ভারতে বাড়ছে সিংহের সংখ্যা; আনন্দের কারণ হলেও বেড়েছে আশঙ্কা, সমস্যা

পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যে নিজের বাড়ির কাছের মাঠে ভাইদের সঙ্গে খেলছিল পাঁচ বছরের পুলসিং আজনেরা। হঠাৎ এক সিংহ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়—কাঁদতে কাঁদতে সিএনএনকে এমনটাই জানান শিশুটির শোকাহত বাবা হীরা আজনেরা।
হীরা বলেন, 'সিংহটা আমার ছোট ছেলেটিকে ধরে নিয়ে যায়। আমরা প্রাণপণে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। পরিবারের সবাই পাথর ছুড়েছে, লাঠি ছুড়েছে। কিন্তু সিংহ ছেলেকে টেনে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে যায়।'
পরে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
পুলসিং ছিল গত এক বছরে ভারতে সিংহের হামলায় নিহত সাতজনের একজন। গত পাঁচ বছরে এমন হামলায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০–এর বেশি। একই সময়ে গবাদিপশুর ওপর সিংহের আক্রমণও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বলে গুজরাটের কর্মকর্তারা সিএনএনকে জানিয়েছেন।
গাঢ় কেশর আর পেটের ভাঁজে আলাদা চেহারার এশীয় সিংহ আকারে আফ্রিকার সিংহের তুলনায় সামান্য ছোট। একসময় এরা ঘুরে বেড়াত মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়ার নানা প্রান্তে। এখন গুজরাটই বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃতিক আবাস এশীয় সিংহের।
এক শতাব্দী আগে গুজরাটে সিংহ শিকার বন্ধ না হলে হয়তো এরা বিলুপ্ত হয়ে যেত। সংরক্ষণ কার্যক্রমের ফলে গত পাঁচ বছরে রাজ্যে সিংহের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯১–এ।
সংরক্ষণবিদরা বলছেন, এ সফলতার বড় কারণ মানুষের সঙ্গে সিংহের এক বিশেষ সহাবস্থান—যেখানে স্থানীয়রা সিংহ থেকে আর্থিকভাবে উপকৃত হয়, আর সিংহকে ঘোরাফেরার জায়গা দেওয়া হয়। তবে সিংহের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্পর্ক পরীক্ষার মুখে পড়ছে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নেটওয়ার্ক 'বায়োডাইভার্সিটি কলাবোরেটিভ'-এর সমন্বয়ক এবং বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ রবি চেল্লম বলেন, 'সিংহকে হোটেলের বেইসমেন্ট পার্কিংয়ে পাওয়া যাচ্ছে… মানুষের বাড়ির ছাদে দেখা যাচ্ছে। তারা ছাদে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, গর্জন করছে।'
তিনি বলেন, 'যেই মুহূর্তে কোনো সিংহ জনবহুল এলাকায় প্রবেশ করে, তখনই মানুষের ওপর আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।'
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চেল্লাম ও অন্য সংরক্ষণকর্মীরা গুজরাট সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছেন, যেন রাজ্যের বাইরে অন্য কোনো এলাকায় কিছু সিংহ স্থানান্তর করা হয়।
কিন্তু গুজরাটের সিংহ এখনো কোথাও যায়নি। তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে—যা মানুষের সঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি করছে। যদিও দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে সিংহ স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছিল।
এশীয় সিংহের সংখ্যা বাড়ছে
বিপন্ন প্রাণী সংরক্ষণের জন্য ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গুজরাটের গির ন্যাশনাল পার্ক। ৫৪৫ বর্গমাইল আয়তনের এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলটি আকারে প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের সমান।
বর্তমানে গুজরাটের বেশিরভাগ এশীয় সিংহ পার্কের সীমানার বাইরে বসবাস করছে। সেগুলো আশপাশের শহর ও গ্রামে মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

গুজরাটভিত্তিক সংরক্ষণবিদ জেহান ভূজওয়ালা সিএনএনকে বলেন, 'তাত্ত্বিকভাবে এটি একটি সাফল্যের গল্প, কারণ সংরক্ষণ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই ছিল প্রজাতির সংখ্যা বাড়ানো।'
ভূজওয়ালা বলেন, 'কিন্তু যখন প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন তারা সংরক্ষিত এলাকার বাইরে চলে যায়… আর তখনই স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।'
তিনি জানান, ভারতের সংরক্ষণ মডেল কখনোই মানুষ থেকে সিংহকে আলাদা করার জন্য তৈরি হয়নি। কারণ জাতীয় উদ্যানের ভেতরেই গ্রামগুলো গড়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, 'সবাই একসঙ্গে সহাবস্থান করেছে। সেই সহাবস্থান, সেই সহনশীলতাই ভারতের সংরক্ষণ ইতিহাসে একেবারে অনন্য।'
স্থানীয় মানুষ সিংহের ওপর নির্ভর করে পর্যটন আয়ের জন্য। আর এর বিনিময়ে বড় বিড়ালজাতীয় প্রাণীরা স্থানীয় রাখালদের ফেলে যাওয়া বৃদ্ধ গরু খায়। গত বছর প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এমন তথ্য লিখেছিলেন ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটের সাবেক ডিন যাদবেন্দ্রদেব বিক্রমসিংহ ঝালা।
ঝালা ও তার সহলেখকরা জানান, সিংহরা শূকর আর নীলগাইও শিকার করে। এতে কৃষকেরা যে পশুগুলোকে ক্ষতিকর মনে করে, সেগুলোও নিয়ন্ত্রণে আসে।
ঝালা বলেন, সিংহের সঙ্গে বসবাস করতে শিখেছে স্থানীয় জনগণ। কারণ, ঝুঁকির চেয়ে তাদের আর্থিক সুবিধা বেশি।
সিএনএনকে এক বিশেষজ্ঞ বলেন, 'এমন মাত্রার সহাবস্থান মানুষ ও বড় মাংসাশী প্রাণীর মধ্যে বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না।'
স্থানীয় মানুষের সঙ্গে এ সম্পর্ক আরও গভীর।
স্থানীয় মালধারি সম্প্রদায়ের সদস্য ও ৩২ বছর বয়সী কৃষক লক্ষ্মণ বলেন, 'যেখানে মালধারি আছে, সেখানে সিংহ আছে। আমরা এক।'
লক্ষ্মণ মহিষ পালন করেন এবং সেগুলোর দুধ বিক্রি করে স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের দেখাশোনা করেন। তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে গবাদিপশুর ওপর সিংহের আক্রমণ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে পশুপালক সম্প্রদায়ের ক্ষোভ আরও বাড়ছে।
সংরক্ষণকর্মীরা সতর্ক করে বলেছেন, সিংহের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে মানুষ ও সিংহের এই সহাবস্থান শিগগিরই বদলে যেতে পারে।
স্থগিত সিংহ স্থানান্তর পরিকল্পনা
সিংহ সংরক্ষণকর্মী চেল্লাম বহুদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন, গুজরাটের গির অরণ্য থেকে কিছু সিংহকে মধ্যপ্রদেশের কুনো বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে সরিয়ে নেওয়া হোক। প্রায় তিন দশক আগে তিনি ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা যে সমীক্ষা করেছিলেন, তাতে কুনোকে সিংহ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
এই দাবি থেকেই ১৯৯৪ সালে 'সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট ল' ও 'ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার ইন্ডিয়া' যৌথভাবে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে। তারা চেয়েছিল, গুজরাটের স্থানীয় প্রশাসন যেন এই বিষয়ে উদ্যোগ নেয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষে রায় দেয়।

আদালত পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন, 'গির অরণ্য থেকে কুনোতে এশীয় সিংহ স্থানান্তরের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে।' আদালত জানিয়েছিল, ছয় মাসের মধ্যেই এ কাজ শুরু করতে হবে এবং প্রথম ধাপ হবে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন।
ওই কমিটির সদস্য চেল্লাম জানান, শেষ বৈঠক হয়েছিল ২০১৬ সালে। নিয়মিত বৈঠক না ডাকায় সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করে বলেন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে ঝুলিয়ে রেখেছে।
রায়ের এক দশকেরও বেশি সময় কেটে গেলেও সিংহ আজও শুধু গুজরাটেই সীমাবদ্ধ। বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে কারণ দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া থেকে আনা চিতাবাঘ কুনো বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ছাড়া হয়েছে।
ঐতিহাসিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২২ সালে ভারতে আনা হয় প্রথম চিতা। দেশটিতে প্রায় ৭০ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া এ প্রাণী পুনরুদ্ধারের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। কিছু শাবক শুরুতেই মারা গেলেও বর্তমানে কুনো অভয়ারণ্যে বেঁচে আছে ৩১টি চিতা। গত মে মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এটি 'সফলভাবে প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধির' প্রমাণ, যা ওই কর্মসূচি নিয়ে হওয়া সমালোচনার জবাব দিয়েছে।
ভারত সরকার দেশের প্রাণী সংরক্ষণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী বড় বিড়াল প্রজাতির রক্ষায় নেতৃত্ব দিতে চায়। এ ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধন করেন 'ইন্টারন্যাশনাল বিগ ক্যাট অ্যালায়েন্স'। এই উদ্যোগের লক্ষ্য—বাঘ, সিংহ, চিতা, তুষার চিতা, আফ্রিকান চিতা, জাগুয়ার ও পুমার মতো সাত ধরনের বড় বিড়াল প্রজাতিকে রক্ষা করা। বর্তমানে এ জোটে যুক্ত হয়েছে ১১টি দেশ।
চেল্লাম বলেছেন, কুনোতে চিতার উপস্থিতি সিংহের স্থানান্তর প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করতে পারে। কারণ চিতার জনসংখ্যা স্থিতিশীল হতে সময় লাগে এবং তারপরই অন্য কোনো প্রজাতি সেখানে স্থানান্তর করা সম্ভব।
গুজরাটের প্রধান বন সংরক্ষক জয়পাল সিং সিএনএনের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
চেল্লাম আরও জানান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং পর্যটন খাতের মানুষদের কাছ থেকেও স্থানান্তর নিয়ে বাধা আসছে । তারা ব্যবসা হারানোর ভয় পাচ্ছেন। এছাড়া, গুজরাট ভারতের একমাত্র জায়গা যেখানে সিংহ আছে—পর্যটকদের কাছে তৈরি হওয়া এ বিশেষ আকর্ষণ হারাতে চান না তারা।
গুজরাটে সিংহ সংরক্ষণে নতুন উদ্যোগ
গুজরাট সরকার কুনো সংরক্ষণ কেন্দ্রের বাইরে বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে।
এবার তারা কিছু সিংহকে রাজ্যের ভেতরে বারদা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারিতে স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে। উল্লেখ্য, ১৮৭৯ সালের পর প্রথমবার সেখানে ১৭টি এশীয় সিংহ দেখা গেছে।

সিংহ সংরক্ষণের তহবিলও গত তিন বছরে ৭০ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে ২০২৩-২০২৪ সালে ১৮.২ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। এটি সরকারের প্রাণী সংরক্ষণের প্রতি প্রতিশ্রুতির অংশ।
কিন্তু চেল্লাম জানান, বারদার আকার খুব ছোট এবং শিকারের জন্য পর্যাপ্ত প্রাণীর অভাব রয়েছে, তাই সেখানে দীর্ঘমেয়াদে সিংহ রাখা সম্ভব নয়।
এছাড়া বারদা গির ন্যাশনাল পার্কের খুব কাছাকাছি হওয়ায় রোগ ছড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব নয়। ফলে কোনো মহামারি ঘটলে গুজরাটের সমস্ত এশীয় সিংহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চেল্লাম বলেন, 'সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। যদি রোগ ছড়িয়ে পড়ে, তবে আপনার জন্য বড় সমস্যা হতে পারে।'
পালসিং-এর বাবা হীরা আজনেরা আগে বিশ্বাস করতেন মানুষ এবং সিংহ একসঙ্গে থাকতে পারে। তিনি সাত বছর আগে আমরেলি জেলায় চলে আসেন, যেটি সিংহ দেখা যায় এমন জায়গা হিসেবে পরিচিত এবং সেখানে একজন খামার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন।
তার বাড়ি জঙ্গল থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে ছিল এবং তিনি কখনো ভেবেও দেখেননি যে সিংহ মানুষের উপর হামলা করতে পারে। তিনি বলেন, 'এখানে সাধারণত এমন কিছু ঘটে না।'
তবে এখন শোকাহত বাবা তার মন বদলে ফেলেছেন। তিনি বলেন, 'আমরা সেখানে আর থাকতে পারলাম না। ভয়ে আমরা ওই এলাকা ছেড়ে ৫ কিলোমিটার দূরের অন্য একটি গ্রামে চলে এসেছি।'