স্কুলজীবন শেষ হওয়ার বহু বছর পরও কেন সেই সময়ের দুঃস্বপ্নগুলো পিছু ছাড়ে না

আজ ফাইনাল পরীক্ষার সকাল। এদিকে পরীক্ষার হলে গিয়ে খেয়াল করলেন একটা প্রশ্নও কমন পড়েনি। আতঙ্কে, উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে কাঠ। ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু একটু পরই বুঝলেন, যাক, বাঁচা গেল! পুরোটাই ছিল একটা দুঃস্বপ্ন।
কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, স্কুল-কলেজ পাশ করার এতগুলো বছর পরেও কেন এই ধরনের স্বপ্নগুলো ফিরে ফিরে আসে? কেন ঘুমের মধ্যেও পরীক্ষার টেনশন, ক্লাস খুঁজে না পাওয়ার আতঙ্ক আমাদের তাড়া করে বেড়ায়? এর পেছনের কারণগুলো কিন্তু বেশ চমকপ্রদ।
স্মৃতির সরণিতে প্রথম মানসিক চাপ
ক্যালিফোর্নিয়ার প্রখ্যাত মনোরোগ ও ঘুম বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যালেক্স ডিমিট্রিউ এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি বলছেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দুশ্চিন্তা আর মানসিক চাপই অপ্রস্তুত থাকার স্বপ্নের জন্ম দেয়। তবে স্বপ্নটা বিশেষভাবে স্কুলকে কেন্দ্র করে আসার কারণ হলো, আমাদের জীবনের ভিত্তিটা ওই সময়েই তৈরি হয়।
তিনি বলেন, "আমাদের অনেকের জন্যই স্কুল হলো সেই প্রথম জায়গা, যেখানে আমরা অপ্রস্তুত থাকার ভয় বা মানসিক চাপের সঙ্গে পরিচিত হই।" তার মতে, প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে যখন আমরা কাজ বা অন্য কোনো কারণে চাপে থাকি, তখন আমাদের অবচেতন মন সেই পুরনো স্মৃতিগুলোকেই আবার সামনে নিয়ে আসে। স্কুলের সেই প্রথম পরীক্ষাভীতি, দেরি হওয়ার আতঙ্ক বা কিছু ভুলে যাওয়ার ভয়গুলোই নতুন করে ফিরে আসে স্বপ্নের মাধ্যমে।
স্কুল মানেই কি একরাশ আতঙ্ক?
স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করেন জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডিলান সেলটারম্যান। তিনি জানান, স্কুল সম্পর্কিত স্বপ্নগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেশ বেদনাদায়ক হয়। মানুষ স্বপ্ন দেখে—পুরো বছর ক্লাস করেনি তাই ফেল করার ভয় পাচ্ছে, কিংবা পরীক্ষার হল খুঁজে পাচ্ছে না, অথবা এমন এক পরীক্ষার সামনে পড়েছে যার জন্য কোনো প্রস্তুতিই নেই।
সেলটারম্যানের মতে, এর কারণ হলো, শিক্ষাব্যবস্থাটাই বেশিরভাগ মানুষের জন্য একটা নেতিবাচক মানসিক অভিজ্ঞতা তৈরি করে। একটি জাতীয় সমীক্ষার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাই স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই স্কুল নিয়ে হতাশ থাকে। প্রায়ই তাদের এমন বিষয় পড়তে বাধ্য করা হয় যা তাদের ভালো লাগে না, আর নিয়ম না মানলে থাকে শাস্তির ভয়। পড়াশোনার চাপে অনেক ছাত্রছাত্রী ঠিকমতো ঘুমাতেও পারে না।
তিনি আরও বলেন, "স্কুলে প্রায়ই উচ্চ মানসিক চাপ আর তীব্র প্রতিযোগিতার পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে অনেক কিছু ঝুঁকির মধ্যে থাকে। সব মিলিয়ে স্কুল জীবনটা আসলে অনেকের জন্যই বেশ যন্ত্রণার।"
বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়েও এই স্বপ্নগুলো বেশি করে ফিরে আসতে পারে। যেমন, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার কারণে স্কুল জীবনের স্মৃতি বা দুঃস্বপ্ন হানা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঝে মাঝে এমন স্বপ্ন দেখাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু যদি দুঃস্বপ্নগুলো প্রায়ই ভোগায়, তবে বুঝতে হবে জীবনে মানসিক চাপটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। ডা. ডিমিট্রিউ এই চাপ থেকে মুক্তির পথ খোঁজার পরামর্শ দেন।
ডা. ডিমিট্রিউ বলেন, ঘুমের বাজে অভ্যাসের কারণেও এমন স্বপ্ন আসতে পারে। তার পরামর্শ—
- প্রতিদিন প্রায় একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং ঘুম থেকে উঠুন।
- ঘুমানোর আগে ভারী খাবার বা অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
- ঘুমের আগে কিছুক্ষণ নিজেকে শান্ত করার জন্য সময় দিন।
তার ভাষায়, "রকেটের গতিতে চলা মস্তিষ্ক তো আর হুট করে থেমে যেতে পারে না।" তিনি রাত ১০টার পর মোবাইল, ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। কারণ ঘুমানোর আগে অনলাইন শপিং বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরিও মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে তোলে, যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
তিনি বলেন, "আপনার জীবনে কিছুটা নীরবতা দরকার। এটি আপনার ঘুমকে যেমন ঠিক করবে, তেমনই অনেক দুশ্চিন্তাও দূর করবে।"
যেকোনো মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে এবং নিজেকে আরও গোছানো অনুভব করতে ডায়েরি লেখার অভ্যাস করতে পারেন। এটি মানসিক চাপের স্বপ্নগুলোর একটি অব্যর্থ 'প্রতিষেধক' হতে পারে।
ডা. ডিমিট্রিউয়ের মতে, এই দুঃস্বপ্নগুলো আসলে আমাদের একটা কথাই মনে করিয়ে দেয়—এবার একটু আরাম করা দরকার। তিনি জোর দিয়ে বলেন, "জীবনের জন্য ভালো ঘুম যে কতটা জরুরি, তা বলে শেষ করা যাবে না।"
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা