্জ্বল রত্ন। এখান থেকেই ইতিহাসে পরিচিত হয়েছে তিন যুগ- প্রাচীন, মধ্য ও নব্য ব্যাবিলীয় সময়কাল। এখানেই শাসন করেছিলেন নেবুচাদনেজার দ্বিতীয়, গড়ে তুলেছিলেন বিশাল মন্দির ও প্রাসাদ। বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি, ঝুলন্ত উদ্যানও ছিল এই শহরেই। বর্তমানে ব্যাবিলন ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হলেও, আজ এটি দাঁড়িয়ে আছে গৌরবময় অতীত আর ক্ষয়ের মাঝামাঝি এক অবস্থানে।
ব্যাবিলনের পথে হাঁটলে মনে হয় যেন মিথ আর স্মৃতির ভেতর প্রবেশ করা। এখানে দর্শনার্থীদের প্রথম চোখে পড়ে পুনর্নির্মিত ইশতার গেট। গভীর নীল রঙের এই প্রবেশপথ একসময় সোনালি রিলিফে সজ্জিত ছিল। এর পরই চওড়া একটি সড়ক, যেখানে একসময় অনুষ্ঠিত হতো রাজকীয় উৎসব।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০৫ থেকে ৫৬২ অব্দ পর্যন্ত নেবুচাদনেজার দ্বিতীয় শাসনামলে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য প্রাসাদ ও মন্দির, মোটাদাগে যেগুলোর লক্ষ্য ছিল শহরের প্রতিরক্ষা জোরদার করা। এখানে আছে বিশাল এটেরমেনানকি জিগুরাত (পিরামিডাকার মন্দির-টাওয়ার) যেটিকে অনেকে বাইবেলের টাওয়ার অব ব্যাবেলের অনুপ্রেরণা বলে মনে করেন। একসময় এটি দিগন্তজোড়া নাম করেছিল।
আর আছে কিংবদন্তিতুল্য ঝুলন্ত উদ্যান। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান লেখকদের বর্ণনায় যেটি ছিল সবুজ টেরেসের স্বর্গরাজ্য। কথিত আছে, নেবুচাদনেজার তার স্ত্রীর জন্যই এই উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন।
দীর্ঘ সংঘাত ও অস্থিরতার পরও ব্যাবিলন এখনো বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। যদিও অতীতের তুলনায় সংখ্যা কম, তবে তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ব্যাবিলনের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মোট ৪৯ হাজার ৬২৯ জন দর্শনার্থী এখানে এসেছিলেন, যাদের মধ্যে ৫ হাজার ৩৭০ জন বিদেশি।
তবে বাস্তবে ব্যাবিলন আজ এক জীর্ণ নগরী। ধ্বংসাবশেষ ঘিরে মূল সড়ক মোটামুটি ভালো থাকলেও, সেখানে পৌঁছানোর পথ ভাঙাচোরা আর খানাখন্দে ভরা। ঐতিহাসিক স্থানের ভেতরের পথঘাট আগাছায় ঢাকা। ফাটলের ভেতর অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছপালা, প্রাসাদের ভেতর ছড়িয়ে থাকা সিগারেটের টুকরো ও প্লাস্টিকের বোতল অবহেলার স্পষ্ট প্রমাণ।
পর্যটন সুবিধার ঘাটতিও চোখে পড়ে। ইশতার গেটের টিকিট কাউন্টারের পাশে শৌচাগার থাকলেও আশপাশে নেই কোনো হোটেল। ফলে দর্শনার্থীদের দূরে গিয়ে থাকতে হয়। ভ্রমণ গাইডের অভাবও বড় সমস্যা। ফলে অনেকে সহজেই প্রাচীন দেয়াল আর কক্ষের ভেতর পথ হারিয়ে ফেলেন।
তবুও স্থানীয় গাইডরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন অতিথিদের হতাশ না করতে। তারা পরিচ্ছন্ন পথ বেছে নেন এবং ধ্বংসাবশেষকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করেন। কিন্তু যারা নিজের মতো করে ঘোরেন, তাদের কাছে অবহেলার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ব্যাবিলনের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রাঈদ হামেদ আবদুল্লাহ এ সমস্যাকে স্বীকার করে বলেন, 'সমগ্র প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে মাত্র চারজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছে। কখনো কখনো আমি নিজে, এমনকি নিরাপত্তাকর্মীদেরও পরিস্কারে সাহায্য করতে বলি। এগুলো আমাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, শহরের প্রতি ভালোবাসা থেকেই করি। আমরা আশা করি ইরাকি সরকার ব্যাবিলনের যত্নে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করবে।'
ব্যাবিলনের ক্ষয়চিহ্ন শুধু সময়ের ফল নয়। ইতিহাসে বিভিন্ন শাসক ও সেনাবাহিনী একে বারবার নতুনভাবে আকার দিয়েছে।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আক্রমণের পর এখানে একটি সেনাঘাঁটি গড়ে ওঠে। সাদ্দামের প্রাসাদকে রূপান্তরিত করা হয় সদর দফতরে। সেখানে নামে হেলিকপ্টার, চলে ট্যাঙ্ক, সৈন্যরা দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকে। একসময়কার জৌলুশ ও ক্ষমতার প্রতীক ব্যাবিলন এভাবেই আধুনিক সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ব্যাবিলন অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছিল ইরাকের এক ঐতিহাসিক জয়। এটি ছিল বহু দশকের প্রচেষ্টার ফল। কিন্তু স্বীকৃতি পেলেও সংরক্ষণের নিশ্চয়তা আসেনি। বরাদ্দ কম, উন্নয়ন পরিকল্পনা থেমে আছে। স্থানটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ভালোবাসা ও নিষ্ঠার ওপর।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ফান্ড ব্যাবিলনের কিছু অংশে সংরক্ষণ কার্যক্রম চালাচ্ছে।
স্থানীয় ট্যুর গাইড হাসেম একদিকে ঐতিহাসিক স্থানটি নিয়ে গর্ব করেন, অন্যদিকে বিনিয়োগের অভাব নিয়েও তার চিন্তার শেষ নেই। তিনি বলেন, 'স্থানটির জন্য আরও সরকারি সহায়তা ও জনসচেতনতা দরকার।' পাশাপাশি তিনি দর্শনার্থীদের আহ্বান জানান যেন তারা আবর্জনা না ফেলেন এবং প্রাচীন পাথরে নাম খোদাই না করেন।
ব্যাবিলনে ঘোরাফেরা মানেই মিশ্র অভিজ্ঞতা। সাউদার্ন প্যালেসে পাশাপাশি দেখা যায় নেবুচাদনেজারের শিলালিপি ও সাদ্দাম হোসেনের খোদাই করা নাম। প্রসিদ্ধ ব্যাবিলীয় সিংহ এখনো দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে, যদিও আগাছা তাকে জাপটে ধরেছে। এর বাইরে রয়েছে বাগান, পিকনিক স্পট, বসতবাড়ি ও এমনকি পুলিশ স্টেশনও।
সবকিছুর পরও ব্যাবিলন এখনো তার মায়া ধরে রেখেছে। দর্শনার্থীরা আজও ইশতার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হন, ঝুলন্ত উদ্যান নিয়ে বিতর্কে জড়ান, আর মরুভূমির বুকে এমন স্বর্গ আদৌ ছিল কি না ভেবে বিস্মিত হন। গবেষকেরা এই নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, আর পর্যটকেরা ফিরে গিয়ে নেবুচাদনেজারের রাজধানীর পথে হাঁটার অভিজ্ঞতা পরিবার-বন্ধুদের শেনাচ্ছেন।
