‘দ্য কেরালা স্টোরি’, ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’,এবার ‘পরম সুন্দরী’; দক্ষিণ ভারতের ‘স্টেরিওটাইপ’?

বলিউডের নতুন রোম্যান্টিক কমেডি 'পরম সুন্দরী' ভারতের বৃহত্তম ও প্রভাবশালী চলচ্চিত্র শিল্পে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর চরিত্রগুলোকে কীভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা নিয়ে পুরোনো এক বিতর্ক আবার উসকে দিয়েছে।
সিদ্ধার্থ মালহোত্রা ও জাহ্নবী কাপুর অভিনীত ছবিতে দক্ষিণ ভারতের কেরালার এক নারী এবং উত্তর ভারতের দিল্লির এক পুরুষের প্রেমকাহিনী দেখা যায়। পরম ও সুন্দরী প্রথমে একে অপরের সঙ্গে ছোটখাটো ঝামেলায় জড়ান, পরে ধীরে ধীরে প্রেমে পড়ে এবং অবশেষে তাদের সাংস্কৃতিক পার্থক্য কাটিয়ে ওঠেন।
বলিউডের জন্য এই ধারণাটি অবশ্য নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে রোম্যান্টিক কমেডির মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক ফারাককে উপস্থাপন করা হয়ে আসছে। বহুভাষিক এই দেশে, সুনিপুণভাবে নির্মিত আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রেমের গল্প প্রায়শই দর্শকের নজর কাড়ে।
তবে এবার কেরালা এবং এর বাইরের সমালোচকরা ছবির 'সুন্দরী' চরিত্রের উপস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সামাজিক মাধ্যমে ছবিটি কেরালার সংস্কৃতিকে এক ধরনের 'ক্যারিকেচার' আকারে দেখানোর অভিযোগ উঠেছে।
কাপুরের 'সুন্দরী' চরিত্রে প্রায়ই দেখা যায় চুলে জুঁই ফুলের মালা, তিনি হাতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, শখ হিসেবে নারকেল গাছে ওঠেন—যা সবই কেরালার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রচলিত বৈশিষ্ট্য। তবে তার মালয়ালম উচ্চারণ অত্যন্ত দুর্বল, যদিও তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় সেখানেই কাটিয়েছেন।
ছবির ট্রেলার প্রকাশের পরপরই এই সমালোচনা শুরু হয়। অনেকে 'সুন্দরী'র নিজের নাম ভুল উচ্চারণের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এটি বিতর্কিত চলচ্চিত্র 'দ্য কেরালা স্টোরি'-র আরও একটি সমালোচিত চরিত্র শালিনী উন্নি কৃষ্ণান (আদা শর্মা অভিনীত)-এর সঙ্গেও তুলনার জন্ম দেয়।

'দ্য কেরালা স্টোরি' এবং 'পরম সুন্দরী'—দুই ছবিতেই দেখা যায়, নায়িকারা কেরালায় বসবাস করা সত্ত্বেও হিন্দি ভাষায় কথা বলেন এবং মালয়ালম বলতে গেলে সাবলীলতা হারিয়ে ফেলেন। 'পরম সুন্দরী'র শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই যখন পরম-এর বন্ধু জানতে পারে তারা কেরালার নামাঙ্গিয়ারকুলাঙ্গারা নামের একটি গ্রাম দেখতে যাবে, তখন সে নামটি বিকৃত করে উচ্চারণ করে জিজ্ঞাসা করে, 'সেটা কোথায়? আফ্রিকা?'
একবার কেরালায় পৌঁছানোর পর ছবিটি যেন পর্যটকদের চোখে রাজ্যটির পরিচিত সব দৃশ্য এক ঝলকে তুলে ধরে—বিখ্যাত ব্যাকওয়াটার্স, নারকেল গাছ, তাড়ি, হাতি এবং জনপ্রিয় উৎসব ওনাম। এক সমালোচক এই ছবিটিকে 'কেরালা পর্যটনের একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য বিজ্ঞাপন' হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এটি 'সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতা তৈরির সব সম্ভাবনাকে সানন্দে গুঁড়িয়ে দিয়েছে'।
তবে অনেক দর্শকের কাছে অবশ্য সাংস্কৃতিক অসঙ্গতি কোনো বড় বিষয় নয়। উত্তর বিহারের বাসিন্দা রাজীব 'পরম সুন্দরী'কে একটি অচেনা সংস্কৃতিতে উঁকি দেওয়ার মজাদার মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলেন, ছবিতে হয়তো বাস্তবতার নিখুঁত চিত্রায়ন নেই, তবে সত্যতা খুঁজতে গেলে বিনোদন ফিকে হয়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, 'হয়তো এটা ধীরে ধীরে বদলাবে। তবে ছবিকে আকর্ষণীয় করতে এতটা শৈল্পিক স্বাধীনতা ঠিক আছে।'
তবে অন্যদের কাছে, দর্শকদের শিক্ষিত করার ছবির প্রচেষ্টা ছিল অসম্পূর্ণ। কঠোর সমালোচনায় সমালোচক সৌম্যা রাজেন্দ্রন ছবিটিকে 'সাধারণ, ক্লান্তিকর এবং আপত্তিকর' বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এটি 'বিদেশি' কেরালার প্রেক্ষাপট এবং এখানকার 'বিদেশি সত্তা'কে অতিরিক্তভাবে তুলে ধরে এমন একটি আবহ সংগীতের আড়ালে গতানুগতিক ক্লিশেগুলোকে লুকিয়ে রেখেছে।
বলিউডে অভিনয়শিল্পী নির্বাচন বিষয়ক সমালোচনা এবং তা কাটিয়েও ওঠা নতুন নয়। যেমন, ২০১৩ সালের 'চেন্নাই এক্সপ্রেস' সমালোচকদের দ্বারা নিন্দিত হলেও বক্স অফিসে বাজিমাত করেছিল। মণিপুর রাজ্যের অলিম্পিক পদকজয়ী বক্সার মেরি কমের চরিত্রে ২০১৪ সালে প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নেওয়া হলে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন নির্মাতারা। প্রিয়াঙ্কা নিজেও পরে স্বীকার করেছিলেন যে, 'পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, চরিত্রটি উত্তর-পূর্বের কারোরই করা উচিত ছিল।' তবে ছবিটি সফল হয়েছিল এবং চোপড়া তার প্রাণবন্ত অভিনয়ের জন্য পুরস্কার জিতেছিলেন। আর ১৯৬৮ সালে মেহমুদের 'পড়োসন' ছবিতে তামিল গায়কের ক্যারিকেচার আজও ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত।
তবে ভারতীয় বিনোদন জগতের চিত্র এখন বদলে গেছে। মহামারির কারণে সিনেমা হল বন্ধ থাকা এবং স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর উত্থান বলিউডকে হিট ছবির জন্য ধুঁকতে বাধ্য করেছে। বড় বাজেটের ফ্লপ ছবিগুলো বলিউডের আধিপত্যকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
এখন নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওর মাধ্যমে অ-হিন্দি ছবিগুলো ডাব করা সংস্করণের মাধ্যমে দেশজুড়ে দর্শকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, যা তাদের নতুন ভক্ত এনে দিচ্ছে। অন্যদিকে, বলিউডের বড় বড় ছবিগুলো আর আগের মতো সিনেমা হলগুলোর মূল সময় দখল করে রাখতে পারছে না।
মুক্তির পর থেকে 'পরম সুন্দরী' নিয়মিতভাবে কিন্তু ধীরগতিতে আয় করেছে। অন্যদিকে, মালয়ালম ভাষার নারী সুপারহিরো ছবি 'লোকা' তার উদ্ভাবনী প্লট ও নির্মাণশৈলীর জন্য প্রশংসিত হয়ে সুপারহিট হয়েছে।
'পরম সুন্দরী' নিয়ে লেখা তার এক নিবন্ধে লেখক ক্রিস উল্লেখ করেছেন, কীভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পগুলো অভিনেতাদের নিজ সংস্কৃতি বহির্ভূত চরিত্রে অভিনয় করাকে মেনে নেয়। তিনি লিখেছেন, 'দর্শকরা তখনই ক্ষুব্ধ হন, যখন চরিত্রগুলো কোনো রাজ্য বা সেখানকার মানুষের ক্যারিকেচার বলে মনে হয়।'
তবে দেশটির লেখক ও কবি আলিনা উল্লেখ করেছেন যে, কেবল বলিউডই নয়, মালয়ালম সিনেমাও আদিবাসী, দলিত এবং তামিল চরিত্রগুলোকে প্রায়শই গতানুগতিক ছাঁচে ফেলে উপস্থাপন করে। একই ভাবে, দক্ষিণের ছবিগুলোতে হিন্দিভাষীদের প্রায়শই ক্যারিকেচার হিসেবে দেখানো হয়।
আলিনা বলেন, 'আমার মনে হয় এটি ক্ষমতা বিন্যাস এবং উপস্থাপনার একটি বড় প্রশ্ন,' যেখানে একটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব গল্প গঠনে তাদের ভূমিকার ওপর জোর দেন তিনি। তিনি মনে করেন, যখন একটি গল্প কোনো সম্প্রদায়ের সত্যিকারের মানুষের কণ্ঠস্বরকে অন্তর্ভুক্ত না করে উপস্থাপন করা হয়, তখন তা একপেশে ও ভারসাম্যহীন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে।
তার মতে, 'আমরা যে শিল্প তৈরি করার চেষ্টা করছি, তাতে মানুষকে অংশগ্রহণকারী বা অংশীদার করতে হবে।'