যেভাবে ফ্যাশন জগত পুরোপুরি বদলে দিয়েছিলেন ‘স্টাইল গুরু’ জর্জিও আরমানি
৯১ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ইতালীয় ফ্যাশন ডিজাইনার জর্জিও আরমানি। কোকো শ্যানেলের পর তিনিই ছিলেন প্রথম নকশাকার, যিনি বৈশ্বিক ফ্যাশন জগতে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন এনে দেন।
আরমানি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন স্যুটকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার জন্য। তার নকশা পুরুষদের পরিশীলিত আভিজাত্য দিয়েছে, আর নারীদের কর্মক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস যোগিয়েছে। সংবাদমাধ্যম তাকে আখ্যা দিয়েছিল 'প্রথম উত্তর-আধুনিক নকশাকার'।
১৯৩৪ সালের ১১ জুলাই উত্তর ইতালির পিয়াসেঞ্জায় জন্ম নেন আরমানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাঁর মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রা ধ্বংস করে দেয়। শৈশবে তিনি ক্ষুধা ও যুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেন। একবার রাস্তায় অবিস্ফোরিত কামানের গোলা বিস্ফোরণে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন এবং তাঁর এক বন্ধু নিহত হয়। পরবর্তীকালে তিনি বলেছিলেন, 'যুদ্ধ আমাকে শিখিয়েছে যে সবকিছুর মধ্যে গ্ল্যামার থাকে না।'
প্রথমে চিকিৎসাবিদ্যা পড়াশোনা শুরু করলেও তিন বছর পর তা ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন আরমানি। তবে সামরিক জীবন পছন্দ না হওয়ায় তিনি কাজ শুরু করেন মিলানের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর লা রিনাসেন্তে-তে উইন্ডো ড্রেসার হিসেবে। সেখান থেকেই তাঁর নকশাশিল্পে হাতেখড়ি। ফ্যাশন স্কুল নয়, দোকানের মেঝেতেই তিনি গড়ে তোলেন নিজের দক্ষতা।
গ্রাহকের রুচি ও চাহিদা বুঝতে আরমানি শিখেছিলেন কোন ধরনের কাপড় জনপ্রিয়। প্রায়ই তিনি টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কাপড় কিনতেন এবং সেখানেই শিখে নেন বুননের খুঁটিনাটি। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন কাপড়ের বুনন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর পোশাকে সূক্ষ্মতা ও নিখুঁততা এনে দেয়।
১৯৬০-এর দশকে পুরুষদের পোশাকধারণে যে পরিবর্তন আসছিল, আরমানির নকশা ছিল তারই প্রতিচ্ছবি। একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণে তিনি এক নতুন সম্ভাবনা দেখেন। আরমানি বলেছিলেন, 'আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে তাদের এমনভাবে পোশাক পরার একটি উপায় দরকার, যা পুরুষদের সমতুল্য হবে এবং কর্মজীবনে মর্যাদা দেবে।'
১৯৭৮ সালে আরমানির কোম্পানি ইতালীয় পোশাক প্রস্তুতকারক জিএফটি-র সঙ্গে চুক্তি করে, যা তাদের বিলাসবহুল রেডি-টু-ওয়্যার পোশাক ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদনের সুযোগ দেয়। একই সময়ে তিনি পান এক বিরাট বিপণন সাফল্য। রিচার্ড গিয়ার অভিনীত ১৯৮০ সালের চলচ্চিত্র আমেরিকান জিগোলো-তে পোশাক সরবরাহ করেন তিনি। ছবির প্রায় প্রতিটি দৃশ্যে গিয়ারের গ্ল্যামারাস চেহারা আরমানির নকশায় সাজানো ছিল।
এরপর থেকে অস্কারের লাল গালিচায় অসংখ্য তারকা আরমানির পোশাকে সজ্জিত হয়েছেন। তিনি নকশা করেছেন অনেক চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সিরিজের জন্যও, যার মধ্যে দ্য আনটাচেবলস এবং ১৯৮০-এর দশকের জনপ্রিয় ক্রাইম সিরিজ মিয়ামি ভাইস উল্লেখযোগ্য।
এক দশকের মধ্যেই আরমানি হয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ইউরোপীয় নকশাকার। এরই ধারাবাহিকতায় মিলানও ফ্যাশন জগতে বাণিজ্যিক ও সৃজনশীল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়—যা প্যারিসের পরেই স্থান করে নেয়।
তারপর আরমানি তার ব্র্যান্ডকে প্রসারিত করতে উদ্যোগী হন। চালু করেন 'আরমানি জিন্স' ও 'এম্পোরিও আরমানি'। ল'রিয়ালের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে তালিকায় যুক্ত হয় সুগন্ধি। এরপর আসতে থাকে চশমা, স্পোর্টসওয়্যার, প্রসাধনী ও নানা আনুষঙ্গিক পণ্য। ধীরে ধীরে একটি লেবেলের অধীনে গড়ে ওঠে এক সম্পূর্ণ জীবনধারা। জিকিউ ম্যাগাজিন একে আখ্যা দিয়েছিল 'টোটাল লুক' বা 'পূর্ণাঙ্গ সাজ'।
আরমানির সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে তাঁর প্রাথমিক অভিজ্ঞতা থেকেই, মিলানের সেই ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ফ্লোরে। সেখানে গ্রাহকের চাহিদিই ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং একজন ভালো নকশাকার নিশ্চিত করতেন যে তিনি তাদের পরিবর্তিত রুচি ও প্রয়োজনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবেন।
৬৫ বছর ধরে আরমানি এই কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে চালিয়ে গেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী ১৩ বিলিয়ন ডলার (১০ বিলিয়ন পাউন্ড) মূল্যের বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন। একবার এক প্রতিবেদককে তিনি বলেছিলেন, ' আমি কখনো সন্তুষ্ট হই না। একজন চির অসন্তুষ্ট এবং নিখুঁততার সন্ধানে আবদ্ধ মানুষ হিসেবে, আমি কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন না করা পর্যন্ত হাল ছাড়ি না।' া
