দশেরা উৎসব উদ্বোধনে বুকারজয়ী বানু মুশতাকের আমন্ত্রণ ঘিরে ভারতে রাজনৈতিক বিতর্ক

আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারজয়ী লেখিকা বানু মুশতাক কর্ণাটকের মহীশূর দশেরা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে পড়েছেন।
গত সপ্তাহে কর্ণাটক রাজ্যের কংগ্রেস সরকার ঘোষণা করে যে এ বছর আন্তর্জাতিক বুকারজয়ী লেখিকা বানু মুশতাক মহীশূর দশেরা উৎসবের উদ্বোধন করবেন। 'হার্ট ল্যাম্প' নামের ছোটগল্প সংকলনের জন্য তিনি এ বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক বুকার পুরষ্কার জয় করেন।
মহীশূর দশেরা স্থানীয় ভাষাতে কন্নড়ে 'নাডা হাব্বা' (অর্থাৎ ভূমির উৎসব) নামে পরিচিত। এটি দশ দিনব্যাপী এক ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কয়েক দশক ধরে এটি পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মহীশূর শহরে জড়ো হন। থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হাতির শোভাযাত্রা, প্রদর্শনী ও আতশবাজি।
কিন্তু বানু মুশতাককে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্তের পর সমালোচনায় সরব হয়েছে বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। তাদের অভিযোগ, কর্ণাটকে জন্ম নেওয়া মুসলিম মুশতাকের হিন্দু ধর্মীয় উৎসব উদ্বোধন করা উচিত নয়।
দশেরা হিন্দু ধর্মীয় উৎসব, যা অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির বিজয় উদযাপন করে। তবে মহীশূর দশেরা কর্ণাটক রাজ্য সরকার আয়োজন করে এবং এই উৎসবে সব ধর্মের মানুষ অংশ নেন।
মুশতাক বলেন, এই উৎসবের আমন্ত্রণ তাঁর জন্য বড় সম্মান। শৈশব থেকেই তিনি এ উৎসবের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু তাঁর সম্মান প্রদর্শনের পরও বিতর্ক থামেনি।
বিজেপির কয়েকজন নেতা মুশতাকের আগের কিছু মন্তব্য নিয়েও আপত্তি তুলেছেন। বিশেষত তিনি হিন্দু দেবী ভূবনেশ্বরী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটিকে তারা অসম্মানজনক বলছেন। ভূবনেশ্বরীকে কন্নড় ভাষা ও পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে মানা হয়।
মুশতাক এ বছরের শুরুতে ইতিহাস গড়েন। তিনি প্রথম কন্নড় ভাষার লেখক হিসেবে আন্তর্জাতিক বুকার জিতেছেন। তাঁর বই হার্ট ল্যাম্প বিচারকদের তুমুল প্রশংসা পায়। তাদের মতে বইটিতে নারীদের সংগ্রাম আর টিকে থাকার অসাধারণ চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মুশতাকের গল্পে, বিশেষত হার্ট ল্যাম্প-এ, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও গভীর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের, বিশেষত মুসলিম নারীদের, জীবনের চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে।
তবে তিনিই প্রথম মুসলিম নন যাকে এই উৎসব উদ্বোধনের জন্য ডাকা হয়। ২০১৭ সালে কন্নড় কবি ও লেখক কে এস নিসার আহমেদ মুসলিম হলেও এই সম্মান পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার বিজেপি অনেক বেশি সরব।
বিজেপি সাংসদ যদুবীর ওয়াদিয়ার স্বীকার করেছেন, মুশতাক কন্নড় সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছেন এবং তাঁর বুকার জয় কন্নড় সাহিত্যকে 'অপূর্ব সম্মান' এনে দিয়েছে। কিন্তু তাঁর দাবি, মহীশূর দশেরা কেবল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। তাই মুশতাকের উচিত হবে উৎসবের সঙ্গে যুক্ত দুই হিন্দু দেবীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা স্পষ্ট করে তারপর উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া।

বিজেপি নেতা প্রতাপ সিম্হা বলেন,সাহিত্য উৎসবে অতিথি হওয়া মুশতাকের জন্য মানানসই, কিন্তু এই ধরনের উৎসবের প্রধান অতিথি হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, মুশতাক কি এই উৎসবের দেবীদের প্রতি বিশ্বাস রাখেন? তিনি কি হিন্দু প্রথা মানেন?
এই সমালোচনার মধ্যেই মুশতাকের গত জানুয়ারির এক বক্তব্যের ভিডিও আবার ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন কন্নড় ভাষা ও পরিচয়কে হিন্দু দেবী ভূবনেশ্বরীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তাঁর মতে, এটি মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়।
তবে মুশতাকই প্রথম লেখক নন যিনি এই প্রবণতাকে সমালোচনামূলকভাবে দেখেছেন। কর্ণাটকের অনেক প্রগতিশীল লেখক বরাবরই অভিযোগ করেছেন, কন্নড় ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে 'হিন্দুকরণ' করা হচ্ছে।
মুশতাককে সমর্থনকারীরা বলছেন, এই বিতর্ক শুধু তাঁর ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে নয়। বরং এটি এক বৃহত্তর প্রশ্ন—কর্ণাটকের সবচেয়ে বড় এই উৎসবটি কি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে, নাকি তা সংখ্যাগরিষ্ঠের একক আধিপত্যের অনুষ্ঠানে পরিণত হবে?
কন্নড় কবি মমতা সাগর বলেন, 'মহীশূর দশেরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। বানু মুশতাককে আমন্ত্রণ জানানো কর্ণাটকের জন্য এক ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটিকে ধর্ম বা হিন্দুত্বের ইস্যু বানানো ঘৃণ্য।'
এদিকে, কর্ণাটকের উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি.কে. শিবকুমার মুশতাককে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তার সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে কথা বলেছেন এবং উৎসবের অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রের ওপর জোর দিয়েছেন।
বানু মুশতাকও নতি স্বীকার করেননি। তিনি দ্য হিন্দু পত্রিকাকে বলেন, 'রাজনীতিবিদদের বোঝা উচিত, কোন বিষয় নিয়ে রাজনীতি করা যায় আর কোনটা নিয়ে নয়।'