চীন ও রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে পশ্চিমা বিশ্ব কেন হিমশিম খাচ্ছে?

গত কয়েকমাস ধরে বিশ্বজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। একদিকে যেমন রাশিয়ার ড্রোন পোল্যান্ডের আকাশসীমায় ঢুকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকে পরীক্ষা করছে, তেমনি অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের আগ্রাসী তৎপরতা পশ্চিমা দেশগুলোর সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের প্রতিরোধ কৌশলগুলো কি বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে কার্যকর? বিসশ্লেষকদের কী মত?
পোল্যান্ডে রাশিয়ার ড্রোন ও ন্যাটোর সক্ষমতা
গত ৯-১০ সেপ্টেম্বরের রাতে রাশিয়া যখন প্রায় দুই ডজন ড্রোন পোল্যান্ডের আকাশসীমায় পাঠায়, তখন ন্যাটো জোট দেখিয়ে দেয় তারা কতখানি প্রস্তুত। জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ডের যৌথ বাহিনী যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং একটি অত্যাধুনিক নজরদারি বিমান দ্রুত মোতায়েন করে খুব সফলভাবে সেগুলোকে ভূপাতিত করার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।
ন্যাটোর ইতিহাসে এটি ছিল জোটভুক্ত কোনো দেশে সবচেয়ে বড় আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা। ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি পেলেও, রাশিয়া এমন 'পরীক্ষা' করার সাহস কীভাবে দেখালো, তা নিয়ে কিন্তু তাদের উদ্বেগও কম নয়।
একদিকে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের প্রতিপক্ষকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, আর এদিকে উস্কানিমূলক কার্যকলাপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বহু ইউরোপীয় নেতার কড়া সমালোচনার মাঝেও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ধারণা করেছিলেন যে রাশিয়ার ড্রোনগুলো হয়তো 'ভুলবশত' পোল্যান্ডে ঢুকে পড়েছিল। তবে কয়েক দিনের মধ্যে আবারও একটি রাশিয়ান ড্রোন রোমানিয়ার আকাশসীমায় প্রবেশ করে। রোমানিয়ার যুদ্ধবিমান সেটিকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে ইউক্রেনের আকাশসীমা পর্যন্ত নিয়ে যায়।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসন
পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, দক্ষিণ চীন সাগরের এক তীব্র বিতর্কিত প্রবাল প্রাচীরের উপর গত কয়েক সপ্তাহে চীন তার নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করেছে। বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা এই মাসে স্কারবোরো শোয়ালে একটি জাতীয় সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছেন।
এটি এমন একটি জনবসতিহীন ছোট দ্বীপ যার কৌশলগত গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, ২০১৬ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার চীনা প্রতিপক্ষ শি জিনপিংকে স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, সেখানে চীনের কোনো ভূমি দখল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি করবে।
সম্প্রতি ১৬ সেপ্টেম্বর চীনা টহল জাহাজগুলো ওই প্রবাল প্রাচীরের চারপাশে জড়ো হয়ে জলকামান নিক্ষেপ করে এবং এতে ফিলিপাইনের (যারা আমেরিকার চুক্তিবদ্ধ মিত্র) একজন উপকূলরক্ষী সদস্য আহত হন।
স্নায়ুযুদ্ধ বনাম বর্তমান পরিস্থিতি
ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের বিশেষজ্ঞ ক্রিস ক্রেমিডাস-কোর্টনি, যিনি একসময় জার্মানিতে সোভিয়েত অনুপ্রবেশকারীদের উপর নজর রাখা মার্কিন সেনাবাহিনীর ইউনিটে কাজ করেছিলেন, তিনি বর্তমান পরিস্থিতিকে স্নায়ুযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তার মতে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় যদি ১৯টি সোভিয়েত বিমান ন্যাটোর আকাশসীমায় প্রবেশ করত, তাহলে 'বিরাট এক প্রতিক্রিয়া' দেখা যেত। অনুপ্রবেশকারীদের ভূপাতিত করা হতো এবং পশ্চিমা দেশগুলো বিশাল সামরিক শক্তি প্রদর্শন করত।
কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তার মতে, রাশিয়া এখন বাজি ধরেছে যে পশ্চিমা দেশগুলোর 'ধারালো তরবারি আছে, কিন্তু হাত কাঁপছে', অর্থাৎ সক্ষমতা থাকলেও সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা দেখা যাচ্ছে।
পোল্যান্ডের সাম্প্রতিক ন্যাটো প্রতিরক্ষা সফল হলেও এটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। মাত্র ২০ হাজার ডলার মূল্যের ড্রোন ধ্বংস করতে ব্যবহার করা হয়েছে লাখ ডলার মূল্যের ক্ষেপণাস্ত্র।
ক্রেমিডাস-কোর্টনির মতে, ভ্লাদিমির পুতিনকে দমাতে ইউরোপকে হয়তো আরও ঝুঁকি নিতে হবে। যেমন, তেল পাচারকারী রুশ জাহাজ জব্দ করা কিংবা ইউক্রেনকে আরও সাহসী প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাহায্য করা।
অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক সাহসও সমান জরুরি হয়ে উঠেছে।
এদিকে, ন্যাটোর রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল ধরেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিত্রদের প্রতি হুমকি-ধামকি এবং সম্মিলিত প্রতিরক্ষায় আমেরিকার অঙ্গীকার নিয়ে তার প্রকাশ্য প্রশ্ন তোলার কারণে। অন্যদিকে, জোরালো কোনো পদক্ষেপে পশ্চিমা দেশগুলোর একমত হওয়ার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে রাশিয়ার অস্পষ্ট ও অস্বীকারযোগ্য হামলার কৌশল।
এ ধরনের হামলার মধ্যে থাকতে পারে ড্রোন হামলা, সাইবার আক্রমণ অথবা 'গ্রে-জোন' (ধূসর এলাকা) অভিযান। এই অভিযানগুলোর মধ্যে নাশকতা থেকে শুরু করে গুপ্তহত্যা এবং সাবমেরিন ইন্টারনেট কেবল ইচ্ছাকৃতভাবে কেটে দেওয়ার মতো ঘটনাও থাকতে পারে। ক্রেমিডাস-কোর্টনির মতে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় 'আমাদের একটি দাবা খেলার বোর্ড ছিল এবং আমরা জানতাম কোন ঘুঁটি কোথায় আছে। কিন্তু এখন কোনো বোর্ড নেই, কোনো নিয়মও নেই।'
সোভিয়েতদের প্রতিরোধ করার সক্ষমতা বাড়াতে আমেরিকা ও তার মিত্ররা কয়েক দশক ধরে কাজ করেছে। 'শাস্তির মাধ্যমে প্রতিরোধ' কৌশলের লক্ষ্য ছিল প্রতিপক্ষকে অসহনীয় ক্ষতির হুমকি দিয়ে বিরত রাখা, যার মধ্যে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের হুমকিও ছিল। অন্যদিকে, 'প্রতিহত করার মাধ্যমে প্রতিরোধ' কৌশলের লক্ষ্য ছিল সামরিক শক্তি দিয়ে আক্রমণকারীদের ঠেকিয়ে দেওয়া।
তবে কিছু নেতাকে বোঝানো ছিল বেশ কঠিন। ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল প্রশ্ন করেছিলেন, আমেরিকা কি 'নিউ ইয়র্কের বিনিময়ে প্যারিস'কে ছাড় দেবে? অর্থাৎ, সোভিয়েত হামলায় ফ্রান্সের প্রতিশোধ নিতে আমেরিকা কি পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করবে?
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়ানা স্কাইলার মাস্ট্রো বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বর্তমানে দ্বিমেরু প্রতিযোগিতা এমন এক জটিল ও নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে, যা পরিচালনা করা অনেক কঠিন। মহাকাশে কিংবা সাইবার হামলার মাধ্যমে চীনের আমেরিকান জাতীয় নিরাপত্তা দুর্বল করার চেষ্টার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। তবে তার মতে, এই ধরনের আগ্রাসন প্রায়শই প্রতিরোধ করা কঠিন।
'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি কি আমেরিকাকে একঘরে করে দেবে?
এদিকে, মিত্র দেশগুলো আমেরিকার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে ক্রমশ সন্দিহান হয়ে উঠছে। জ্যাকুব গ্রিগেল ও এ. ওয়েস মিচেলের ২০১৭ সালে প্রকাশিত বই 'দ্য আনকোয়াইট ফ্রন্টিয়ার: রাইজিং রাইভালস, ভালনারেবল অ্যালাইস, অ্যান্ড দ্য ক্রাইসিস অব আমেরিকান পাওয়ার' এক্ষেত্রে পুনরায় পর্যালোচনার দাবি রাখে। এই বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা কিভাবে বৈশ্বিক অঙ্গীকারগুলো নিয়ে সংশয়ী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন।
প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে ক্রিমিয়া দখল করে, তখন হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি এটিকে এমন একটি আঞ্চলিক সংঘাত হিসেবে দেখেছিলেন, যা আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের সঙ্গে জড়িত নয়। ওবামা প্রশাসনের সময়েই পোল্যান্ড, উপসাগরীয় দেশগুলো এবং জাপানের মতো দীর্ঘদিনের মিত্ররা আমেরিকার ওপর আস্থা হারাতে শুরু করায় নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়াতে শুরু করে।
তবে ওবামার পক্ষে বলতে গেলে, তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন যদিও একজন আবেগহীন বাস্তববাদী ছিলেন, তবু জোটগুলোকে আমেরিকার শক্তির উৎস হিসেবেই দেখতেন। কিন্তু মি. ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' দর্শন আরও বেশি নৈরাজ্যবাদী ও নেতিবাচক এক মতবাদ। আমেরিকার মূল ভূখণ্ড এখনও অপ্রতিরোধ্য শক্তিশালী হলেও, পশ্চিমা বিশ্বকে বিভক্ত করার সুযোগসন্ধানীদেরও হয়তো সহজে থামানো যাবে না।